স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবো। এই স্বপ্ন বুনেছি আমি কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজে বসে। বলা যেতে পারে জীবনের সবচেয়ে বড় সময়টা পার করেছি এখানে। এখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাফিক ডিজাইনে অনার্সে পড়ছি। তবে আমার শুরুর গল্পটা ছিল ভিন্ন।
২০০৫ সালে আমার বাবা আর নানা ভর্তি করিয়ে দিয়ে যান কোয়ান্টাম শিশুকাননে। একটা সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ। নতুন ভাষা, নতুন কালচারে মানিয়ে নেয়ার লড়াই, তারপর মিশে যাওয়া। এরপর কেটে যায় ১৩টি বছর। কত স্মৃতি যে জমা পড়ে আছে!
স্কুলের সেই ছোট্ট টিনশেডের ঘরগুলো এখন আর নেই। শুরুর দিকে আমরা সেখানে থাকতাম। সময়ের বিবর্তনে কোয়ান্টাম শিশুকানন এখন কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজ হয়েছে। ছোট্ট ক্যাম্পাসটি এখন তিন-চারটি পরিকল্পিত বিশাল ক্যাম্পাসে পরিণত হয়েছে। বলতে গেলে শূন্য থেকে পরিপূর্ণতার দিকে এগোচ্ছে এই স্কুল।
অনেক মানুষের শ্রম, দান আর ভালবাসা মিলিয়ে আজকের এই স্কুল। প্রথমেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই আমার বাবার প্রতি, যিনি এই স্কুলের সাথে আমার প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।
স্কুল জীবনে আমি মোটেও ভালো ছাত্র ছিলাম না। পড়াশোনার চেয়ে খেলাধুলা আর গল্পের বই বেশি ভালো লাগত।
খুমী জনগোষ্ঠীর লোকেরা অত মেধাবী হয় না বা তারা পড়াশোনায় ভালো না—এরকম সবসময় শুনেছি পরিচিত-অপরিচিত অনেকের মুখে। যে জনগোষ্ঠীর মানুষেরা এই দেশে অনগ্রসর তাদের সম্পর্কে মানুষের ধারণা এমনই হবে। কিন্তু এটা আমি কোনো মতেই মেনে নিতে পারতাম না।
নবম শ্রেণিতে উঠে আমি বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম। ছবি আঁকতে ভালবাসতাম। ইচ্ছা ছিল স্থপতি হবো। কিন্তু বুয়েটে ভর্তির যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হই। তারপর একমাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিই গ্রাফিক ডিজাইন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব।
কোয়ান্টাম কসমো কলেজ থেকেই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক এবং চ ইউনিট ছাড়া আর কোথাও ভর্তির ফরম তুলি নি। বিশ্বাস ছিল চান্স পাব। আমাকে পেতেই হবে।
এত অবহেলা, আস্থাহীনতার জবাব দিতে হবে কাজের মধ্য দিয়েই। আমরা খুমীরা বোকা নই, কম মেধার অধিকারীও নই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চ ইউনিটে ৩৩ তম মেধাতালিকা অর্জন করে খুমী জনগোষ্ঠী থেকে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাই। এই দিনটা জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলোর মধ্যে একটা।
আমার মা যিনি বাংলায় লেখাপড়া তো দূরের কথা, বাংলা বলতেই পারেন না, তিনি এখন গর্বের সঙ্গে বলতে পারেন আমার ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা কেউ কেউ তা বিশ্বাস করতে চাইত না। কয়েকবার করে জিজ্ঞেস করত! কোথায় পড়ে? মা তখন বার বার বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নামটিও ভালোমতো উচ্চারণ করতে পারেন না।
একদিন এক পাড়াবাসী এসে মাকে জিজ্ঞেস করছে আমার বিষয়ে, মা খুব কষ্ট করে উচ্চারণ করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তার ছেলে। এটা দেখে সেদিন আমার চোখে জল চলে এসেছিল। কিন্তু মাকে তা বুঝতে দেই নি।
শুধু মনে হয়েছিল—আমি মাকে সবার কাছে অনেক সম্মানিত করতে পেরেছি। শত কষ্টের মাঝেও আমার এ অর্জনে মা যেন একটু সুখ খুঁজে পান।
আজ বাবা যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তাকেও এই সম্মানটা দিতে পারতাম। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। হয়তো পরপারে বসে তিনি আমার এই সাফল্য দেখছেন। আমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি, বাবা তখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তারপর থেকে আমাদের চার ভাইবোনকে মা একাই লালনপালন করছেন। পুরো সংসারের হাল তিনি ধরেছেন। আসলে বাংলাদেশে সংগ্রামী মায়েদের গল্পগুলো মনে হয় এমনই। আমার যতটুকু অর্জন এটা আমি বাংলাদেশের সকল মায়েদের প্রতি নিবেদন করতে চাই।
প্রিয় মা, তোমরা ভয় পেয়ো না। তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে যে যা-ই বলুক, তোমাদের আমরা ভালবাসি। তোমাদের যেন শ্রদ্ধা করতে পারি সেই দোয়া করো আমাদের জন্যে। আর কোয়ান্টামে যেভাবে আমরা বেড়ে উঠেছি, তোমার সন্তানদের সেই শিক্ষায় বড় করো। তাহলে তারা শুধু তোমার দুঃখ নয়, জাতির দুঃখ ঘুচিয়ে আলোর সন্ধান দেবে।
মাঝে মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বটতলায় দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিআরটিসি লাল বাসের জন্যে অপেক্ষা করি আর ভাবতে থাকি—আমি বাড়ির বড় সন্তান! পরিবারের বিশাল দায়িত্ব আমার ওপর। দায়িত্ব আছে সমাজের প্রতিও। কারণ আমি যে আত্মবিশ্বাসের শিক্ষা পেয়েছি তা খুমীদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে হবে। তাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এই দায়িত্ব যেন নিতে পারি সৃষ্টিকর্তার কাছে সবসময় তা-ই প্রার্থনা করি।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]