1. [email protected] : আরএমজি বিডি নিউজ ডেস্ক :
বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:২৬ পূর্বাহ্ন

এই স্কুলই ছিল আমাদের দুই ভাইয়ের একমাত্র ভরসা

  • সময় রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪
  • ৩৯ বার দেখা হয়েছে

এই স্কুলই ছিল আমাদের দুই ভাইয়ের একমাত্র ভরসা

ইমরান শাহেদ

মার্কেটিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের গ্রামের নাম কাঞ্চননগর। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার একটি গ্রাম। আমি গ্রামের স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। বাবা কৃষিকাজ করতেন। মা-বাবা, বড় বোন আর আমরা দুই ভাই—আমাদের অভাবের জীবনটা সুখ-দুঃখের মধ্যেই কাটছিল।

আমরা দুই ভাই প্রাইমারি স্কুল শেষ করে হাই স্কুলে ওঠার পর বাবার পক্ষে আমাদের খরচ চালানো কষ্টকর হয়ে যায়। কারণ এসময় বাবা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবার এই অসুস্থতা অনেক আগে থেকেই ছিল। কিন্তু আমাদের সামনে প্রকাশ করতেন না। বাবা ডাক্তার দেখালেন। ডাক্তার বললেন, বাবার ক্যান্সার হয়েছে। দ্রুত বাবাকে চট্টগ্রামে নেয়া হলো চিকিৎসার জন্যে। চলতে থাকল বিভিন্ন রকম চিকিৎসা। একমাসের মধ্যেই বাবা মারা গেলেন। আসলে বাবার যে ক্যান্সার হয়েছিল আমাদেরকে তা জানানো হয় নি। বাবার ক্যান্সারের কথা আমরা জানলাম বাবার মৃত্যুর পরে।

বাবা থাকা অবস্থায় আসলে তার কদর বুঝি নি। কিন্তু মনে হলো হঠাৎ করে মাথার ওপর থেকে ছায়া চলে গেল। বড় বোন কলেজে আর আমি নবম শ্রেণিতে উঠলাম। আমার ছোট ভাই সপ্তম শ্রেণিতে। আমাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব হচ্ছিল না।

বাবা মারা যাওয়ার পাঁচ মাস পর আমার ছোট আরেকটি ভাই জন্ম নেয়। আমার মা তখন কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না—কীভাবে আমাদের লেখাপড়া করাবেন, সংসার চালাবেন।

যে ডাক্তার আমার বাবার চিকিৎসা করতেন, তিনি পারিবারিকভাবে আমাদের চিনতেন। তিনি আমার দাদুকে বললেন যে, তার একটা পরিচিত স্কুল আছে। ডাক্তার আঙ্কেল আমাদের কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরে জানতে পারলাম তিনি কোয়ান্টামের সাথে আগে থেকেই জড়িত ছিলেন। আমার দাদু অনুমতি দিলে মামা আমাদের দুই ভাইকে কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে নিয়ে এলেন।

আমরা দুই ভাই একসাথে ভর্তি হলাম। আমি নবম শ্রেণিতে আর আমার ছোট ভাই সপ্তম শ্রেণিতে। পরবর্তীকালে আমার ছোট ভাইও এখান থেকে পাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রথমদিকে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছিল। ভোরে ঘুম থেকে ওঠা আমার জন্যে খুব কষ্টের ছিল।

আমাকে সহশিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে খো খো খেলা দেয়া হয়। এটা খেলতে প্রচুর দম লাগে। আর অনেক দৌড়াতে হয়। কিন্তু আমি পরিশ্রম করতে অভ্যস্ত ছিলাম না। তারপর এখানে মোবাইল ব্যবহার করতে দেয়া হয় না। তাই সব মিলিয়ে ভেবেছিলাম, এখান থেকে পালিয়ে যাব। কিন্তু যাব কোথায়? পড়াশোনার এমন পরিবেশ আমাদের কে দেবে?

আগে কখনো এত পরিশ্রমের কোনো খেলা খেলি নি। স্পোর্টসে ক্যাম্পাসের এক বড় ভাই ক্রালুং খুমীর অধীনে ছিলাম। তিনি প্রতিদিন অনেকটা পথ আমাকে দৌড়াতে দিতেন। দৌড়ে এসে তারপর পুশ-আপ, সিট-আপ আরো কত ব্যায়াম! তিন মাস আমার সাথে এসব চলল। বুঝতে পেরেছিলাম, এই স্কুলে যারা ছোট থেকে আছে, তারা কতটা পরিশ্রম করতে শেখে।

আমার চেয়ে ছোট ছেলেরা অনেক বেশি একটিভ ছিল। তিন মাস পর আমাকে বাস্কেটবলে দেয়া হলো। ততদিনে আমি অনেকটাই পরিশ্রমী হয়ে উঠেছি। তারপর পড়াশোনায় দেখলাম এই স্কুলের অন্যরকম শিক্ষাপদ্ধতি।

বাইরের ছাত্ররা সচরাচর মূল বইয়ের চেয়ে গাইড বই নিয়ে মাতামাতি করে। কিন্তু এখানে এমনটা নেই। সহপাঠীদের জিজ্ঞেস করি, গাইড বই কখন দেবে। তারা বলে এখানে এসব নেই। শুধু মূল বই। এভাবে একসময় এই পরিবেশের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। শুধু এসএসসি-তে পরীক্ষার আগে টেস্ট পেপার পেয়েছিলাম। নবম শ্রেণির প্রথম দিকে প্রধান শিক্ষককে বললাম যে, আমি বিজ্ঞান বিভাগ নেব। তিনি আমাকে বললেন, তুমি মানবিক বা বাণিজ্য শাখায় ভালো করবে। আমি বাণিজ্য শাখায় গেলাম।

একটি মজার কথা বলি। আমি বাড়ি থাকতে ভাবতাম কলেজে পড়েই হয়তো চাকরি করতে হয়। এরপর আর পড়া নেই। আসলে গ্রামে আমাদের এই বিষয়গুলো কে শেখাবে! কিন্তু এখানে এসে দেখলাম বড় ভাইয়েরা কলেজের এইচএসসি পরীক্ষা শেষে কী যেন পড়ে। তখনই প্রথম ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে জানি। দশম শ্রেণিতে থাকতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি। তখন নেয়ামাতানে (ডাইনিং হলে) খাবার সময় শুনতাম, অমুক এই ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। তখন থেকেই মনে হতো আমাকেও সেখানে পড়তে হবে।

এরপর এসএসসি পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট এলো ৪.৮৯। এরপর কলেজের প্রথম বর্ষ শেষ করে দ্বিতীয় বর্ষে উঠলাম। করোনা ভাইরাসের জন্যে পরীক্ষা পেছাতে লাগল। সারাদেশে লকডাউন হয়ে গেল। এখন কিছু করার নেই। আমাদের ব্যাচের কেউ ভাবি নি যে, এটাই আমাদের শেষ ছুটি হবে। পরীক্ষা ছাড়াই এইচএসসি রেজাল্ট বের হলো। অটোপাশে আমি জিপিএ ৪.৮৩ পেলাম।

ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্যে কসমো কলেজের নাইমুর ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু বই নিয়েছিলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিংয়ে পড়ছেন। তার বইগুলো নিয়ে বাড়িতে পড়তে লাগলাম। বইগুলোর শেষের মডেল টেস্টগুলো চর্চা করেই ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। চান্স পেলাম জগন্নাথ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই সুখবর পেয়ে বাসায় সবাই খুশি। কিন্তু রাতে আমার ঘুম আসে না। কীভাবে ভর্তি হবো আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে? হাতে টাকা নেই। অভাবের সংসারে মায়ের কাছে টাকা চাইতে লজ্জা লাগল।

যা-হোক, কোনোভাবে ভর্তির টাকা ম্যানেজ হয়ে গেল। ভর্তি হলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আজ বাবা যদি বেঁচে থাকতেন কত খুশি হতেন! তিনি সবসময় দোয়া করতেন, আমার ছেলেরা পড়ালেখা করুক। বাবা কৃষিকাজ

করতেন। কিন্তু কখনো আমাদের লেখাপড়া বাদ দিয়ে কৃষিকাজ করতে বলেন নি। এলাকার অন্য বাড়ির ছেলেরা জমিতে না গেলে বাবাদের গালি দিতে শুনেছি। আর আমরা দুই ভাই কখনো মাঠের কাজে গেলে বাবা লেখাপড়ার খোঁজ নিতেন যে, আমরা পড়া শেষ করেছি কিনা।

একবার এমন হলো যে, বাবার খুব জ্বর। এই সুযোগে আমরা দুই ভাই মিলে একটা ঝড়ে ভেঙে যাওয়া গাছ কেটে বাড়িতে আনি। সেইবার বাবার খুব ধমক খেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, লেখাপড়া বাদ দিয়ে শুধু এই কাজ করলে চলবে না। তোদের অনেক বড় হতে হবে। লেখাপড়াও করতে হবে। আবার কৃষিকাজও জানতে হবে। কারণ বাবা জানতেন, শিক্ষিত ছেলেরা যদি এই কাজে আসে তাহলে দেশের কৃষিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

বাবার এই কথাগুলো এখন আমি চিন্তা করি। ভাবি আমাকেও ভালো কিছু করতে হবে। আমার এমন কাজ করতে হবে, পৃথিবী থেকে আমার নামটা মুছে গেলেও যেন বাবার নামটা বেঁচে থাকে।

[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]

শেয়ার করুন

এই শাখার আরো সংবাদ পড়ুন
All Rights Reserved © rmgbdnews24.com