বাঙালি ঐতিহাসিক, ছন্দবিশারদ ও রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ প্রবোধচন্দ্র সেন এর মৃত্যুদিন
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে আজ বছরের ২৬৩ তম (অধিবর্ষে ২৬৪ তম) দিন। এক নজরে দেখে নিই ইতিহাসের এই দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা বিশিষ্টজনের জন্ম ও মৃত্যুদিনসহ আরও কিছু তথ্যাবলি।
১৯৪৬ : প্রথম কান চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
১৯৯২ : আহসান মঞ্জিল জাদুঘর সাধারণ দর্শকদের জন্যে খুলে দেওয়া হয়।
১৮৩৩ : এর্নেস্তো তেওদরো মোনেতা, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ইতালীয় মানব-হিতৈষী।
১৯৫২ : শেখর বসু, প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি পরমাণু বিজ্ঞানী।
১৯৮৬ : বাঙালি ঐতিহাসিক, ছন্দবিশারদ ও রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ প্রবোধচন্দ্র সেন।
প্রবোধচন্দ্র সেন ছিলেন প্রখ্যাত বাঙালি ছান্দসিক, রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ ও ঐতিহাসিক। ঊনিশ শতকের যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ এবং সাংস্কৃতিক চেতনার ধারক ছিলেন তিনি।
জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৭ এপ্রিল অবিভক্ত বাংলার বর্তমানে বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার চুলতা গ্রামে। বাবা হরদাস সেন ও মায়ের নাম স্বর্ণময়ী সেন। প্রাথমিক পড়াশোনা গ্রামের পাঠশালা ও স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর তার স্কুল ও কলেজ জীবন অতিবাহিত হয় কুমিল্লা শহরে।
১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্সে নিয়ে বি.এ পাশ করেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে এম.এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। এম.এ পাশের পর তিনি রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর ও পরে হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন।
তার ইতিহাস প্রীতির মূলে ছিল স্বদেশপ্রেম। ছাত্রাবস্থায় তিনি অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন। রাজদ্রোহী সন্দেহে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ সরকার তাকে গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে অন্যান্য কারাবন্দীদের সাথে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পান।
ছন্দ নিয়ে প্রবোধচন্দ্রের উৎসাহ ও ঔৎসুক্য ছিল। ১৯২২ সালে কলেজে পড়ার সময়ে তিনি ‘বাংলাছন্দ’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন, যা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তেরর প্রশংসা ও সম্মতি লাভ করে ধারাবাহিকভাবে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার ছন্দবিষয়ক এই প্রবন্ধ পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং ‘ছান্দসিক’ বলে অভিহিত করেন।
পরে এ বিষয়ে প্রবোধচন্দ্র চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, কালিদাস রায়, যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখের স্বীকৃতি লাভ করেন। বাংলা ছন্দ বিষয়ক তার গ্রন্থগুলোর মধ্যে বাংলা ছন্দে রবীন্দ্রনাথের দান (১৯৩১), ছন্দোগুরু রবীন্দ্রনাথ (১৯৪৫), ছন্দ পরিক্রমা (১৯৬৫), ছন্দ-জিজ্ঞাসা (১৯৭৩), বাংলা ছন্দচিন্তার ক্রমবিকাশ (১৯৭৮), ছন্দ সোপান (১৯৮০), আধুনিক বাংলা ছন্দ-সাহিত্য (১৯৮০), বাংলা ছন্দে রূপকার রবীন্দ্রনাথ (১৯৮১), নূতন ছন্দ পরিক্রমা (১৯৮৫) প্রধান।
দীর্ঘ চৌষট্টি বছর প্রবোধচন্দ্র সেন ছন্দ-চর্চায় নিবিষ্ট ছিলেন এবং বাংলা ছন্দের আদ্যন্ত ইতিহাস বিজ্ঞানসম্মতরূপে রচনা করেন। বার বার তাকে বাংলা ছন্দের পরিভাষা পরিবর্তন করতে দেখা যায়। এর কারণ, তিনি বাংলা ছন্দের তিনটি রীতির অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যকে চূড়ান্তভাবে ধরে দিতে চেয়েছেন। জীবনের একটা বৃহৎ সময় তিনি ছন্দ-বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিতর্ক-আলোচনা শেষে বাংলা ছন্দের তিন রীতির নামকরণ করেন মিশ্রবৃত্ত, কলাবৃত্ত ও দলবৃত্ত।
বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে প্রবোধচন্দ্রের আগ্রহের মূলে ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় প্রমুখের স্বদেশপ্রীতি ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ‘স্বদেশী আন্দোলন’। এর সূত্র ধরে তিনি আকৃষ্ট হন বাংলার ভৌগোলিক ইতিহাসের প্রতি। তার রচিত ‘বাংলার জনপদ’ এরই একটি উদাহরণ। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘বাংলার ইতিহাস সাধনা’ বাংলার এক মূল্যবান হিস্টরিয়োগ্রফি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অবদানের জন্যে প্রবোধচন্দ্র সেন বিভিন্ন সময়ে অনেক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রফুল্ল-স্মৃতি পুরস্কার (১৯৬৯), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘বঙ্কিম পুরস্কার’ (১৯৭৫) ‘ভারতাত্মা কবি কালিদাস’ গ্রন্থের জন্যে, কেশবচন্দ্র গুপ্ত স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৮), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দেশিকোত্তম উপাধি (১৯৮০), কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি লিট (১৯৮৩), উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি লিট (১৯৮৩)। এশিয়াটিক সোসাইটি ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে তাকে মরণোত্তর ‘রবীন্দ্রশতবার্ষিকী স্মারক পদক’ প্রদান করে।
প্রবোধচন্দ্র সেন ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতনে মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র: সংগৃহীত