এখানকার শিক্ষক-ছাত্র প্রায় সবাই বন্ধুত্বপূর্ণ। একবার আমরা পদার্থবিজ্ঞানের সুজন মন্ডল স্যারের জন্মদিন পালন করেছিলাম। আগে থেকে জানতাম না কবে তার জন্মদিন, সেদিনই সন্ধ্যায় জানতে পারি। এখন স্যারকে কী উপহার দেই? আমাদের ক্যাম্পাসে বাইরের কোনোকিছু নিয়ে আসা যেত না। তবু খুঁজে দেখলাম আমাদের এক বন্ধুর কাছে সুন্দর একটি কলম আছে। আমরা ঠিক করলাম এই কলমটাই স্যারকে উপহার দেবো। স্যার ক্লাসে আসার পর সবাই স্যারকে উইশ করলাম। স্যারের জন্মদিন নিয়ে বন্ধু আরমান একটি প্রবন্ধ লিখেছিল। সেটা পাঠ করে শোনানো হলো। বন্ধু জেমি আর সুদীপ্ত গান গাইল। ওরা খুব ভালো গাইতে পারত। স্যার যে সেদিন কী খুশি হয়েছিলেন! স্যারের ভাষ্যমতে এটা ছিল প্রথমবারের মতো তার কোনো জন্মদিন উদযাপন! স্যার আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে পড়াশোনার পর অন্য কোথাও ক্যারিয়ার না করে কোয়ান্টাম ও কোয়ান্টাদের ভালবেসে এই স্কুলে পড়ানো শুরু করেন। কোয়ান্টামের এই মানুষগুলোকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না।
আমাদের কলেজে প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইয়েরা এসে পড়াতেন। ভালোভাবে পড়াশোনা করতে উৎসাহ দিতেন।
আমি নিয়মিত মেডিটেশন করতাম। সাপ্তাহিক আত্ম উন্নয়নমূলক প্রোগ্রাম সাদাকায়নে অংশ নিতাম। ইচ্ছে ছিল চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে পড়ব। হয়তো তার জন্যে যে-রকম পরিশ্রম করা প্রয়োজন ছিল, তা করি নি। তাই সুযোগ পাই নি। তবে আলহামদুলিল্লাহ! গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছি। আমি এখানে ভালো আছি।
এখন আমি নিজেকে এমন একটি অবস্থানে নিয়ে যেতে চাই যাতে আমার মা-বাবা গর্ববোধ করেন। আমার বড় একটা স্বপ্ন আছে। আমাদের দেশে শহর অঞ্চলগুলোতে এমন লক্ষ লক্ষ শিশু আছে যারা পড়াশোনা কিংবা পোশাক তো দূরের কথা, ঠিকমতো খাবারই পায় না। তাদের জন্যে কিছু করতে চাই।
আমার সবচেয়ে অবাক লাগে গুরুজী দাদুকে দেখে। একজন মানুষ কীভাবে এরকম একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে এত বড় একটা কার্যক্রম চালাচ্ছেন! তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এত বড় একটা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়েও তার কথাবার্তা, আচার-আচরণ, পোশাক দেখে কখনো বোঝার উপায় নেই যে, তিনি এত বড় একজন মানুষ। তার সবকিছুই সাধারণ। নেই কোনো বডিগার্ড! নিজে পায়ে হেঁটে অনেক উঁচু উঁচু পাহাড়ে উঠেন। কীভাবে সম্ভব তার মতো হওয়া, বুঝি না! সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করি, কোয়ান্টাদেরকে তিনি আরো বহুদিন এভাবেই ভালবাসা দিয়ে যাক।
আমাদের জন্যে সপ্তাহের সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিল শুক্রবার। এদিন ভোরবেলায় উঠে কেউ গ্রুপ করে হাঁটতে যেতাম, কেউ যেতাম পাহাড়ি আলু তুলে আনতে, কেউ-বা মাছ ধরতাম। আমিও অনেকবার গিয়েছিলাম এসবে। অনেকে মিলে একসাথে এসব কাজের যে আনন্দ, তখনকার অনুভূতিগুলো আসলে বলে বোঝানো সম্ভব না। দাবা, কেরাম খেলার সুযোগ ছিল এদিন। এছাড়া মাঝে মধ্যে গুরুজী দাদু আসতেন সাদাকায়ন করানোর জন্যে। আমরা সবাই সেখানে অংশগ্রহণ করতাম।
আমি প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করেছিলাম আমার উপজেলায়। সেখানে অনেক শিক্ষক আছেন যারা ক্লাসে কোনোমতে পড়াতেন। অন্য কোনো উপায় না থাকায় শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে তাদের কাছেই যেত প্রাইভেট পড়তে। আমার আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকার কারণে আমি প্রাইভেট পড়তে যেতে পারি নি। যেটা নিয়ে আমি অনেক দুশ্চিন্তায় ছিলাম।
কিন্তু কোয়ান্টামে যাওয়ার পর আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পরিবেশ দেখলাম। সেখানে শিক্ষকরা আমাদের ক্লাসে বোঝাতেন, না বুঝলে কয়েকবার বোঝাতেন। প্রয়োজনে আলাদা করে বোঝাতেন, তা-ও না বুঝলে কীভাবে বোঝানো যায়, কীভাবে শিক্ষার্থীরা বুঝবে, সেটা নিয়ে তাদের আগ্রহ এবং চিন্তা বেশি থাকত। রাতে পড়ার সময় তারা আসতেন, তখন যার যেটা সমস্যা সেটা স্যারদের থেকে জেনে নিতাম।
এই স্কুলে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ক্রামা—সকল ধর্মের শিক্ষার্থীরা একসাথে খাওয়া-দাওয়া করছে, একসাথে পড়াশোনা করছে, একসাথে খেলাধুলা করছে, একসাথে থাকছে, যেটা আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি।
সত্যি বলতে কোয়ান্টাম আমার জন্যে একটা সৌভাগ্য। যার কারণে আমি জীবনের অর্থ বুঝতে পেরেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছি এবং নিজের জীবনকে আরো উন্নত করার সুযোগ পেয়েছি, যা আমার এলাকায় থেকে সম্ভব ছিল না।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]