বিশ্ববিদ্যালয় কী জিনিস সেটা সম্পর্কে যখন ধারণা পাওয়া শুরু করি, তখন থেকেই আমি প্রোগ্রামিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ি। ধীরে ধীরে আমার মনছবি তৈরি হয় আমি কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ব।
কসমো স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর এক্সট্রা কারিকুলাম হিসেবে আমাকে প্রথম ব্যান্ড বাদনে দিলেও পরে যখন বিজ্ঞান ক্লাব নতুনভাবে চালু হয়, তখন আমাকে বিজ্ঞান ক্লাবে দেয়া হয়। ইলেকট্রনিক্সের সাথে পরিচিত হই তখন থেকেই। জহুরুল হক স্যারের তত্ত্বাবধানে আমরা অনেক ইলেকট্র্রনিক্সের প্রজেক্ট বানিয়েছিলাম। সিকিউরিটি অ্যালার্ম, ফায়ার অ্যালার্ম, লাইন ফলোয়ার রোবটসহ আরো বিভিন্ন প্রজেক্ট। শুধু ইলেকট্র্রনিক্সই নয়, পদার্থবিজ্ঞানের চমৎকার চমৎকার সব এক্সপেরিমেন্টও আমরা করতাম। এসব এক্সপেরিমেন্টে আমাদের সহযোগিতা করতেন সুজন স্যার, মুক্তা ম্যাডাম এবং রাসেল স্যার।
প্রতি শুক্রবার আরিফ স্যারের তত্ত্বাবধানে হতো গণিতের স্পেশাল ক্লাস। এই ক্লাসে গণিতের মজার মজার সব ধাঁধা এবং মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হতো, যার কিছুই পাঠ্যবইতে ছিল না। স্যার আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের প্রশ্ন সমাধান করতে দিতেন। এটা এমন একটা ক্লাস ছিল যেখানে কারো একঘেয়ে লাগত না। ক্লাসটা ছিল সবার জন্যে উন্মুক্ত। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল স্কুল ও কলেজ জীবন।
এইচএসসি-তে ভালো প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বে¡ও অটোপাশের কারণে এইচএসসির জিপিএ কিছুটা কম আসে। কিন্তু আমি হাল ছাড়ি নি। ঢাকা ও চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা দিলাম। দুটোতেই অপেক্ষমাণ তালিকায় ছিলাম তাও আবার পেছনের দিকে। তারপর গুচ্ছ ইউনিভার্সিটি ভর্তির প্রস্তুতি নিলাম এবং পরীক্ষা দিলাম। আল্লাহর রহমতে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্ট চলে এলো। আমি এখন এ বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ছি। কিন্তু এর পেছনে একটি গল্প আছে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে কলেজ থেকে আমাদের ছুটি দেয়া হলো। তারপর কিছুুদিনের মধ্যে ইউনিভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার সময় চলে এলো। এই শিশুকাল থেকে এইচএসসি পর্যন্ত, দীর্ঘসময় কোয়ান্টামে পড়ার পর বাইরের পরিবেশের সাথে তাল মেলানো ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও সব পরিস্থিতি মোকাবেলা করা আমরা স্কুলে থাকতেই শিখেছিলাম। তবুও বাস্তব জ্ঞান সবসময় ভিন্ন।
আমি আইসিটি বিষয়টি খুব ভালো পারতাম। কলেজে একবার আইসিটি স্যার ছিল না। তখন আমি আমার সহপাঠীদের আইসিটি পড়াতাম। সি প্রোগ্রামিং সবার কাছে কঠিন হলেও আমি সবাইকে সহজভাবেই বোঝাতাম। একপর্যায়ে শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা। ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় বাবা আমার পাশে ছিলেন। আমি একাই যেতে পারতাম। কিন্তু তারপরেও বাবা আমার সাথে গিয়েছিলেন যাতে আমি মনোবল না হারাই।
পরীক্ষার আগে আমি ভেবেছিলাম গণিত আমার মেইন সাবজেক্ট তাই ভর্তি পরীক্ষায় গণিত অংশ থেকে অবশ্যই উত্তর দিতে হবে। এজন্যে আইসিটি ভালো পারার পরেও আমি আইসিটি থেকে কোনো নৈর্ব্যক্তিকের উত্তর দেই নি। কিন্তু গণিত প্রশ্নগুলো কঠিন ছিল। সমাধান করতে সময় লাগছিল, তাই সবগুলোর উত্তর সময়ের সাথে দিয়ে উঠতে পারি নি।
আবার মন খারাপ হলো। আরো বেশি খারাপ লাগল যখন জানতে পারলাম—গণিত না দাগালে কোনো সমস্যা হতো না। আইসিটি দাগালেও চলত। কেন আমি এই ভুল করলাম! চোখে পানি চলে এলো। বাবা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। আফসোস কোরো না। এখন তো আর চাইলে কিছু করতে পারবে না।
কিন্তু আমার জীবনে একটা মিরাকল ঘটে গেল। দেখা গেল এই ভুল করার কারণেই পছন্দের সাবজেক্টটি পেলাম। কারণ গণিত দাগানোর জন্যেই আমি সাবজেক্ট চয়েজে আমার কাক্সিক্ষত সাবজেক্টটি দিতে পেরেছি এবং শেষ পর্যন্ত আমি নির্বাচিত হতে পেরেছি। এই সময়টা আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তখন আমি শুধু প্রার্থনা করতাম আর মেডিটেশন করতাম নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে।
তিন ভাইবোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। ছোটবেলা থেকেই মা-বাবা আমাকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখতেন। কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর প্রতি মাসের শেষ শুক্রবার কখনো বাবা আবার কখনো মা আমার সাথে দেখা করতে আসতেন। আমাকে বলতেন, বড় হয়ে তুমি একজন ইঞ্জিনিয়ার হবে। এখন মনে হয় আমি তাদের সেই স্বপ্ন পূরণের পথে আছি।
এই স্বপ্ন হয়তো স্বপ্নই থেকে যেত যদি আমি এই স্কুলে না পড়তাম। কারণ সেই ২০০৮ সালে যখন আমি প্রথম কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে আসি, তখন বয়স পাঁচ বছর হবে। তখন থেকে আমার শিক্ষাজীবন শুরু। বাবা ভালোমতোই জানতেন—আমাকে এমন একটি স্কুলে না দিলে তার পক্ষে প্রচুর অর্থ খরচ করে এভাবে পড়ানো সম্ভব হবে না। আমি ভর্তি হয়েছিলাম প্রথমে কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের অনাবাসিক শাখায়, সেটা বর্তমানে বোধিছড়া পাবলিক স্কুল নামে পরিচিত। অনাবাসিক শাখা হলেও সমস্ত কার্যক্রম—পড়ালেখা, প্যারেড, ডিসপ্লে একইসাথে হতো। সেখানে ১ম থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ২০১৩ সালে কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের আবাসিক সেকশনে ভর্তি হই।
আর সেই বছর আমি প্রথম কোয়ান্টাম মেথড কোর্স করি। কোর্স করার পর ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছাটা আমার মনছবিতে পরিণত হয়। নিয়মিত মেডিটেশন করতাম। সাদাকায়ন, আলোকায়নে অংশগ্রহণ করতাম। আর ভাবতাম আমার মা-বাবার স্বপ্ন আমি পূরণ করব।
আমি এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করতে চাই। এটাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যেন ব্যবহৃত হয় সৃষ্টির কল্যাণে। কারণ আমি মনে করি শিক্ষিত হওয়া বা গবেষণা করা তখনই ফলপ্রসূ হয় যদি সেটা মানুষের কল্যাণে কাজে লাগে।
আমি এমন একটি জিনিস বানালাম যেটা বানানোর পেছনে কোনো কল্যাণ চিন্তা নেই বা সেটা সমাজ বা দেশের কোনো উপকার করতে পারে না, তাহলে লাভ কী! যেমন, আমি প্রোগ্রামিং করে এমন একটি অনলাইন গেম বানালাম যেটার প্রতি আসক্ত হয়ে কিশোর-তরুণদের নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে। এতে হয়তো অর্থ উপার্জন হবে, কিন্তু নৈতিক মানদণ্ডে আমি ব্যর্থই থেকে যাব। তাই আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি—আমি যেন আমার মেধাকে মানবকল্যাণে ব্যবহার করতে পারি।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]