কঠিন যুদ্ধেও আমি পরাজয় মানতে শিখি নি
উক্যচিং মার্মা
বি.এ. শিক্ষার্থী, লামা সরকারি মাতামুহুরী কলেজ
প্রকাশিত: ১৭ অক্টোবর ২০২৪
বান্দরবান লামার রূপসীপাড়া ইউনিয়নের টিয়ারঝিরি গ্রামে আমার জন্ম। নিবিড় নৈসর্গের মাঝে আমার শৈশবটা অসাধারণ ছিল। নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি, বনবাদাড়ে ঘুরাঘুরি এগুলো ছিল আমার নিত্যদিনের কাজ।
আমার বাবা কিছুটা পড়াশোনা জানতেন বলে তিনি পড়াশোনার খুব মূল্যায়ন করতেন। বাবা বলতেন, পড়াশোনা করলে অনেক বড় মানুষ হওয়া যায়। ২০০০ সালে পাঁচ বছর বয়সে আমাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন দূরের একটি স্কুল—দরদরী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আমাদের গ্রাম থেকে এই স্কুলে পাঁচ জন ছাত্রের মধ্যে আমি একজন। স্কুল যেহেতু দূরে তাই বাসা থেকে যাওয়া-আসা করা সম্ভব নয়। তাই স্কুলের নিকটস্থ বৌদ্ধ শ্রমণদের সাথে তাদের বিহারে আমার বসবাস শুরু হলো। দুটো বছর আমার সেখানেই কাটে। বড় ভান্তের (বিহারের অধ্যক্ষের) সেবাযত্ন করতাম। উৎসবে বা বিশেষ দিনে বিহার সাজসজ্জার কাজ করতাম। ভান্তে কবুতর পুষতেন। এগুলো দেখভাল করাটাও ছিল আমাদের দায়িত্ব। ছোটদের দেখাশোনা করা আর বিহারের সবার জন্যে রান্নাটাও আমরাই করতাম।
যা-হোক একদিন শুনলাম আমাকে অন্য কোনো এক স্কুলে ভর্তি করানো হবে। আমি অবুঝ ছিলাম। শৈশবটা তো এমনই হয় তাই না! অভিভাবকের হাত ধরেই তখন আমাদের সমস্ত জীবন।
শুরু হয় শৈশবের আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। সেটা আর অন্য কোনো স্কুল নয়, আমার প্রিয় ‘কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজ’। শুরুতে এর নাম ছিল কোয়ান্টাম শিশুকানন। মন মাতানো সুন্দর পরিবেশ। ২০০৪ সালে বাবা আমাকে শিশুকাননে নিয়ে আসেন।
তখন আধো আধো বাংলা জানতাম। ঠিকমতো বাংলা বলতে পারতাম না। সেখানকার পুরনো কিছু কোয়ান্টা আমার দোভাষী হয়ে কাজ করল। আর বাংলা ভাষা শেখাল। এভাবে একসময় শুদ্ধ বাংলা ভাষা আয়ত্ত করে নিলাম। কোয়ান্টামে এসে আবারো সূচনা ক্লাস থেকে পড়াশোনা শুরু করি। যদিও তখন আমার বয়স আট কি নয় বছর।
কোয়ান্টামে পোশাক থেকে শুরু করে সবকিছু ছিল বিনামূল্যে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, নাচ—গান সবই শেখার সুযোগ হয় এখানে। ডিসপ্লে-প্যারেডে নিয়মিত অংশ নিতাম।
সবে অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছি। পরিচয় হয় কামাল আরিফ নামে একজন বাংলা শিক্ষকের সাথে। একাধারে কবি ও সাহিত্যিক। ক্লাসে এলেই কবিতা পড়াতেন। খুব ভালো লেগেছিল তাকে। সেখান থেকেই আমার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। স্যারের পড়ানোর ধরন, চালচলন, কথাবলার ভঙ্গি আমাকে অনুপ্রাণিত করে। লক্ষ্য ঠিক করলাম আমিও কামাল স্যারের মতো একজন কবি-সাহিত্যিক হবো। দেখতে দেখতে দশম শ্রেণিতে পদার্পণ করলাম। একটা নিয়মের ভেতর আমার জীবনটা ভালোই চলছিল।
এসএসসি পরীক্ষা শেষ করতেই কোয়ান্টাম কসমো স্কুল থেকে বেরিয়ে এলাম। বের হওয়ার তেমন কোনো কারণ ছিল না যদিও। সবাই মানা করলেন। তবুও বাইরের জগৎ দেখার বাহানায় বেরিয়ে পড়লাম। কোয়ান্টামে থাকার সময় সাহিত্যের একটা গ্রুপ ছিল। কিন্তু বাইরের জগতে এসে সেই গ্রুপটা আর পেলাম না। বাইরের জগতটা সম্পূর্ণ আলাদা। কারোর মাঝে কোনো স্বপ্ন, আশা-প্রত্যাশা বা লক্ষ্য দেখি নি আমি। দেখেছি শুধু নেতিবাচকতা। ইন্টারনেট অপব্যবহার যার অন্যতম কারণ।
সবার সাথে তাল মেলাতে কষ্ট হচ্ছিল। ওদের মতো আমি চলতে পারি না। একা থাকাটাই শ্রেয় মনে হলো। তারপর ভর্তি হলাম লামার সরকারি মাতামুহুরী কলেজে। সেখানে খালার বাড়িতে থাকতাম। দেখতে দেখতে কলেজের সময়টাও পেরিয়ে গেল।
২০১৯ সাল। চাকরির সন্ধানে চলে এলাম চট্টগ্রামে। শুরু হলো জীবনযুদ্ধ। এই যুদ্ধে লক্ষ্যে পৌঁছাতে নিজেকে বিলিয়ে দিলাম শিল্প কারখানায়। পার্ট টাইম চাকরি নিলাম। কঠিন যুদ্ধেও আমি পরাজয় মানতে শিখি নি। পাশাপাশি একই কলেজে বিএ ডিগ্রি-তে পড়াশোনা করছি।
এখন আমি জীবনে কিছু একটা না হওয়া পর্যন্ত পিছপা হবো না।
জীবনের বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আমি এগিয়ে যাব। বর্তমানে সাহিত্যচর্চাই আমার সাধনা। ইরানের কবি শেখ সাদীর একটি কথা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি— ‘ঊষর মরুর ধূসর বুকে বিশাল যদি শহর গড়ো, একটি জীবন সফল করা তার চেয়ে অনেক বড়।’
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]