সকালবেলা সূর্যের লাল আভা দেখা দিতেই যাকে মাঠে কাজ করতে যেতে হয়, তার কাছে লেখাপড়া ছিল কল্পনাতীত বিষয়। কোনো এক রাতে আমি বাবার পকেট থেকে একটি ১০ টাকার নোট নিই। এই টাকা দিয়ে স্কুলে ভর্তি হবো বলে ঠিক করি। কিন্তু বাবা বিষয়টি টের পেয়ে গেলেন। না বলে টাকা নেয়ায় বাবা আমাকে অনেক মারধর করলেন। আমার স্কুলে পড়ার স্বপ্নটার গোড়াতেই ছেদ পড়ে। ইচ্ছা ছিল সবার সাথে স্কুলে যাব। সবার সাথে খেলব, কিন্তু সেটা করতে পারি নি। ইচ্ছাগুলো কেন জানি মারা যেতে থাকে।
আমার বাবা এবং আমি সারাদিন মাঠে কাজ করতাম। দিনশেষে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন মনে হতো আমরা যেন যুদ্ধ থেকে ফিরে এলাম। সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার জন্যে কিছু খাবার খেয়ে ঘুমাতাম এবং পরের দিন সকালবেলা থেকে শুরু হতো আবার সেই একই কাজ।
দুঃখ, সুখ, হাসি ও কান্না—সব মিলিয়ে মানুষের জীবন। সময় যেভাবেই যাক আমি সবসময় চেয়েছি পড়াশোনা করবই। অনেক কষ্টে মাকে রাজি করিয়ে আমি স্কুলে ভর্তি হলাম। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত আমি সেই স্কুলে পড়াশোনা করি।
তখনকার সময়ে এনজিও পরিচালিত কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু ছিল। বই থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ সম্পূর্ণভাবে স্কুলটি বহন করত। তবে ওখানে সুযোগ পাওয়াটা ছিল কষ্টের, তারা যাকে নির্বাচন করবে তারাই শুধু পড়তে পারবে। ৩০ জনের মধ্যে আমি একটু বড় ছিলাম, যার কারণে সেখান থেকে আমি বাদ পড়ে যাই। আমার আর ফ্রি-তে পড়ার সুযোগ হলো না।
অন্য স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পাস করলাম। একদিন বিনা বেতনের সেই স্কুলের এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলাম যে, আমাকে কি তোমাদের স্কুলে নেয়া যাবে? সে বলল, আমি আগে স্যারকে বলে দেখব। তারপর তোমাকে জানিয়ে দেবো। পরের দিন স্যার আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমাকে বলা হলো—তুমি যদি এখানে পড়তে চাও তাহলে তোমাকে অতিরিক্ত ছাত্র হিসেবে পড়তে হবে এবং যাবতীয় খরচ তোমার নিজের থেকে বহন করতে হবে। যেহেতু আমার সেখানে পড়ার ইচ্ছা, তাই রাজি হয়ে গেলাম।
শুরুতে আমি তেমন ভালো ছাত্র ছিলাম না। আমি সেখানকার ছাত্রছাত্রীদের থেকে পড়ালেখায় অনেক পিছিয়ে ছিলাম। অন্যরা স্কুলের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে, কিন্তু আমি কোনোকিছুই পাই নি। সবকিছু চিন্তা ছেড়ে দিয়ে লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে লাগলাম। স্কুলে ক্লাস করতে দেয়ার সুযোগটাকে কাজে লাগালাম। কয়েক মাসে আমি হলাম ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্র। এটা ছিল আমার জীবনের একটা বড় সাফল্য।
সেখান থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে ভর্তি হই দাখিল মাদ্রাসায়। দাখিল মাদ্রাসা থেকে অষ্টম শ্রেণিতেও আমি জিপিএ-৫ পেয়ে ভর্তি হলাম গ্রামের এক হাই স্কুলে এবং সেখান থেকে এসএসসি পাশ করি।
ভাবছিলাম আর পড়ালেখার সুযোগ হবে না। সিদ্ধান্ত নিলাম গার্মেন্টসে গিয়ে কাজ করব। কিন্তু হঠাৎ করে খবর পেলাম কোয়ান্টাম কসমো কলেজের। শুনলাম সেখানে নাকি সবকিছু বিনামূল্যে সরবরাহ করে পড়াশোনা করানো হয়। একটা ফরম সংগ্রহ করে ঢাকায় পরীক্ষা দিলাম। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আবার পড়াশোনা করার সুযোগ পেলাম। কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে একজন কোয়ান্টা হিসেবে আমি জায়গা করে নিলাম।
কোয়ান্টামে এসে প্রথমদিকে একটু কষ্ট হলেও পরবর্তী সময়ে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। কেননা এটাই তখন আমার শেষ সম্বল। কোয়ান্টামের বাণীগুলোকে নিজের মনে ধারণ করার চেষ্টা করলাম। আল্লাহর রহমতে এখান থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় আমি ৪.৮৩ পেয়েছি।
আমি এখন জীবনে ভালো ও বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখছি। আসলে প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে কোনো না কোনো ভিশন থাকে। কেউ সেই ভিশনকে যদি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে, তাহলে সাফল্য নিশ্চিত। আমি যদি তখন গার্মেন্টসে চলে যেতাম তাহলে আজ উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন থাকত না। ভালোভাবে পড়াশোনা শেষ করে আমি আমার এলাকায় শিক্ষার আলো সঠিকভাবে পৌঁছে দিতে চাই। যারা আমার মতো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, আমি তাদের এই অন্ধকার জীবন থেকে আলোর পথে নিয়ে যেতে চাই।
মানুষ বলে, তার লক্ষ্য পূরণ হলেই সে সফল মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়। আমি আমার দিক থেকে এই কথাটা সঠিক মনে করি না। সফলতা কেবলমাত্র যাত্রা, এমন যাত্রা যার কখনো ‘দাঁড়ি’ হয় না। কেবল ‘কমা’ হতে পারে। আমি সফলতার সেই পথেই হাঁটতে চাই।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]