অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী
মহাজাগতিক সফরে যাত্রা করেছেন শিক্ষাবিদ, চিকিৎসাবিজ্ঞানী, লেখক, গবেষক এবং কোয়ান্টাম পরিবারের শুভানুধ্যায়ী অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী। ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ বুধবার সকাল ৮টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৭ সালে সিলেটে। মা শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক স্বর্গীয় ড. মঞ্জুশ্রী চেীধুরী। বাবা সিলেটের বিশ্বনাথ পরগণার জমিদার স্বর্গীয় শৈলেন্দ্র কুমার চৌধুরী। তিন ভাইবোনের মধ্যে শুভাগত চৌধুরী সর্বজ্যেষ্ঠ। তার ভাইবোনেরা হলেন—অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী এবং ড. মধুশ্রী ভদ্র।
অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু করেন সিলেটে। এরপর ১৯৫২ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন পাঠভবনে এবং ফিরে এসে দেশের স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। পরে দেশে ও বিদেশে নানা উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন।
পেশাগত জীবনে অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। চিকিৎসা বিষয়ে গবেষণা করেছেন লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালে। গবেষণা, প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্যে ভ্রমণ করেছেন ইংল্যান্ড, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও পশ্চিম আফ্রিকা। তার গবেষণার বিষয় ছিল—প্রাণরসায়ন, পুষ্টি ও চিকিৎসা-শিক্ষাপদ্ধতি।
দীর্ঘ ৩৫ বছর সরকারি চাকরিজীবনে তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছেন। ২০০৪ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ঢাকার বারডেমসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা প্রদান করেন। এসোসিয়েশন অব নিউট্রিশনিস্ট এন্ড ডায়াটেশিয়ানস ফর সোশ্যাল সার্ভিসেস-এর (এএনডিএসএস) উপদেষ্টা ছিলেন তিনি।
অর্ধশতাব্দীব্যাপী দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে তার সান্নিধ্যে এসেছে অগণিত ছাত্র-ছাত্রী। শুধু চিকিৎসাবিদ্যা নয়, অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী তার শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছেন কীভাবে মানবিক ডাক্তার হতে হয়, কীভাবে ভালো মানুষ হতে হয়।
তার প্রয়াণে ডা. নকীব উদ্দিন লিখেছেন—
‘পরম শ্রদ্ধেয় শুভাগত স্যারের জন্য গভীর শ্রদ্ধা। উনি আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। অসাধারণ স্মার্ট ব্যক্তিত্ব, ব্যতিক্রমী পাঠদানরীতি, কঠিন বিষয়কে সহজ করে শেখানোর যেন এক অজানা মন্ত্র জানতেন তিনি। ক্লাসের অমনোযোগী ছাত্রটাও তার পড়ানোর এই অনন্য স্টাইলে আকৃষ্ট হতো। আর আমাদের জন্য বাড়তি পাওনা ছিল তার সাহিত্যগুণসমৃদ্ধ কথাবার্তা, একজন চিকিৎসক ও শিক্ষক হিসেবে যা বিরল। স্যার আজ পরলোকগত হলেও ইহলোকে বহু বছর বেঁচে থাকবেন তার লেখার মাধ্যমে, দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা তার অজস্র ছাত্রছাত্রী, গুণমুগ্ধ রোগী ও পাঠকের হৃদয়ে।’
অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরীর আরেকজন ছাত্র ডা. মাহবুব স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে—
‘Dr Shuvagoto Chowdhury was the youngest professor during our time in MMCH (Mymensingh Medical College Hospital). During our last day at MMCH he came to the stage and delivered shortest speech we ever heard but I still remember very clearly— “If you are not confident in treating your mother, you should not treat any patient.” Sincere condolences!’
বিশিষ্ট শিশু চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. তাহমীনা বেগম লিখেছেন—
‘শুভাগত স্যারকে চিনি ১৯৮৪ সাল থেকে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে স্যার অধ্যাপক, আমি পেডিয়াট্রিক্স-এর সহকারী রেজিস্ট্রার ও পরে রেজিস্ট্রার। স্যার আমার সরাসরি শিক্ষক নন কিন্তু অপরিসীম অনুপ্রেরণা ও সহৃদয় উপদেশ আমি পেয়েছি স্যারের কাছ থেকে, বিশেষ করে বারডেম হাসপাতালে দীর্ঘ ১১ বছর কাজ করার সময়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের কত কিছু যে তিনি জানতেন, তার উপর কত বই যে লিখে গেছেন! তার অগাধ জ্ঞান আর বইয়ের ভেতর স্যার বেঁচে থাকবেন চিরদিন। স্যারের চলে যাওয়া অপূরণীয়, তবুও তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। ভালো থাকুন প্রিয় স্যার অনন্ত জীবনে।’
একবার এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী বলেন, ‘ভালো মানুষ না হলে ভালো ডাক্তার হওয়া যায় না। মমতা না থাকলে চিকিৎসক হওয়া যায় না। চিকিৎসাবিদ্যা একটি জীবনব্যাপী শিক্ষা।’
লেখক হিসেবেও অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরীর রয়েছে উল্লেখযোগ্য খ্যাতি ও সম্মান । তিনি নিউইয়র্ক সায়েন্স একাডেমির নির্বাচিত সদস্য। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৬২টি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক বাংলায় অনুবাদ করেছেন তিনি। দেশি-বিদেশি জার্নালে চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে ৫০টিরও বেশি গবেষণা-প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য বইসমূহ হচ্ছে—আমাদের শরীর, কিডনীর যত্ন, ভালো থাকা সুস্থ থাকা, কর্মজীবী নারীর স্বাস্থ্য, শরীর অসুস্থ হলে আপনার কী করণীয়, মগজের অসুখ, বিচিত্র স্বাস্থ্য প্রসঙ্গ, সুস্থ থাকার সহজ উপায়, চিকিৎসাবিজ্ঞানে আবিষ্কারের কাহিনী, ভালো থাকুন সজীব হযে বাঁচুন, নিজের খেয়াল নিজে রাখুন, আবেগ ও স্বাস্থ্য, ঘুম ও স্বাস্থ্য, ক্যান্সার, প্রেসক্রিপশন ফর লাইফ, বয়স্কদের স্বাস্থ্য, সুস্থ থাকার সহজ উপায় উল্লেখযোগ্য। চিকিৎসা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্যে ‘শেরে বাংলা জাতীয় পুরস্কার ২০০৯’-এ ভূষিত হন তিনি। বিজ্ঞান শাখায় বিশেষ অবদানের জন্যে তিনি ২০২১ সালে ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ অর্জন করেন।
ভালো রবীন্দ্র সংগীত গাইতেন অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী। ১৯৬৫-৬৬ সালে সিলেট বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। একটি উদারনৈতিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সংগীত, নৃত্যকলা, চিত্রাঙ্কন, বইপড়া, লেখালেখি—এ সবকিছুর মধ্যে বেড়ে উঠেন তিনি।
ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন মুক্তমনা, সৎ, দক্ষ, উদার, কর্মমগ্ন একজন মানবিক মানুষ। তিনি বলতেন, ‘আমার সম্পদ হচ্ছে আমার ছাত্র-ছাত্রী ও আমার সন্তানরা’।
স্ত্রী কামনা চৌধুরী, দুই কন্যা স্বাগতা চৌধুরী, সুস্মিতা চৌধুরী এবং পুত্র শুভ্রব্রত চৌধুরীকে নিয়ে ছিল তার পারিবার।
ক্যান্সার নিয়ে পথচলা
২০১৮ সালে ডা. শুভাগত চৌধুরীর ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। এসময়ে দেশের বাইরে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি দেশেই চিকিৎসা নেন এবং সুস্থ হয়ে ওঠেন। ২০২৪ সালে প্রকাশিত ক্যান্সার-লড়াকু ও পরিচর্যাকারীদের অভিজ্ঞতা নিয়ে সংকলিত এখানে থেমো না বইতে তিনি বলেন, ‘দেশে সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমি দেশে চিকিৎসা নেওয়ার পক্ষপাতী, আর আমরা সবাই বিশেষ করে সমাজের যারা উঁচুতে, তারা দেশেই চিকিৎসা নিলে এর উন্নতি হবে, ঘাটতিগুলো চোখে পড়বে আর তখন কর্তাব্যক্তিরা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে এসব অপূর্ণতা পূর্ণ করবেন। আমাদেরে দেশের উচ্চবিত্ত বা প্রভাবশালীরা যদি দেশের চিকিৎসা নেন, চিকিৎসা নিতে বিদেশের পথে কম হাঁটেন, তাহলে বিরাট পরিবর্তন আসবে দেশের চিকিৎসাসেবায়’।
মৃত্যু সম্পর্কে তার আকুতি ছিল—‘শান্তিতে নিজের দেশে মারা যেতে চাই।’
কোয়ান্টামের সাথে একাত্মতা
২০০৫ সালের ১৬ আগস্ট কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আয়োজিত মুক্ত আলোচনায় মূল আলোচক হিসেবে ছিলেন অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী। আলোচনার নির্বাচিত অংশ নিচে দেয়া হলো :
মেডিটেশন করুন সুফল পাবেনই
চমৎকার মালভূমি। তার ঢালে বসে মেডিটেশন করছে অসংখ্য মানুষ। একটি বিদেশি ম্যাগাজিনে দেখেছিলাম ছবিটি। সেখানে মেডিটেশন এখন প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে চলে এসেছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানে এ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। প্রাচীন উপমহাদেশের যোগী, সন্ন্যাসী ও দরবেশদের ধ্যান বা মেডিটেশন এখন প্রায় এক কোটি আমেরিকানের নিয়মিত চর্চার বিষয়। বাংলাদেশেও মেডিটেশন বর্তমানে সচেতন মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করছে। আর কোয়ান্টাম মেথড এ চর্চারই একটি সফল দৃষ্টান্ত।
মানুষের ভেতরে একটি শক্তি রয়েছে। এ শক্তির উন্মেষ মানুষের মতো করে অন্য কোনো প্রাণী ঘটাতে পারে না। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো—মানুষ এখনো তার ব্রেনের সবটুকু ব্যবহার করতে পারে নি। প্রকৃতিগত চর্চা, যেমন মেডিটেশনের মাধ্যমে মানুষ কিন্তু তার ব্রেনকে বেশি পরিমাণে ব্যবহার করতে পারে। যত বেশি চর্চা তত বেশি নতুন কিছু উদঘাটনের সুযোগ।
এ-তো গেল ব্রেনের ব্যবহার। আমরা যদি মনের প্রশান্তির দিকে আসি তাহলে দেখা যাবে যে, ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করে দেহ-মনকে শিথিল করে শুধু শরীরের নয় মনের প্রশান্তিও আনা সম্ভব। আর প্রশান্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমার মন যদি ভালো থাকে, প্রশান্ত থাকে তাহলে অনেক বিরক্তিকর ব্যাপারকেও সামান্য মনে হয়। শারীরিক কষ্টকে মনে হয় তুচ্ছ। এমনকি মানুষের জীবনে যখন কিছু ভয়ঙ্কর সময় আসে, যেমন ক্যান্সার বা এসিডে পোড়ার মতো টারমিনাল ইলনেস, যখন প্রচণ্ড যন্ত্রণায় শরীর-মন বিদ্ধ, সে অবস্থায়ও কিন্তু মেডিটেশনের মাধ্যমে কিছুটা প্রশান্তি পাওয়া সম্ভব। মেডিকেল জার্নালে এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে।
আসলে রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিস, মাইগ্রেন বা নানারকম ক্রনিক ব্যথা-বেদনার চিকিৎসা হিসেবে যে পেইনকিলার, স্টেরয়েড ইনজেকশন ইত্যাদি দেয়া হয়, তার মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। আমেরিকায় ১৯৬০ সালের গোড়ার দিকে এবং পরে আবার ১৯৭০ সালের দিকে যখন হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. হার্বার্ট বেনসন হার্টের রোগীদের মেডিটেশন করাতে থাকেন, তখন থেকে এটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াল।
মেডিটেশন চর্চার ফলে রোগীদের রক্তচাপ ও মানসিক চাপের প্রশমনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফলাফল দেখে হার্বার্ট বেনসন চমৎকৃত হলেন। তার বেস্ট সেলার‘রিলাক্সেশন রেসপন্স’বইয়ে রয়েছে এর বর্ণনা। বোস্টনে বেনসন চালু করেন মাইন্ড-বডি ইনস্টিটিউট। বেনসনের গবেষণালব্ধ উক্তি—ডাক্তারদের কাছে যে রোগীরা পরামর্শের জন্যে যায়, তাদের ৬০-৭০ শতাংশ হলেন চাপগ্রস্ত মানুষ। এসব অসুখ ওষুধ বা শল্য চিকিৎসা দিয়ে নিরাময় হয় না। তবে মনোদৈহিক চিকিৎসা করে অত্যন্ত সুফল পাওয়া যায়।
আসলে মাইন্ড ইজ দ্যা বেস্ট হিলার। অর্থাৎ মন হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট নিরাময়কারী। অনেকে নিরাময় বলতে মনে করেন ওষুধ গ্রহণ করে শরীর ভালো হওয়া। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে : Health is defined as not only the absence of disease or infirmity. It is the complete mental, physical, social and spiritual well-being. অর্থাৎ আমার রোগ নেই বা আমি পঙ্গু নই—এটাই স্বাস্থ্য নয়। স্বাস্থ্য হলো আমি শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং আত্মিক—এই সবদিক থেকেই ভালো আছি কি না। যেমন, আমার ভালো লাগছে না বা আমার মনে আনন্দ নেই—এটাও কিন্তু অসুখ।
আর তাই পরিপূর্ণ নিরাময় বলতে শরীর, মন, আত্মা সবকিছুর নিরাময়কেই বোঝায়। সেজন্যে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে এখন ‘টোটাল পার্টিসিপেশন প্রসেস’ধারণাটি প্রচলিত যেখানে চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় ডাক্তার এবং রোগী একে অপরকে সহযোগিতা করেন। কারণ রোগী যদি ডাক্তারের কাছে গিয়ে তৃপ্ত হতে না পারে (যা আজকাল হচ্ছে) তবে শরীরে সুস্থতা এলেও মনে আসে না। কারণ আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি রোগ হলো মানসিক। এসব ক্ষেত্রে রোগীকে যদি একটু আশ্বাস দেয়া যায়, তার সমস্যা শোনার প্রতি মনোযোগ দেয়া যায় এবং তাকে সুস্থ হওয়ার আত্মবিশ্বাস দেয়া যায় তাহলে অনেক সহজে তাকে সারিয়ে তোলা সম্ভব। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে পজিটিভ রি-ইনফোর্সমেন্ট।
তবে এমন নয় যে, ওষুধ গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই। ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে যে রোগ হয় বা দুর্ঘটনাজনিত অসুস্থতা—এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই মেডিসিন, সার্জারি ইত্যাদির আশ্রয় নিতে হবে। এক্ষেত্রে মেডিটেশন তাকে শারীরিক আরাম এবং মানসিক আশাবাদ দিয়ে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। যেমন, হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের মনোবিজ্ঞানী এলিস ডোমার দেখেছেন, ধ্যানচর্চার ফলে অপারেশনের রোগীর দুশ্চিন্তা কমেছে, অপারেশন মোকাবিলা করেছেন আরো ভালোভাবে।
আসলে যে পজিটিভ রি-ইনফোর্সমেন্টের কথা বললাম, এটা শুধু চিকিৎসা ক্ষেত্রে নয়, দৈনন্দিন জীবনেও খুব চমৎকার ফলাফল দিতে পারে। যেমন, কোনো বাবা যদি রাতে তার ছেলের বালিশের পাশে একটা ছোট্ট চিরকুটে লিখে রাখেন “থ্যাঙ্ক ইউ মাই সান”বা কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রীর ক্ষেত্রে প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেন, তাহলে তাদের জন্যে তা এতটাই আনন্দের হতে পারে যা হয়তো অনেক কিছু দিয়েও হতো না। একই ব্যাপার হতে পারে কর্মীদের বেলায়ও যখন তারা বস্ বা মালিকের কাছ থেকে প্রশংসা পায় বা স্বীকৃতি পায়। এমনকি দেখা গেছে আর্থিক সুবিধা দিয়েও যে কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করা যায় নি, পজিটিভ রি-ইনফোর্সমেন্টের ফলে সে কর্মীদেরই উৎপাদনশীলতা বেড়ে গেছে অনেক গুণ।
এই ইতিবাচকতা, আশাবাদ তাদের পক্ষেই লালন করা সহজ যারা মেডিটেশন করেন, ধ্যানচর্চা করেন। কারণ ধ্যান মানুষকে আত্মনির্ভরশীল করে, জীবনকে রাখে চলমান। কাজে বাড়ায় মনোযোগ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সমস্যা সমাধানকে করে সহজ। তাই সুস্থ থাকুন আর না-ই থাকুন—কয়েক মিনিটের জন্যে হলেও মেডিটেশন করুন। কারণ এর সুফল দেহ-মনের ওপর পড়বেই।’
দেশি-বিদেশি পত্র-পত্রিকায় স্বাস্থ্য-সচেতনতা বিষয়ে বহু নিবন্ধ লিখেছেন অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী। ২০২৩ সাল থেকে কোয়ান্টাম ওয়েবসাইটে স্বাস্থ্য-সচেতনতা ও যত্নায়ন বিষয়ে নিয়মিত নিবন্ধ লিখছিলেন তিনি। ১৫ জানুয়ারি তার প্রয়াণ দিবসে প্রকাশিত হয় কী করে আত্মার স্বাস্থ্যের খেয়াল নেবেন নিবন্ধটি। এ নিবন্ধের শেষ কয়েকটি বাক্য—
‘কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন সৃষ্টিকর্তার কাছে সবকিছুর জন্য। নিজ নৈতিকতা আর মূল্যবোধকে উঁচুতে তুলে ধরুন আর রাখুন। আপনি নশ্বর—এই ভাবনা রাখুন মনে। একটি যথার্থ যোগ্য কারণে নিবেদিত হোন।
কর্মপ্রেমী এই মানুষটির সমগ্র জীবন যেন এই কথাগুলোরই প্রতিচ্ছবি। নিজেকে তিনি নিবেদিত করেছেন যথার্থ যোগ্য কারণে—মানুষকে ভালো থাকার পথ বাতলে দিয়েছেন জীবনভর।
এখানে থেমো না বইতে ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে যাওয়া দিনগুলোর স্মৃতিচারণে তিনি লিখেছেন—‘ঈশ্বর সীমারেখা টেনে দেন। পরিণতি কী হবে ভাবি নি। সবাই যখন খুব দুশ্চিন্তায়, আমি তখন ছিলাম খুব শান্ত। … ক্যান্সারের বিষয়টি অত ভাবনার মধ্যে ছিল না, মনে হয়েছিল নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, প্রিয়জনদের জন্য, যারা এত ভালবাসা দিল, তাদের জন্য বাঁচতে হবে। … ক্যান্সার চিকিৎসার কালে সময় যত কঠিন হোক, রাখতে হবে মনোবল। আমরা সবাই মরব; কিন্তু মৃত্যু যেন হয়ে ওঠে লাবণ্যময় ও মর্যাদার।’
শিক্ষাজীবন থেকে দীর্ঘ কর্মজীবনে, এমনকি ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াইয়ের কঠিন মুহূর্তেও এই চিকিৎসাবিজ্ঞানী নিজের কাজ করে গেছেন সবচেয়ে ভালোভাবে। ভেবেছেন দেশের মানুষের সুস্থতা নিয়ে, চিকিৎসাব্যবস্থার অগ্রগতি নিয়ে। ভবিষ্যতে তরুণ প্রজন্মের যারা চিকিৎসা পেশা বেছে নেবেন, তাদের জন্যে কর্মপ্রেম সাহস ও অনুপ্রেরণার উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবেন অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী।
পরম করুণাময় তার সকল ভালো কাজ সৎকর্ম হিসেবে কবুল করুন। আমরা তার অনন্ত প্রশান্তি কামনা করি।