আর এ কাজটা আপনি করতে পারেন আপনার পছন্দমতো যে-কোনো পন্থায়। যেমন, দিনের যে-কোনো এক বেলায় ভাত/ রুটির বদলে আলু খেয়ে অথবা প্রতিবেলায় ভাত/ রুটির পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে সেখানে আলুকে জায়গা করে দিয়ে।
সুস্বাস্থ্য আনে আলু
স্থূলতা রোধ : আলুতে স্নেহজাতীয় উপাদান (ফ্যাট), শর্করা এবং খাদ্যবল (ক্যালরি) চাল ও গমের চেয়ে অনেক কম। তাই যারা স্থূলদেহী কিংবা মুটিয়ে যাওয়ার ভয়ে ভীত অথবা কায়িক শ্রম খুব কম করেন এবং সে কারণে কম ক্যালরি গ্রহণ করতে চান, তাদের জন্যে ভাত বা আটার বদলে আলু খাওয়া ভালো। কারণ, সমপরিমাণ আলুতে শর্করার পরিমাণ চাল/ গমের এক-তৃতীয়াংশ। এ-ছাড়াও চাল ও গমের তুলনায় আলুতে ফ্যাটের পরিমাণ অনেক কম। আলু থেকে উৎপন্ন ক্যালরি চাল/ গম থেকে উৎপন্ন ক্যালরির প্রায় তিনভাগের একভাগ।
বিভিন্ন রোগ ও ক্যান্সার প্রতিরোধক : প্রায় ৬০ ধরনের ফাইটোকেমিক্যাল ও ভিটামিনের সন্ধান পাওয়া গেছে আলুতে, যা হৃদরোগ, শ্বাসতন্ত্রের রোগ এবং দু-এক ধরনের ক্যান্সারের প্রতিরোধক হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।
রক্তচাপ কমায় : যুক্তরাজ্যের ইনস্টিটিউট অব ফুড রিসার্চ-এর বিজ্ঞানীরা কোকোয়ামিনস নামের এক ধরনের উপাদানের সন্ধান পেয়েছেন আলুতে। এটি রক্তচাপ কমাতে সক্ষম। এক ধরনের চীনা ভেষজ গাছ ছাড়া এ উপাদান আর কোথাও পাওয়া যায় বলে বিজ্ঞানীদের জানা ছিল না।
তারুণ্য ধরে রাখে : আলুতে আছে নানা ধরনের ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট, যা এন্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবেও কাজ করতে পারে। এন্টি-অক্সিডেন্ট হলো এমন একটি রাসায়নিক উপাদান যা মুখের বলিরেখা কমায়, বয়সের ছাপ পড়তে বাধা দেয় সর্বোপরি তারুণ্যকে দীর্ঘস্থায়ী করে। দেহকোষকে কর্মক্ষম রাখতে পারে দীর্ঘদিন। শরীর থাকে সজীব ও তরুণ। এন্টি-অক্সিডেন্ট ক্যান্সার প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখে।
এ-ছাড়া আলুতে রয়েছে ভিটামিন সি। সাধারণত, রান্না করা হলে ভিটামিন সি গুণাগুণ হারিয়ে ফেলে। তবে পুষ্টিবিদদের মতে, ঢাকনা দিয়ে ঢেকে খোসাসহ সেদ্ধ করলে আলুর ভিটামিন সি প্রায় অক্ষত থাকে। ভিটামিন বি৬ও পাওয়া যায় আলুতে। মস্তিষ্ক ও দেহকোষ তৈরিতে এবং স্নায়ুতন্ত্রের সক্ষমতায় ভিটামিন বি৬-এর ভূমিকা রয়েছে। উল্লেখ্য, ভিটামিন সি চাল বা গমে নেই।
আলু সহজপাচ্য, হজমে কোনো অসুবিধা হয় না। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে আলুকে প্রধান খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে তাই কোনো সমস্যা নেই- এমনই অভিমত পুষ্টিবিদদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, মেদস্থূল মানুষদের স্বল্প ক্যালরিযুক্ত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। সেদিক থেকে আলু বেশ ভালো আর উপযোগী একটি খাদ্য। ডায়াবেটিক রোগী ছাড়া আর কারো ক্ষেত্রে ভাতের বিকল্প হিসেবে আলু খাওয়ায় কোনো সমস্যা নেই। ভাত বা রুটির পাশাপাশি যিনি যেভাবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন সেভাবে আলু খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
সমৃদ্ধ হবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) কন্দাল ফসল গবেষণা কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ হোসেন জানান, সাধারণভাবে আলুর হেক্টর প্রতি উৎপাদন প্রায় ২৫ টন। উৎপাদন খরচ প্রায় এক লাখ টাকা আর এর বিক্রয় মূল্য সোয়া দুই লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা। অর্থাৎ হেক্টর প্রতি মুনাফা সোয়া এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা। অন্যদিকে ধানে হেক্টর প্রতি উৎপাদন প্রায় চার টন। খরচ ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা ও বিক্রয়মূল্য ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। অর্থাৎ মুনাফা ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। এর মানে আলু চাষে ধানের তুলনায় দ্বিগুণ-তিনগুণ মুনাফা।
নিয়মিত আলু খেয়ে আপনি বাজারে যে চাহিদার সৃষ্টি করবেন তা কৃষককে উৎসাহিত করবে আলু চাষে। আর কৃষকের আর্থিক সমৃদ্ধির মাধ্যমে সমৃদ্ধ হবে জাতীয় অর্থনীতি।
অর্থ সাশ্রয় : যারা স্থূলদেহী বা স্থূলতার আশঙ্কায় ভুগছেন কিংবা প্রতিদিন যে পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করা উচিত তার চেয়ে বেশি গ্রহণ করে ফেলছেন, রসনা-সংযমের অভাবে নয়তো দৈহিক পরিশ্রম স্বল্পতার কারণে চাইছেন খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করতে, তারা অবলীলায় আলুকে বেছে নিতে পারেন চাল বা আটার বিকল্প হিসেবে। আবার এর মাধ্যমে আপনি অর্থ সাশ্রয়ও করতে পারেন।
যেমন, আপনি যদি আপনার পরিবারের সবাইকে নিয়ে মাসে ১৫ কেজি চালের পরিবর্তে ১৫ কেজি আলু খান (দৈনিক আধা কেজি হিসেবে) তাহলে যে অর্থ আপনি সাশ্রয় করতে পারবেন সেটি পরিবারের জন্যে সঞ্চয় করতে পারেন অথবা এ অর্থ দিয়ে মাসে চার-পাঁচ ডজন ডিম নয়তো ছয়-সাত লিটার দুধ বেশি খেতে পারেন। অর্থাৎ আরো পুষ্টিসমৃদ্ধ করতে পারেন নিজেকে, নিজের পরিবারকে। কিংবা দান করতে পারেন আপনার মাটির ব্যাংকে, যা সঙ্ঘবদ্ধভাবে ব্যয় হবে বঞ্চিতের সেবায়।
গত কয়েক বছরে একাধিকবার বন্যা ও সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ধানের পাতার রোগ, আন্তর্জাতিক বাজারে চাল ও খাদ্য সংকট, চাল নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার যন্ত্রণা, সর্বোপরি চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি নানা ঘটনা আমাদের যে বার্তাটি দিতে চাইছে সেটি হলো- শুধু ধান/ গমের ওপর নির্ভর করে থাকার মতো নির্বুদ্ধিতার দিন শেষ। চাই বিকল্প সন্ধান।
তাছাড়া আলু চাষে অল্প জমিতে অধিক ফলন এবং অধিক মুনাফা, যা আমাদের মতো উন্নয়নশীল, ঘনবসতিপূর্ণ এবং ক্রম-হ্রাসমান কৃষি জমিসম্পন্ন দেশের জন্যে অত্যন্ত উপযোগী।
তাই সুস্বাস্থ্যের জন্যে, অর্থ সাশ্রয় করতে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতিতে পরিণত হতে এবং সর্বোপরি জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি আনতে ভাত/ আটার পাশাপাশি প্রধান খাদ্য হিসেবে আলুকে স্থান দেয়ার বিকল্প নেই। আর দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় এ সামান্য রদবদলটুকু করে অনেকগুলো অর্জনকে আমরা আনতে পারি আমাদের হাতের মুঠোয়।
মিষ্টি আলু : বহুমুখী পুষ্টির অনন্য উৎস
ভাবুন তো, জনমানবহীন বিস্তৃর্ণ মরুভূমিতে আটকে পড়েছেন আপনি একা। কখন উদ্ধার পাবেন, তা-ও জানা নেই। উদ্ধারকারী দল এসে পৌঁছাতে যত দেরিই হোক-একটি খাবার কিন্তু আপনাকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়াবিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. স্ট্যানলিকেস বলেন, সে খাবারটি হলো মিষ্টি আলু, যা একাই আপনাকে সর্বোচ্চ সময় বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম। বহুমুখী পুষ্টিবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এ খাদ্যটি তার স্বাস্থ্যপ্রদ গুণের কারণে পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই প্রধান খাদ্য হিসেবে বিবেচিত। মিষ্টি আলু স্বাস্থের জন্যে অনেক দিক থেকেই উপকারী। প্রতি গ্রাম মিষ্টি আলুতে রয়েছে গোল আলু বা অন্যান্য আলুর চেয়ে বেশি পরিমান আয়রন ।ভিটামিন এ, ভিটামিন ই, সেইসাথে আশঁ এবং বিটাক্যারোটিনের মতো এন্টি-অক্সিডেন্টের এক দারুন উৎস এ মিষ্টি আলু। উল্লেখ্য, বিটা ক্যারোটিনের সাহায্যে শরীর নিজেই ভিটামিন তৈরি করতে পারে।
পুষ্টিমান নিশ্চিত করতে শুষ্ক ও শীতল স্থানে মিষ্টি আলু সংরক্ষন করুন। আর কাঁচা মিষ্টি আলু কখনোই ফ্রিজে রাখবেন না। তাতে এর ফ্লেবার নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
আলু চাল ও গমের খাদ্য উপাদানের তুলনা | |||
খাদ্য উপাদান (২৫০ গ্রাম) | আলু | চাল | গম |
খাদ্যবল (কিলোক্যালরি) | ২৪২.৫ | ৮৬৫ | ৯০০ |
কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা (গ্রাম) | ৫৬.৫ | ১৯৮ | ১৭৪ |
ফ্যাট বা স্নেহ (গ্রাম) | .২২৫ | ১.০ | ৪.৩ |
প্রোটিন বা আমিষ (গ্রাম) | ৪ | ১৬ | ৩০ |
ফাইবার বা আঁশ (গ্রাম) | ১.০৭৫ | ০.৫ | ৪.৮ |
ক্যালসিয়াম (মিলিগ্রাম) | ২৫ | ২৩ | ১২০ |
ফসফরাস (মিলিগ্রাম) | ১০০ | ৩৫৮ | ১০৬৫ |
আয়রন বা লৌহ (মিলিগ্রাম) | ২ | ৮ | ৮ |
ভিটামিন এ (মাইক্রোগ্রাম) | ৬০ | ০ | ৭৩ |
ভিটামিন সি | ১৪৩ | ০ | ০ |
তথ্যসূত্র : হেলথ এন্ড নিউট্রিশন, ডেইলি মেইল অনলাইন (১৬ আগস্ট, ২০০৯)