বাঙালি শিশুসাহিত্যিক, বাংলা মুদ্রণের পথিকৃৎ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন।
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে আজ বছরের ৩৫৪তম (অধিবর্ষে ৩৫৫তম) দিন। এক নজরে দেখে নিই ইতিহাসের এই দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা বিশিষ্টজনের জন্ম ও মৃত্যুদিনসহ আরও কিছু তথ্যাবলি।
১৭৯০ : আমেরিকায় প্রথম কটন মিল চালু হয়।
১৯২৫ : বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদ স্থাপিত হয়।
১৯৫৭ : সানফ্রান্সিসকো চলচ্চিত্র উৎসবে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘পথের পাঁচালী’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার লাভ করে।
১৯৭৪ : পর্তুগাল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে।
১৮৬৬ : পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঙালি সাংবাদিক ও সম্পাদক।
১৮৯০ : জারস্লাভ হেয়রভসকয়, নোবেলজয়ী চেক রসায়নবিদ ও অধ্যাপক।
১৯১৯ : খালেদ চৌধুরী, বাংলার প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব।
১৯১৫ : বাঙালি শিশুসাহিত্যিক, বাংলা মুদ্রণের পথিকৃৎ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
১৯৭৪ : প্রখ্যাত বাঙালি লেখিকা সীতা দেবী।
১৯৭৯ : বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী কমলা ঝরিয়া।
১৯৯০ : বাংলাদেশি সঙ্গীতশিল্পী মাহমুদুন্নবী।
১৯৯৬ : বিখ্যাত মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সেগান।
১৯৯৮ : নোবেলজয়ী ইংরেজ শারীরবিজ্ঞানী ও জৈবপদার্থবিদ অ্যালেন লয়েড হডজিকিন।
২০০৯ : রাগপ্রধান গানের প্রথম মহিলা বাঙালি শিল্পী, দীপালি নাগ।
২০১৪ : বাংলাদেশি জিনতত্ত্ববিদ, পেঁপে, রাবার, পাট এবং ছত্রাক জিনোম উদ্ভাবক মাকসুদুল আলম।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ দিবস (বাংলাদেশ)।
উপেন্দ্রকিশোর রায় ছিলেন বিখ্যাত বাঙালি শিশুসাহিত্যিক, বাংলা ছাপাখানার অগ্রপথিক। তিনি একাধারে লেখক চিত্রকর, প্রকাশক, শখের জ্যোতির্বিদ, বেহালাবাদক ও সুরকার ছিলেন। সন্দেশ পত্রিকা তিনিই শুরু করেন; যা পরে তার ছেলে সুকুমার রায় ও পৌত্র সত্যজিৎ রায় সম্পাদনা করেন। গুপি-গাইন-বাঘা-বাইন, টুনটুনির বই ইত্যাদি তার অমর সৃষ্টি। ‘বলরামের দেহত্যাগ’ তার অঙ্কিত একটি বিখ্যাত চিত্র।
জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬৩ সালের মে মাসে ময়মনসিংহ জেলার মসুয়া গ্রামে। বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে উপেন্দ্র ছিলেন তৃতীয়। পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল কামদারঞ্জন। পাঁচ বছর বয়সের সময় তার বাবা কালীনাথ রায় ওরফে শ্যামসুন্দর মুন্সীর কাছ থেকে নিকটাত্মীয় ময়মনসিংহের জমিদার হরিকিশোর চৌধুরী তাকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করে নতুন নাম রাখেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
সুপণ্ডিত জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় উপেন্দ্রকিশোরের শিক্ষাজীবন শুরু হয় এবং ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৮৮০ সালে বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। স্কুল জীবনেই তিনি চিত্রাঙ্কনে দক্ষতা অর্জন করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছুকাল অধ্যয়নের পর কলকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন এবং ১৮৮৪ সালে সেখান থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময় তিনি ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন এবং প্রখ্যাত সমাজসেবী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা বিধুমুখীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
সাহিত্যচর্চায় হাতেখড়ি ঘটে তরুণ বয়সেই এবং তৎকালীন শিশুকিশোর পত্রিকা সখা, বালক, সাথী, সখা ও সাথী, মুকুল ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৩ সালে ছাত্রাবস্থায় সখা পত্রিকায় তার প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়। সারা জীবনেই তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখেন। ছড়া, কবিতা, গান, গল্প, নাটক, বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ, রূপকথা, উপকথা, পৌরাণিক কাহিনী ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী রচনাসহ শিশুকিশোর সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় বিচরণ করে তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যের দিকনির্দেশকের ভূমিকা পালন করেন। স্বরচিত গ্রন্থে স্বঅঙ্কিত চমকপ্রদ নানা চিত্র সংযোজন উপেন্দ্রকিশোরের প্রকাশনার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
দেশবিদেশের গল্প, হাস্যকৌতুক, জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা ইত্যাদি লেখার পাশাপাশি নিজের আঁকা নানা বুদ্ধিদীপ্ত ছবি সংযোজনের মাধ্যমে বিখ্যাত শিশুতোষ মাসিক পত্রিকা সন্দেশকে তিনি তরুণ হূদয়ের যোগ্য একটি পত্রিকা হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।
শিশুকিশোরদের জন্যে রচিত উলেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো-
ছোটদের রামায়ণ, ছোটদের মহাভারত, সেকালের কথা, মহাভারতের গল্প, ছোট্ট রামায়ণ, টুনটুনির বই এবং গুপী গাইন বাঘা বাইন। বইগুলোর প্রচ্ছদ এবং ভেতরের ছবিও তিনি নিজেই অঙ্কন করেন।
এ ছাড়া বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘নদী’ কবিতার সঙ্গে সংযোজিত তার অঙ্কন বিশেষ প্রশংসা লাভ করে। চিত্রাঙ্কনে তিনি সচরাচর পাশ্চাত্য প্রথায় তেলরঙ ও কালিকলম ব্যবহার করতেন। জলরঙের ছবিতেও তিনি কুশলী ছিলেন।
উপেন্দ্রকিশোর তার প্রথম বই ছোটদের রামায়ণ-এর চিত্রমুদ্রণমানে অসন্তুষ্ট হয়ে ১৮৯৫ সালে বিলেত থেকে তখনকার দিনের আধুনিকতম যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে নিজেই একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৬ সালের দিকে স্টুডিও, ডার্করুম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে নানা রঙের হাফটোন মুদ্রণ বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন। প্রাচ্যে তখন এর কোনো চর্চা ছিল না, এমনকি পশ্চিমা বিশ্বেও তখন এ প্রযুক্তি প্রারম্ভিক পর্যায়ে মাত্র। গণিতে গভীর ব্যুৎপত্তি এবং সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির সাহায্যে উপেন্দ্রকিশোর এদেশে বসেই এ বিষয়ে অনেক নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। নানা ধরনের ডায়াফ্রাম তৈরি, রে-স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র নির্মাণ, ব্লক নির্মাণের ডায়োটাইপ ও রি-প্রিন্ট পদ্ধতির উদ্ভাবন তার মৌলিক অবদান।
পশ্চিমা দেশে তার উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ও মুদ্রণ প্রণালিসমূহ বেশ প্রশংসিত হয়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত পেনরোজেজ পিকটোরিয়াল অ্যানুয়াল পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় এ প্রসঙ্গে তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। উপেন্দ্রকিশোর প্রতিষ্ঠিত ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ কোম্পানির মাধ্যমেই ভারতবর্ষে প্রসেস-মুদ্রণ শিল্প বিকাশের সূত্রপাত ঘটে।
সঙ্গীতচর্চার প্রতিও তিনি অনুরক্ত ছিলেন। পাখোয়াজ, হারমোনিয়াম, সেতার, বাঁশি, বেহালা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাদনে তিনি দক্ষতা অর্জন করেন। তবে বেহালাই ছিল তার বিশেষ প্রিয়। আদি ব্রাহ্মসমাজের উৎসবসমূহে সঙ্গীতের সঙ্গে তার বেহালার বাজনা ছিল একটি বড় আকর্ষণ। পাশ্চাত্য সঙ্গীত সম্পর্কেও তিনি গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। বেহালা শিক্ষা এবং হার্মোনিয়াম শিক্ষা নামে তার দুটি বই রয়েছে।
নানামুখী যোগ্যতার সমাবেশ ঘটলেও উপেন্দ্র প্রধানত নির্মল আনন্দরসিক শিশুসাহিত্যিক রূপেই অধিক পরিচিত। এ শিশুসাহিত্য পরবর্তীসময়ে তার পারিবারিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়। কন্যা সুখলতা রাও ও পুণ্যলতা চক্রবর্তী এবং পুত্র সুকুমার রায় ও সুবিনয় রায় পরবর্তীকালে শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তার পৌত্র (সুকুমার রায়ের পুত্র)।
১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র: সংগৃহীত