এখানে না এলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হতো না
মংহ্লাচিং চাক
আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: ৮ অক্টোবর ২০২৪
আমি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার চাক হেডম্যান পাড়া থেকে ২০০৪ সালে পাঁচ কি ছয় বছর বয়সে কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। তখন কোয়ান্টামমের আশেপাশে পুরোটাই জঙ্গল আর অনুন্নত হলেও আমার বাবার বন্য জন্তু, ডাকাত ও ছেলেধরার ভয় ছিল না। তার কেবল ভরসা ছিল—আমি যাদের কাছে আমার ছেলেকে তুলে দিচ্ছি, তারা খুবই ভালো এবং পিতা হিসেবে যা দিতে পারব না এরা হয়তো পারবে। কারণ বাবার স্বপ্ন ছিল তার ছেলে পড়ালেখা করবে আর উচ্চশিক্ষিত হয়ে বড় কিছু করবে।
আমি শিশুশ্রেণিতে স্বল্প সময়ের জন্যে ছিলাম। কিছুদিন পরেই আমাকে প্রথম শ্রেণিতে নেয়া হয়। ২০০৪ সালে আমরা প্রথম তিন জন চাক সম্প্রদায়ের ছেলে কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। তবে পরিবেশ-পরিস্থিতির সমস্যা মনে হওয়ায় একজন বাড়ি চলে যায়। ছাচিংঅং আর আমি দুজন থেকে যাই। স্বাভাবিকভাবেই চাক ভাষাভাষীর কেউ না থাকায় বাংলা ভাষা বুঝিয়ে দেয়ার কেউ ছিল না। বাংলা পারতাম না বিধায় সবকিছুতে একটা ভয় কাজ করত। কার সাথে কী বলব, কীভাবে চলব এসব নিয়ে। সবকিছুতে বড় একটা শূন্যতা আর অভাব অনুভব করেছিলাম সে-সময়ে।
সিস্টাররা আমাকে অনেক বেশি সহযোগিতা করেছিলেন। তারা আমাকে যথেষ্ট মমতা দিয়ে দেখভাল করেছিলেন। এভাবে আস্তে আস্তে বাংলা শিখে নিই এবং অন্য কোয়ান্টাদের সাথে স্বাভাবিকভাবে মিশতে শুরু করি।
আমি প্রায় দীর্ঘ এক যুগ ক্যাম্পাসে ছিলাম। ২০১৬ সালে কোয়ান্টাম কসমো স্কুল এন্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করি। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেই। সে-বছর ২৪ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘ ইউনিটে পরীক্ষা দিয়ে ৩১ অক্টোবর আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সি ইউনিটে শেষ পরীক্ষা দিতে যাই। আমার আর বন্ধু কাদেরের পরীক্ষার হল ছিল একই। পরীক্ষার শেষে আসাদ স্যার কাদেরকে কল করে বলে মংহ্লাকে বলো মিষ্টি আনতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটের রেজাল্ট প্রকাশ হয়েছে আমি জানতাম না। মিষ্টির কথা বললেও কাদের আমাকে বলে নি যে রেজাল্ট দিয়েছে। সে বলল, চল আগে বাসায় যাই।
বাসায় গিয়ে দরজা খুলতেই বন্ধু সাহেদ জাপটে ধরে বলল, ‘এই মংহ্লা তুমি তো আইন বিভাগে চান্স পেয়েছ! তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটে মেধাতালিকায় ৭৭ তম হয়েছ।’ যদিও আমার স্বপ্ন ছিল মেধাতালিকায় প্রথম সাত জনের মধ্যে থাকা। ভাগ্য সেটাকে ডাবল সাত বানিয়ে দিল!
আমার তখন ফোন ছিল না। তাই ঐ মুহূর্তে খুশিটা আমার পরিবারকে জানাতে পারি নি। আমাদের যেদিন রেজাল্ট দিয়েছে সেদিন চট্টগ্রাম থেকে লামায় যাওয়ার কথা। পরের দিন আমরা লামা যাই। পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। কিন্তু আমার আর তর সইছিল না। বাড়িতে যে করেই হোক এই খুশির খবরটা দিতেই হবে। বন্ধু মংশৈসিং মার্মার কাছে মোবাইল ছিল। ডায়রি থেকে নাম্বার নিয়ে ভাইয়ের কাছে কল করে যখন সুখবর জানালাম, ভাই অনেক খুশি হয়েছিল। বললাম আমি আইন নিয়ে পড়তে চাইলে পারব আর ইংরেজি নিয়ে পড়তে চাইলেও পারব। বড় ভাই বললেন তুমি আইন নিয়ে পড়ো। আমাদের চাক সম্প্রদায়ের মধ্যে আইন নিয়ে তখনো কেউ পড়ে নি। এই যে একটা খুশির আদানপ্রদান, এটা বলে বুঝানো সম্ভব না।
আমি যে এই পর্যন্ত এসেছি সেটা সহজ ছিল না। আমার কখনো একা মনে হয় নি নিজেকে। সবসময় মনে হয়েছে কোয়ান্টাম আমার পাশে আছে।
কোয়ান্টাম মেথড কোর্স করার আগে থেকেই আমি নিয়মিত মেডিটেশন করতাম। ২০০৯ সালে যখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি, তখন আমাকে কোয়ান্টাম মেথড কোর্স করানো হয় স্কুল থেকে। আসলে কোয়ান্টাম যদি না থাকত তাহলে আমি আজকে এ পর্যায়ে আসতে পারতাম না।
তাছাড়া শিক্ষকেরা যেভাবে সহায়তা করেছেন সেটা অন্য কোনো প্রাইভেট স্কুলে, কোনো আশ্রমে পাওয়া যায় না। কোয়ান্টাম একটি সুন্দর পরিবেশে আমাদের পড়ালেখা করার সুযোগ করে দিয়েছে এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারা আন্তরিকতার সাথে এখানে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
আমি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ালেখা করছি। দেশের উন্নতির জন্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাই। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা যাতে আরো সুদৃঢ় হয় এজন্যে কাজ করব। সাধারণ মানুষকে তাদের ন্যায়বিচার পেতে সাহায্য করব। যারা শোষণ ও বঞ্চনার শিকার, তাদের পাশে দাঁড়াব। আমার সম্প্রদায়ের মধ্যে যেহেতু আমরা কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি, স্বাভাবিকভাবেই তারা চাইবে যেন তাদের জন্যে ভালো কিছু করি। আমার লক্ষ্য আমাদের পিছিয়ে পড়া যে ভাইবোনেরা আছে তাদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমি সবসময় আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে চাই, যেন তা হারিয়ে না যায়। আমি কবিতা আবৃত্তি করতে পছন্দ করি এবং এর পাশাপাশি গান গাইতেও ভালবাসি।
জীবনের বিভিন্ন ধাপে আমার জীবনে যে চ্যালেঞ্জ আসে সেগুলো মোকাবেলা করার নতুন অনুপ্রেরণা পেয়েছি বইপুস্তকের মাধ্যমে, কোয়ান্টামের কোনো সুন্দর আলোচনার মাধ্যমে কিংবা সুন্দর সুন্দর অটোসাজেশনে। এগুলো আমার জীবন বদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
অদূর ভবিষ্যতে নিজেকে একজন সৎ এবং যোগ্য নাগরিক হিসেবে দেখতে চাই। আমার জীবন বদলের ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম অনেক বেশি ভূমিকা রেখেছে। হয়তো আমার জীবনটা পাহাড়ে জুমচাষ করে কেটে যেত। জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত থাকতাম। তবে এখন আমার জ্ঞানকে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারব।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]