1. [email protected] : আরএমজি বিডি নিউজ ডেস্ক :
  2. [email protected] : adminbackup :
শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:৩৬ পূর্বাহ্ন

ঋণের দুষ্টচক্রের ভয়াবহতা আমি দেখেছি

  • সময় সোমবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৪
  • ৮৩ বার দেখা হয়েছে

ঋণের দুষ্টচক্রের ভয়াবহতা আমি দেখেছি

মো. ইমন বিশ্বাস

ইতিহাস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মা-বাবা ও তিন ভাইকে নিয়ে আমাদের পরিবার। পরিবারের ভরণপোষণ বাবা একাই করতেন। বাবা ছিলেন একজন দিনমজুর। কখনো মাছ ধরে, কখনো অন্যের জমিতে কাজ করে তার আয় রোজগার হতো। তাই বাবার পক্ষে পরিবারের সবার মুখে প্রতিদিন তিন বেলা খাবার তুলে দেয়া সহজ ছিল না।

আমরা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। অভাব-অনটন লেগেই থাকত। এভাবে আর কতদিন চলে? হয়ে গেল একগাদা ঋণ। বাড়ি ভাড়া বাকি, দোকানে চাল-ডালের টাকার ঋণ, এই ঋণ, সেই ঋণ করে বাবা একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। পরিবারে সবসময় ঝগড়া, কথা কাটাকাটি এবং অশান্তি লেগেই থাকত। মাঝে মধ্যে তো মা আমাদেরকে নিয়ে নানা বাড়ি চলে যেতেন। আমরা ছোট ছিলাম। একবার মা বড় ভাইকে নানা বাড়িতে রেখে দিলেন। বাবা ঋণের চাপে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হলেন। পাড়ি জমালেন ঢাকায়।

উদ্দেশ্য একটাই—যেভাবে হোক ঋণ পরিশোধ করতে হবে। কিন্ত ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! আমার বাবার সেই আশাও পূরণ হলো না। খেয়ে না খেয়ে থাকতে হলো ঢাকায়। গ্রামের বাড়িতে আর ফেরা হলো না। তাই সপরিবারে চলে এলাম নানা বাড়ি। সেই ঋণ পরিশোধের তাগিদে বাবা আবার নতুনভাবে শুরু করলেন। এবারও তিনি হতাশ হলেন। ঋণের দায়ভার থেকে তিনি মুক্তি পেলেন না। বরং পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে লাগল। এদিকে আমার বড় দুই ভাই লেখাপড়া ছেড়ে ভবঘুরে হয়ে বেড়ানো শুরু করল।

হঠাৎ করে বড় ভাই বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেল। মেজো ভাই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ল। আমাকে বাবা কাজে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মা দিতে চান নি। মা আমাকে পড়তে উৎসাহ দিতেন এবং বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখাতেন। কোনোদিন না খেয়ে, কোনোদিন শুধু পান্তাভাত বা কলা-রুটি খেয়ে থাকতে হতো। কিন্তু পড়ালেখার প্রতি আমার আগ্রহ কমে নি। এভাবে চলতে চলতে ঋণের চাপে পরিবারটা একদম ভেঙে গেল। পরিবার বলতে আর কিছুই রইল না। এরই মধ্যে আমি অষ্টম শ্রেণি পাশ করে ফেললাম। কিন্তু এরপর কী করব বুঝতে পারছিলাম না।

আমাদের গ্রাম থেকে একজন কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তিনি আমাকে সেখানে ভর্তি হওয়ার জন্যে বললেন। আমিও ভাবলাম এবার ভালো কিছু একটা হতে পারে। নবম শ্রেণিতে কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে ভর্তি হওয়ার একটি চমৎকার সুযোগ পেলাম। মা কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন। মা আমাকে সবসময় বলতেন, বাবা! আমার যদি সামর্থ্য থাকত আমি তোমাকে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াতাম। এখন মনে হয়, সৃষ্টিকর্তা মায়ের সেই আশা পূরণ করেছেন।

ছোটবেলা থেকে যে-সব প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাববোধ করেছি, তার সবই এই স্কুলে পেলাম। বরং প্রত্যাশার চেয়েও বেশি পেয়েছি। পেলাম আদর্শ শিক্ষকদের। এখানকার প্রত্যেকটা নিয়মকানুন আমাকে অভিভূত করল। নতুনভাবে নিজেকে উপলদ্ধি করতে শুরু করলাম। কোয়ান্টাম মেথড কোর্স করার পর থেকে আমার জীবন নতুন মোড় নিল।

আসলে প্রত্যেকের জীবনে একটা টার্নিং পয়েন্ট থাকে। আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট ছিল কোয়ান্টাম মেথড কোর্স। নিয়মিত মেডিটেশন করতে লাগলাম। মনছবি ঠিক করলাম। আর বুঝে গেলাম কীভাবে জীবনকে সাজাতে হয়। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও আমার ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। তাই দুইটাতেই ভালো করার চেষ্টা করতাম। জাতীয় পর্যায়ের খেলা ও এসএসসি পরীক্ষা যখন একসাথে চলে এলো, আমি রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম। কী করব? পরক্ষণেই নিজের ওপর বিশ্বাস রাখলাম, আমি পারব, আমাকে পারতেই হবে। পরীক্ষা ও খেলা দুইটাতেই ভালো করলাম। পরীক্ষায় বৃত্তিও পেলাম। ফলে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল।

জীবন শুরু করলাম আবার নতুন উদ্যমে। এবার লক্ষ্য ঠিক করলাম আরো ভালো কিছু করার। কিন্তু চলে এলো করোনা মহামারি। পড়ালেখায় বেশ খানিকটা ছেদ পড়ল। পরীক্ষা হলো সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। প্রস্তুতিও নিলাম তাড়াহুড়ো করে। ভালো কিছু হবে বলে মনে আশা ছিল। আশা পূরণ হলো। জিপিএ-৫ পেলাম।

এবার মনে প্রশ্ন জাগল, কোচিং কোথায় করব? সামনে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা। অনেক বন্ধু ঢাকায় চলে গেল কোচিং করতে। কেউ কেউ বাড়ি গেল নিজের মতো করে প্রস্তুতি নিতে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ক্যাম্পাসেই থেকে যাব। শুরু করলাম প্রস্তুতি।

কিছুদিন পরই আমি কিছুটা অসুস্থ হলাম। তিন মাস তেমন কোনো পড়ালেখা করতে পারি নি। পরীক্ষা চলে এলো। কী আর করব? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। ইংরেজি লিখিত পরীক্ষায় এক নম্বরের জন্যে চান্স পেলাম না। মন ভেঙে গেল। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। তাহলে আমি কি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় হেরে যাব? শিক্ষকেরা উৎসাহ দিলেন, আবার নতুন উদ্যমে শুরু করতে বললেন। পরের পরীক্ষাগুলো ভালো করতে হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ৩৩৩ তম স্থান অর্জন করলাম। আলহামদুলিল্লাহ!

এসএসসি পরীক্ষায় বৃত্তি, এইচএসসি-তে জিপিএ-৫ এবং নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া পর্যন্ত সকল অর্জন সম্ভব হয়েছে কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের কারণে। আসলেই একটি সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে যদি প্রয়োজনীয় সুবিধা দেয়া হয়, তাহলে সে-ও বড় কিছু করতে পারে। এর দুর্দান্ত দৃষ্টান্ত বোধহয় আমি নিজেই। আর আমার এই সাফল্যের অন্যতম কারণ হলো নিয়মিত মেডিটেশন। মনছবি মেডিটেশনে জীবনের লক্ষ্য অবলোকন করছি ক্লাস নাইন থেকে। তাই ‘মনছবি মেডিটেশন’ আমাকে বাকি সবার থেকে এগিয়ে রেখেছে। পরীক্ষা সবাই দেয়। কেউ ভালো করে আবার কেউ খারাপ করে। আসলে এই ভালো ও খারাপ ফলাফলের পেছনে রয়েছে মনছবির ক্ষমতা। সুনির্দিষ্ট মনছবি থাকলে সাফল্য আসবেই।

এখন আমি নিজেকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখি। বাঁচাতে চাই ঋণ-কিস্তির দাবানলে পড়া আমার পরিবারকে। কারণ এর ভয়াবহতা আমি দেখেছি। ঋণের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে সমাজকে সচেতন করতে চাই। কারণ গ্রামের সাধারণ মানুষগুলো এ সম্পর্কে একদম সচেতন নয়। তারা প্রতিনিয়ত ঋণ করে বিপদ ডেকে আনছে নিজের এবং তার পরিবারের জীবনে। আর চাই একজন আদর্শ মানুষ হতে। করতে চাই দেশ ও মানুষের সেবা। এ সকল স্বপ্ন আমাকে দেখতে শিখিয়েছে আমার প্রিয় কোয়ান্টাম, যার সংস্পর্শে এসে লাভবান হয়েছে বিভিন্ন জাতিধর্মবর্ণের মানুষ। সেইসাথে আমিও।

আর হ্যাঁ, আমি তো বেশ বড় হয়েই এখানে এসেছিলাম। তাই বাড়ি থেকে দূরে থাকা, নিজ এলাকার বাইরে থাকা আমার জন্যে একটু কষ্টকর ছিল। কিন্তু ক্যাম্পাসের শিক্ষকেরা এত ভালো যে, আমি তাদেরকে নিজের মা-বাবার মতো শ্রদ্ধা করতাম। তারা আমাকে আগলে রেখেছিলেন নিজের মা-বাবার মতো করে। তাই একটা নতুন পরিবার পেয়েছি। এই কয়েক বছর বেশ ভালোভাবেই থেকেছি। আমার জীবনে সাফল্যের এ ফল্গুধারা যেন বহমান থাকে এজন্যে আমি দোয়াপ্রার্থী। আরো বড় সাফল্য অর্জন করতে চাই। সবকিছুর জন্যে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই।

[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]

শেয়ার করুন

এই শাখার আরো সংবাদ পড়ুন
All Rights Reserved © rmgbdnews24.com