এবার আমার জীবনের শুরুর গল্পটাও একটু বলি। আমার পৈত্রিক নিবাস রাঙ্গামাটি। কিন্তু আমার দাদা পরিবার নিয়ে বান্দরবানে চলে আসেন। এরপর আমার বয়স যখন তিন বা চার মাস, আমার মা আমাকে নিয়ে আবার রাঙামাটি চলে যান। এর কিছুদিন পরে বাবাও সেখানে চলে আসেন। তো এভাবে আমাদের স্থায়ী ঠিকানা রাঙ্গামাটির জুরাছরি উপজেলার কংঙাছরি গ্রামে।
ছোটবেলায় আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে একটি স্কুলে পড়তাম। যেহেতু বাসা থেকে যাওয়া-আসা করা সম্ভব না, তাই আত্মীয়ের বাসায় থেকে লেখাপড়া করতাম। এরপর আমি প্যারাছরি মুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ছোটবেলায় মা-বাবাকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হতো। বিকেলে বন্ধুরা যখন মা-বাবার সাথে ঘুরতে বের হতো তখন মায়ের কথা অনেক মনে পড়ত। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার একজন শিক্ষকের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন বাবা। স্যারের সহযোগিতায় আমি পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেলাম। দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কখনো আমার রোল এক থেকে দুই হয় নি।
এরপর আমি বনযোগী ছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। এই স্কুলটি আগের স্কুলের মতো অত দূরে না হওয়ায় বাড়ি থেকেই যাতায়াত করতাম। কিন্তু সেখানে যেতে একটা নদী পার হতে হয়। গ্রীষ্মকালে নদীটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত। একথাগুলো বলার কারণ হলো শহরের মানুষেরা হয়তো জানবেই না যে, আমরা যারা পাহাড়ে থাকি আমাদের কত কষ্ট করে লেখাপড়া করতে হয়।
হাই স্কুলে গিয়ে আমার লেখাপড়া একটু কম ভালো হওয়া শুরু হয়। ফলে অষ্টম শ্রেণিতে রেজাল্ট ভালো হলো না। ঐ সময় আমাদের এলাকা থেকে পরিচিত কয়েকজন কোয়ান্টামে পড়ত। শুনতাম তাদের রেজাল্ট আমার চেয়ে অনেক ভালো। ফলে আমার মা আমাকে কোয়ান্টামে ভর্তি হওয়ার জন্যে বললেন। আমি নবম শ্রেণির জন্যে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। আমারও ইচ্ছে ছিল ভর্তি হওয়ার। কিন্তু চান্স পেলাম না। এরপর আমি আবার আমার স্কুলে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম। সেখানে শিক্ষকেরা অনেক আন্তরিক ছিলেন। কিন্তু কোনো কারণে আমার এসএসসি-র রেজাল্ট আবার আশানুরূপ হলো না।
আমার পরিবার আবার আমাকে কোয়ান্টামে ভর্তির কথা বলল। ভাগ্য দেবতার সহায় আমি এবার কোয়ান্টাম কসমো কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। যেহেতু আমার এসএসসি-তে রেজাল্ট তেমন ভালো ছিল না, তাই আমি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ পেলাম না। মানবিক বিভাগে ভর্তি হলাম।
কলেজের শুরুতে এই পথটা সহজ ছিল না। জানতে পারলাম যে এখানে মোবাইল চালানো যায় না। তখন মনে হতো—যদি মোবাইল চালাতে নাই পারি তাহলে এখানে থাকার কোনো মানে হয় না। প্রথম একমাস আমি নাক-চোখ বন্ধ করে থাকলাম। কিন্তু আর না! এবার সিদ্ধান্ত নিলাম ক্যাম্পাস থেকে পালানোর। কিন্তু পালানোর আগের দিন আমাদেরকে নিয়ে একটা প্রোগ্রামের আয়োজন করা হলো। প্রোগ্রামটির বিষয় হলো লাইফ স্কিল সায়েন্স। নৈতিক ডিপার্টমেন্টের জহুরুল হক স্যারের পরিচালনায় সাত দিনব্যাপী চলল এই প্রোগ্রাম। আমার মনে পরিবর্তন এলো। সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে এখানেই থাকতে হবে। লক্ষ্য ঠিক করে ফেললাম। সেই প্রোগ্রামে প্রথম শুনেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। এর আগে কখনোই জানতাম না যে, কলেজে পড়ার পরেও আরো পড়াশোনা আছে। উপলব্ধি করলাম—ভালো পড়ালেখা করে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে।
কিছুদিন যাওয়ার পর কোয়ান্টামের নিয়মগুলোর সাথে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। পড়া শুরু করলাম নতুন উদ্যমে। কলেজের আসাদ স্যারকে কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়। তার সঠিক দিক-নির্দেশনা অনেক সাহায্য করেছে।
এভাবেই এইচএসসি পরীক্ষার সময় চলে এলো। পরীক্ষা দিলাম। শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা প্রস্তুতির নতুন এক অধ্যায়। পড়ালেখা হলো সার্বক্ষণিক সঙ্গী। অ্যাডমিশনের প্রস্তুতি নেয়ার সময় একই পড়া বার বার পড়তে খুব ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমাদের ভর্তি কোচিং করানোর জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রনি ভাই এসেছিলেন। তিনি আমাদের কল্পনা করতে শেখালেন এভাবে—আমরা আমাদের লক্ষ্য অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাচ্ছি এবং নির্দিষ্ট ডিপার্টমেন্টের ক্লাস রুম ও বারান্দায় হাঁটছি—এই কল্পনা সবসময় করতে বললেন। সেদিনের কথাগুলো খুব ভালো লাগল। এরপর থেকে নিয়মিত মেডিটেশন, অটোসাজেশন এবং প্রত্যয়নে এই কল্পনা করতাম।
আমি কলেজ থেকে ৪৩১ তম ব্যাচে কোয়ান্টাম মেথড কোর্সে অংশগ্রহণের সুযোগ পাই। তখন বুঝতে পেরেছিলাম জীবন কীভাবে পরিচালনা করতে হয়। কীভাবে কার সাথে কোন ধরনের ব্যবহার করতে হয়। কীভাবে মাথা ঠান্ডা করতে হয় আর ব্রেনকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয়। এখন বুঝতে পারি কোয়ান্টাম মেথড কোর্স একজন মানুষের জন্যে কত গুরুত্বপূর্ণ।
আমার স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়ব। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিল। আমি আমার জীবনে প্রথমবারের মতো এ প্লাস পেলাম। সেদিন আমার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছিল। সেদিনের পর আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে গেল—আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবই। তাই ঢাকা এবং চট্টগ্রাম ছাড়া অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম তুলি নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘খ’ ইউনিটে পরীক্ষা দেয়ার পর আমি আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষাই দেই নি। কেননা ভর্তি পরীক্ষা ভালো হয়েছিল।
স্রষ্টাকে ধন্যবাদ যে, আমি কোনো ধরনের কোটার সুযোগ না নিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অবস্থান ছিল ৭৪২ তম। যদিও আমার কোটা গ্রহণের সুযোগ ছিল। কিন্তু আমি তা নিই নি। আইন বিভাগ পেলাম না যদিও, শিক্ষা ও গবেষণা ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হলাম। আমার পরিবারে আমি ছাড়া আর কেউ এতদূর আসতে পারে নি। বিশ্ববিদ্যালয় কী সেটা জানতামই না, সেখানে আজ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী। এখন আমি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি।
ভবিষৎ পরিকল্পনা নিয়ে বলতে গেলে আপাতত আমি উচ্চতর শিক্ষার জন্যে আমেরিকা বা কানাডা যেতে চাই এবং সেটা ফুল স্কলারশিপ নিয়ে। আর অবশ্যই কোয়ান্টামের সাথে থেকে মানুষের সেবা করতে চাই। আমি জীবনের বাস্তবতাকে উপলব্ধি করেছি এবং সময়ের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি কোয়ান্টামের সংস্পর্শে এসে। কোয়ান্টামের ছায়াতলে আসতে পারাটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। এই সঙ্ঘের সকল মানুষের আপ্রাণ চেষ্টা ও আন্তরিকতা আমি নিজের চোখে দেখেছি। সেজন্যে ধন্যবাদ জানাই সেসব মানুষদের যারা আমার এবং আমাদের পেছনে এত শ্রম দিয়েছেন।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]