খাবার খাওয়ার পর হজম ও বিপাকক্রিয়া শেষে খাদ্যবর্জ্য কোলনে এসে জমা হয়। শরীর অতিরিক্ত পানিটুকু শুষে নেয়। বাকিটা মল হয়ে মলদ্বারে পৌঁছায়।
দেখুন হাই কমোডে বসলে মলনালীতে কতটা চাপ পড়ে! (ছবিসূত্র- www.researchgate.net)
এই মল ধরে রাখে পিউবোরেকটালিস পেশি (Puborectalis Muscle) যা দেখতে ইউ আকৃতির। যখন আমরা স্কোয়াটিং পজিশনে বসি তখন পেশিটি শিথিল হয় এবং সমস্ত টক্সিনসহ মল শরীর থেকে অনায়াসে বেরিয়ে যায়।
কিন্তু যখন কমোডে বসে কেউ মলত্যাগ করে তখন সংশ্লিষ্ট জায়গাটি সরু হয়ে যায়। ওপরদিকে চাপ পড়ে। ফলে মল নির্গমনের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।
সহজে টয়লেট ক্লিয়ার হতে চায় না- এই অনুযোগ যে অনেকে করেন তার অন্যতম কারণ এটা-ই!
মলত্যাগের জন্যে কমোডে বসলে মলদ্বার পুরোপুরি প্রশস্ত হতে পারে না, পেটে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চাপ পড়ে, পায়ুপথে শিরা টান খায় ও ফুলে যায়। ফলে দীর্ঘদিন ধরে যারা কমোড ব্যবহার করেন তাদের কোষ্ঠকাঠিন্য ও পাইলসের মতো রোগের আশঙ্কা বেড়ে যায়।
বিশেষতঃ দিনকে দিন যে ক্রনিক পাইলসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তা এই হাই কমোডে অভ্যস্ততার কারণেই- বহু গবেষণাতে মিলেছে এর প্রমাণ।
এর কারণটাও ব্যাখ্যা করা যাক!
হাই কমোডে অনেকের এতটা সময় লাগে যে বই, সংবাদপত্র বা স্মার্টফোনে সময়টা ব্যয় করে! (ছবিসূত্র- www.buzzfeed.com)
প্যানের তুলনায় হাই কমোডে বসে মলত্যাগ করতে সময় লাগে প্রায় আড়াইগুণ। ইসরায়েলি চিকিৎসক-গবেষক ডা. ডাভ সিকিরভ একটি গবেষণায় দেখেছেন, কমোডে মলত্যাগ করতে রোগীদের যেখানে সময় লেগেছে ১৩০ সেকেন্ড, সেখানে ফ্লোর প্যানে লেগেছে মাত্র ৫১ সেকেন্ড!
আমেরিকায় প্রতি বছর ২৫ লক্ষ মানুষ ডাক্তারের কাছে যায় স্রেফ কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা নিয়ে। এদের মধ্যে গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় ৯২ হাজার জনকে।
আর কোষ্ঠকাঠিন্য দীর্ঘদিন চললে একসময় তা থেকে হয় পাইলস।
এ-ছাড়াও মলত্যাগ বাধাগ্রস্ত হলে পেলভিক ফ্লোর বা মুত্রাশয়, মলদ্বার ও মহিলাদের জরায়ু এলাকার কার্যক্রম ব্যহত হয়। ফলে ব্যথা, ফুলে যাওয়া, ইউরিন লিকেজ ইত্যাদি জটিলতা দেখা দেয়।
প্রস্রাব ক্লিয়ার হয় না বলে হাই কমোড ব্যবহারে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনও সৃষ্টি হতে পারে।
আর সরাসরি ত্বকের সংস্পর্শে আসে বলে কমোডের মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনের মধ্যে জীবাণু সংক্রমণ ছড়াতে পারে। বিশেষ করে পাবলিক টয়লেটে উঁচু কমোডে না বসার পরামর্শই দেন বিশেষজ্ঞরা।
আরো আছে! অনেকে হাই কমোডে টয়লেট ক্লিয়ার করতে জোর করে চেষ্টা করেন। ফলে চাপ পড়ে মলদ্বারের ওপর। টয়লেট করার সময় এভাবে ক্রমাগত চাপ দিলে একটা বয়সে এসে মলদ্বার ঝুলে পড়ে। হার্নিয়ার মত রোগগুলো হয় মূলত এ-কারণেই।
পশ্চিমের দেশগুলোতে অধিকাংশ হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক হয় বাথরুমে। এগুলোর সাথে হাই কমোডে বসার সরাসরি যোগ রয়েছে বলে অভিমত দিয়েছেন ইসরায়েলের ড. বারকোসিকিরোভ। গবেষকরা ধারণা করছেন, চাপ দিয়ে মলত্যাগের জন্যেই এই সমস্যা হয়।
এ-ছাড়াও ক্যান্সার গবেষকদের মতে, কোলন বা মলাশয়ের ক্যান্সারের অন্যতম কারণ দীর্ঘদিন ধরে কমোডের ব্যবহার। কারণ এটি ব্যবহারের সময় পেশিতে চাপ দিতে হয় বলে অন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। ক্যান্সার হওয়ার কারণ এটা-ই।
নিঃসন্দেহে সুস্থতা আমাদের সেরা সম্পদ। এখন আপনি-ই বলুন, হাই কমোড ব্যবহারের মাধ্যমে এই অমূল্য সম্পদকে বিকিয়ে দিয়ে আমরা কি জাতে উঠেছি, না জাত হারিয়েছি?
অপারেশন ছাড়াই এই রোগগুলো থেকে নিরাময়ের যে উপায়গুলোর কথা এখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন তার মধ্যে আছে আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া, ওজন কমানো ও মলত্যাগে সঠিক ভঙ্গি অনুসরণ। আর তা হলো প্যানে বসা।
কারণ প্যানে ডিপ স্কোয়াট পজিশনে মলত্যাগই অধিক স্বাস্থ্যসম্মত।
পাশ্চাত্যের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা তাদের প্রায় অর্ধশতকের গবেষণার ভিত্তিতে বলছেন, মলত্যাগে স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যসম্মত ভঙ্গি হলো এ-সময় দুই ঊরু পেটের সাথে লেগে থাকবে। গ্যাস্ট্রোএন্টেরলজির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পাঠ্যবই ‘বোকাস গ্যাস্ট্রোএন্টেরেলজি’তেও এটা-ই বলা হয়েছে।
কেন? কারণ দুই ঊরু পেটের সাথে লেগে থাকলে মলদ্বার পুরোপুরি প্রশস্ত হয়। মলত্যাগ হয় খুব সহজ।
প্যানে বসে মলত্যাগের সময় আমাদের রেচন অঙ্গগুলো যে ভঙ্গিতে থাকে তা রেচনক্রিয়াকে করে সহজতর ও দ্রুত। এতে প্রতিহত হয় মলাবদ্ধতা, যা কোলন ক্যান্সার, অ্যাপেন্ডিসাইটিস ও আইবিএস-এর অন্যতম প্রধান কারণ।
আর এই ভঙ্গিমায় হিপের প্রসারণ বেশি হয় বলে রেচন অঙ্গগুলোর উপর ধকলও পড়ে কম- এমনটাই দেখা গেছে কয়েকটি গবেষণায়।
আসলে মানবদেহের অ্যানাটমি থেকে বোঝা যায় যে, প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের দেহ সৃষ্টি ডিপ স্কোয়াট ভঙ্গিমায় রেচনক্রিয়ার জন্যে। আর তা সম্ভব কেবল প্যানেই!
যদি টয়লেটে হাই কমোড লাগিয়ে থাকেন তাহলে আজই এটা সরিয়ে বাংলা প্যান বসান। কারণ অহেতুক ফুটানির চেয়ে আপনার স্বাস্থ্যরক্ষা অনেক বেশি জরুরী।
তবে সেটা যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ একটি টেকনিক ব্যবহার করতে পারেন।
মলত্যাগের স্বাস্থ্যসম্মত ভঙ্গি হলো এমনভাবে বসা, যাতে শরীরের ঊর্ধ্বাংশ ও উরুর মধ্যে ৩৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল ফাঁকা থাকে (ছবিসূত্র- ইন্ডিয়া টাইমস)
টয়লেটে মাঝারি উচ্চতার একটি টুল রাখুন। কমোডে বসার সময় টুলের উপর এমনভাবে পা উঠিয়ে বসুন যাতে শরীরের ঊর্ধাংশ ও উরুর মধ্যে ৩৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল ফাঁকা থাকে। কারণ এই অ্যাঙ্গেলে রেকটামের সংকোচন প্রতিহত হয়। ফলে মল নির্গমণ হয় স্বচ্ছন্দ ও সহজতর।
আপনার এই সচেতন প্রয়াস আপনাকে বাঁচিয়ে দেবে পাকস্থলী, অন্ত্র, রেকটাম ও মলদ্বারের নানাবিধ রোগ থেকে।