অর্থকষ্টে দিশেহারা এক যুবক। ঘরে ক্যান্সারে শয্যাশায়ী মা। টাকার অভাবে বোনের বিয়ে দিতে পারছে না। নেই ছোট ভাইয়ের পরীক্ষার ফি দেয়ার টাকাটাও।
একদিন সে আকুলভাবে প্রার্থনা করল, হে প্রভু! আমাকে এই কষ্ট থেকে পরিত্রাণ দাও। তার ডাকে সাড়া দিয়ে স্রষ্টা পাঠালেন এক দেবদূত। দেবদূত বলল, তোমাকে একটা জায়গার সন্ধান দিচ্ছি, ওখানে গেলে সাত কলসভর্তি সোনাদান পাবে। কিন্তু সে জায়গাটায় পৌঁছুতে তোমাকে পাড়ি দিতে হবে সাতটা নদী।
যুবক সেই দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল। কিছুদূর পর এক বিশাল নদী। পার হওয়ার জন্যে কেবল একটা নৌকা। কিন্তু যুবকের কাছে কোনো টাকা নেই। মাঝি বলল, তুমি তোমার হৃদয়ের একটি অংশ কেটে আমাকে দাও। আমি তোমাকে নদী পার করে দেবো।
যুবক তার হৃদয়ের একটা অংশের বিনিময়ে নদী পার হলো। বাকি ছয়টি নদীও সে পার হলো একইভাবে। গন্তব্যে পৌঁছে মালিক হয়ে গেল বিপুল ধন-সম্পদের। কিন্তু অসুস্থ মায়ের কথা তার আর মনে পড়ছে না। বিবাহযোগ্য বোন কিংবা পরীক্ষার্থী ছোট ভাইটার কথাও মনে পড়ছে না। কারণ সে তো ধনসম্পদের মালিক হতে গিয়ে হৃদয়টা বিক্রি করে দিয়েছে! যাদের ভালোর জন্যে সে এতটা কষ্ট করল শেষমেশ তাদের জন্যে করতে পারল না কিছুই।
আসলে হৃদয়ে যদি উষ্ণতা না থাকে তাহলে সবই বৃথা
ধরুন আপনি পরীক্ষায় ফার্স্ট হলেন, কিন্তু আপনার রেজাল্টে খুশি হওয়ার মতো কেউ নেই। আপনি কি আনন্দ পাবেন?
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়ে শুধু নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকলেন, মানুষের জন্যে কিছু করার কথা চিন্তাও করলেন না। আপনার জীবনে কি সত্যিকার অর্থে কোনো প্রাপ্তি থাকবে?
আপনার পরিবার। সবাই দূর থেকে দেখে ভাবছে, বাহ! কি সুন্দর হাসিখুশি পরিবার। কিন্তু পরিবারের মানুষদের সাথে আপনি দুর্ব্যবহার করেন। শারীরিকভাবে কাছাকাছি থেকেও মানসিকভাবে পরিবার থেকে অনেক দূরে চলে গেছেন আপনি। কারণ আপনি যখন মমতা দিতে পারবেন না তখন আপনিও একটা সময়ে মমতা যত্ন ভালবাসার অভাবে ভুগবেন। ধনদৌলত নিয়েও আপনি হয়ে যাবেন নিঃসঙ্গ, অসুখী।
আসলে মস্তিষ্ক মানুষকে মানুষ বানায় নি, মানুষকে সত্যিকার মানুষ বানিয়েছে হৃদয়। হৃদয়ে উষ্ণতা না থাকলে, মানে মমতা সহমর্মিতা সমমর্মিতা না থাকলে সবকিছুই হয়ে যায় অর্থহীন।
আবার মাথা ঠান্ডা না থাকলে হৃদয়ের উষ্ণতা কাউকে স্পর্শ করে না
ধরা যাক আপনার হৃদয় মমতা ও ভালবাসায় পরিপূর্ণ, কিন্তু মাথাটা ঠান্ডা রাখতে পারেন না। তখন কী হবে? আপনার সবচেয়ে প্রিয়জনদের কষ্টের কারণ হবেন আপনি নিজে। কারণ হুটহাট আপনার মাথা গরম হবে এবং আপনি দুর্ব্যবহার করবেন। আর দুর্ব্যবহারকারীদের মানুষ এড়িয়ে চলে। ফলাফল সেই বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতা!
সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাও আপনি হারিয়ে ফেলবেন যদি মাথাটাকে ঠান্ডা রাখতে না পারেন।
আসলে জীবনে চ্যালেঞ্জ আসতেই থাকবে। মাথা গরম করার নানান কারণও হয়তো দেখা দেবে বিভিন্ন সময়ে। তখন মাথাটাক ঠান্ডা রাখতে না পারলে আপনি হেরে যাবেন।
যারা সবসময় মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন তারাই পারেন প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে। মানুষের আনুকূল্যও তারাই পান। তাই মাথাটাকে ঠান্ডা রাখুন, তাহলেই আপনি আপনার হৃদয়ের ভাষা অন্যকে বোঝাতে পারবেন।
উষ্ণ হৃদয় আর ঠান্ডা মাথা একজন মানুষকে কী দিতে পারে?
উষ্ণ হৃদয় আর ঠান্ডা মাথা- এ দুইয়ের সমন্বয়ে মানুষ হয় অনন্য মানুষ। আর পৃথিবী অনন্য মানুষদেরকেই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
যেমন- আমাদের নবী-রসূল, মুনী-ঋষিরা। তারা যদি কেবল হৃদয়ের উষ্ণতাই ধারণ করতেন তাহলে কি মানুষকে কিছু দিতে পারতেন? পারতেন না। ঠান্ডা মাথায় তারা তাদের মেধা ও হৃদয়ের শক্তিকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করেছেন বলেই মানুষের অন্তরে ঠাঁই পেয়েছেন।
আসলে উষ্ণ হৃদয় আর ঠান্ডা মস্তিষ্কের সম্মিলনেই অর্জন পূর্ণতা পায়। তিনি তখন পারেন নিজের পাশাপাশি অন্যের কল্যাণ করতে। অনেক কিছু দিতে পারেন নিজেকে, পরিবারকে, সমাজকে এবং দেশকে।
হৃদয় কখন উষ্ণ হবে আর মাথা ঠান্ডা?
উপায়টা খুব সহজ- মেডিটেশন! নিয়মিত দুই বেলা মেডিটেশন চর্চায় ধীরে ধীরে আপনি পরিণত হবেন উষ্ণ হৃদয় এবং ঠান্ডা মস্তিষ্কের সম্মিলনে এক অনন্য মানুষে। নিজেকে অনন্য মানুষে উত্তরণের এর চেয়ে সহজ উপায় আর নেই।
নিজের জীবনে একটু এক্সপেরিমেন্ট করেই দেখুন! মাত্র ৩ মাস দুবেলা মেডিটেশন চর্চা করুন। দেখবেন আপনার জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আপনি আগের চেয়ে শান্ত থাকতে পারছেন; বিশ্বজনীন মমতায় পরিপূর্ণ হচ্ছে আপনার অন্তর।
মেডিটেশনের পাশাপাশি অটোসাজেশন চর্চায় পাবেন ইতিবাচক ফলাফল। আপনার জন্যে বাছাইকৃত কয়েকটি অটোসাজেশন-
১। একটি উষ্ণ হৃদয় এবং একটি ঠান্ডা মস্তিষ্কের সম্মিলনেই হয় অনন্য মানুষ। আমি এই অনন্য মানুষের পথ অনুসরণ করবো।
২। মস্তিষ্ক মানুষকে মানুষ বানায় নি, হৃদয় মানুষকে সত্যিকার মানুষ বানিয়েছে। আমার হৃদয় বিশ্বজনীন মমতায় পরিপূর্ণ। তাই আমি অনন্য।
৩। প্রো-একটিভ ব্যক্তি যেকোনো পরিস্থিতিতে সবসময় ঠান্ডা মাথায় নিজস্ব মূল্যবোধের আলোকে বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেন। আমি সবসময় প্রো-একটিভ থাকবো।
উপায় তো জানলেন! এবার শুরু হোক অনুশীলন
আসলে মেডিটেশন মানুষকে ভালো মানুষে রূপান্তরিত করে। আর মানুষ ভালো হলে ভালো হয় দেশ। ভালো মানুষ হওয়ার অবিরাম চেষ্টাতেই প্রতিফলিত হয় দেশপ্রেম।
তাই আত্মোন্নয়নের অভিযাত্রায় আলসেমিকে কখনো প্রশ্রয় দেবেন না। টানা অনুশীলনেই জীবনে আসে পরিবর্তন। আর তখনই সম্ভব হয় নিজের পাশাপাশি পরিবার, সমাজ এবং গোটা দেশের উন্নয়ন। কারণ একটি দেশের সবাই যদি সকল পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা আর হৃদয়কে উষ্ণ রাখার গুণ অর্জন করে তাহলে সেদেশের চেহারাটাই পাল্টে যায়।
তাই আসুন, আমরা যে বয়সীরই হই- জেন-জি, বা ওয়াই, তরুণ কিশোর যুবক প্রবীণ, সবাই যার যার জায়গা থেকে নিজেকে বদলাতে চেষ্টা করি। নিজের কাজ করি সবচেয়ে ভালোভাবে। তাহলেই আমরা হব ভালো মানুষ; দেশ হবে ভালো দেশ, স্বর্গভূমি বাংলাদেশ।