‘সকাল শোয় সকাল ওঠে, তার কড়ি বৈদ্য না লুটে’ এ বিষয়ে!
এ বচন থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এই রাইম- Early to bed early to rise. Makes a man happy and wise.
আমরা তো খুব বিস্মিত হই যে, ইংরেজিতে এত সুন্দর কবিতা রয়েছে। অথচ ইংরেজিতে এই কবিতা লেখার অন্তত হাজার বছর আগে খনা এই রাইম লিখেছিলেন, ‘সকাল শোয় সকাল ওঠে, তার কড়ি বৈদ্য না লুটে’!
কড়ি মানে টাকা। বৈদ্য মানে হচ্ছে, এখনকার ভাষায় চিকিৎসক! কারণ রোগ হলে মানুষ চিকিৎসকের কাছে যায় এবং টাকাটাও চিকিৎসকের কাছে যায়।
খুব নির্মম সত্য কথা খনা বলে গিয়েছিলেন এখন থেকে হাজার বছর আগে। আসলে এই বাংলার মানুষের ব্রেন অত্যন্ত শার্প। কেন? কারণ বাংলার মানুষের মনে মায়া আছে এবং অন্তরে স্রষ্টাপ্রেম আছে। মানুষের প্রতি প্রেম, স্রষ্টার প্রতি প্রেম এবং যে-কারণে আমাদের পূর্ব পুরুষরা অনেক জ্ঞানী ছিলেন, অনেক প্রাজ্ঞ ছিলেন, অনেক মানবিক ছিলেন।
তো এই যে early to bed সকাল শোয়, এই সকাল মানে ভোর না। এই সকাল মানে তাড়াতাড়ি। সন্ধ্যা হওয়ার পর পর। সকাল শোয় সকাল ওঠে। অর্থাৎ ভোর হওয়ার আগে ওঠে।
বলাই তো হয় যে, ভোরের হাওয়া লাখ টাকার দাওয়া! এখন তো এটা লাখ টাকা না, কোটি টাকার দাওয়া।
আমরা কিন্তু পূর্ব পুরুষদের যে সত্যজ্ঞান, এই জ্ঞান থেকে দূরে সরে যাওয়াতে গত বছর বাংলাদেশের প্রায় ৫২ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে গেছে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে।
এখন তো আসলে চিকিৎসক যে, খুব একটা পায় তা না। ক্লিনিকওয়ালারা যারা মানে বিশাল বিশাল যন্ত্রপাতি কোনো কথা নাই বার্তা নাই এমআরআই! এমআরআই কতটুকু প্রয়োজন এটা তো তারাই বলতে পারেন। এমআরআই করো এই করো সেই করো। ওষুধ খাওয়ার আগে ৫০-৬০ হাজার টাকা এমনি চলে যায়। ওষুধ খেতে হবে, খাওয়ার প্রস্তুতি নিতে ৫০-৬০ হাজার টাকা শেষ! কেন?
কারণ আমরা প্রকৃতির সবচেয়ে যে শক্তিশালী ওষুধ সেটা থেকে আমরা নিজেদেরকে বঞ্চিত করেছি। প্রকৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী ওষুধের নাম হচ্ছে ঘুম।
অথচ এখন রাত্রি হওয়ার পরপরই ঘুমোতে না গিয়ে সারারাত কী করা? শুধু ফেসবুকিং, গেইম খেলা অথবা টিভি সিরিয়াল দেখা।
এই যে পর্দার পাশে রাতটা কাটাচ্ছি, কাটাতে কাটাতে যখন চোখ ক্লান্ত হয়ে যায় রাত তখন তিনটা/চারটা বাজে তখন আর আমরা ঠিক থাকতে পারি না। তখন ঘুমোতে যাই।
ফলে কী হয়? আমাদের পিনিয়াল গ্ল্যান্ড থেকে একটা হরমোন নিঃসরণ হয় এটার নাম মেলাটোটিন। ঘুম আনার জন্যে প্রয়োজনীয় হরমোন এই মেলাটোনিন। তো মেলাটোনিনের একটা সাইকেল থাকে।
তো এখন কিন্তু স্ক্রিনগুলো নীল আলোর। যখন আপনি স্ক্রিনের দিকে তাকান এবং কৃত্রিম নীল আলো চোখে পড়ে তখন এটা ঘুমের চক্রটাকে নষ্ট করে দেয়।
এবং এই দেহঘড়ি থেকে ঘুমের চক্রটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে ঘুম আসার জন্যে যে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক মেলাটোনিন এটার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় এবং ঘুমটা নষ্ট হয়ে যায়।
এবং যখনই ঘুম নষ্ট হয় তখন মেলাটোনিনের ঘাটতিটা আরও বেড়ে যায়। এবং এই ঘাটতি বাড়ার ফলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং অনিদ্রা রোগ সৃষ্টি হয়।
এবং এই মেলাটোনিনের ঘাটতির ফলে স্তন গর্ভাশয় এবং প্রোস্টেট ক্যানসারে ঝুঁকি বেড়ে যায়। এবং চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা বেড়ে যায়।
আসলে এ নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। এবং এ গবেষণা হওয়ার ফলে ঘুমের যে উপকারিতা প্রয়োজনীয়তা এটা চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতেই প্রমাণিত সত্য!
যখন ঘুমের সাইকেলটা নষ্ট হয়ে যায় তখন শুধু ঘুমের সাইকেল না সমস্ত সাইকেলগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এই যে মন আমার দেহঘড়ি সুন্দর করি কোন মিস্ত্রী বানাইয়াছে! এই যে দেহঘড়ি বা জৈবঘড়ির সময়ের যে সাইকেল বা চক্র, সময়ানুসারে কাজের যে প্রক্রিয়া এটা নষ্ট হয়ে যায়।
যদি আপনার গভীর ঘুম হয় তখন কী হয়? যখন আপনি রাতে গভীর ঘুমিয়ে ভোরবেলা উঠছেন কাক ডাকা ভোরে আজানের সাথে সাথে তখন ভোরের এই যে বাতাস সুবহে সাদিকের যে নির্মল বাতাস এটা হচ্ছে অক্সিজেন এবং প্রাণশক্তিতে ভরপুর থাকে।
সারাদিন তো কল-কারখানা ফ্যাক্টরি-ট্যাক্টরি এগুলো চলার ফলে যে ধোঁয়া উৎপন্ন হয় নির্মল বাতাসটা নষ্ট হয়ে যায়। রাতেরবেলা সাধারণভাবেই মানুষজন ঘরে থাকে। ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকে। রাস্তাঘাটে গাড়ি চলাচল কম থাকে।
যার ফলে ভোরের খুব নির্মল বাতাস দেহমনকে চাঙ্গা করে ফেলে, চনমনে একটা ভাব চলে আসে।
এবং যারা সকালবেলা উঠে দিন শুরু করেন দিনের বরকত তারা পান এবং তারা অন্যদের চেয়ে ধীরস্থির সুশৃঙ্খল এবং নিজের দিকে তাকানোর সুযোগ পান।
কেন? ভোরবেলা যখন ওঠা হয় ভোরবেলা দিনটা অনেক লম্বা হয়ে যায়। আর ভোরবেলা যদি না ওঠেন তাহলে দিনটা শর্ট হয়ে যায়। এবং তারা সকালবেলা হাঁটতে বের হন বা ইয়োগা করেন ব্যায়াম করেন ফলে তারা তুলনামূলকভাবে অন্যদের চেয়ে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হন। অন্যদের চেয়ে তাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
এবং তাদের পারিবারিক বন্ধনও সুদৃঢ় হয় এবং তুলনামূলকভাবে পরিবারের প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়ার তারা সুযোগ পান।
৮০-র দশক থেকে শুরু হয়েছে পর্দার আগ্রাসন। প্রথমে টিভি তারপরে ক্যাবল আর এখন স্মার্টফোন।
পর্দার যে আগ্রাসন এর ফলে রাতে জাগার পরিমাণটা বেড়ে গেছে।
এবং করোনাকালে এই রাতের জাগরণটা আরও বেড়ে যায়, করোনার চেয়েও ভার্চুয়াল ভাইরাসে আক্রমণের কারণে, স্মার্টফোনের দৌরাত্ম্যের কারণে।
ফলে কী হচ্ছে? রাতের বড় অংশ জাগা হচ্ছে। ভোররাতে ঘুম এবং তারপরে উঠতে দেরি। কোনোরকম উঠে খালি দৌড় দৌড় ছোটছোট! মানে অফিসে যেতে হবে, দেরি হয়ে গেল, নাশতা ঠিকভাবে হয় না। সকালের পরিচ্ছন্নতার কাজও ঠিকভাবে হয় না।
এবং অফিসে স্কুলে গিয়েও ক্লাসে গিয়েও ঝিমানো। এবং দিনের অর্ধেকটা চলে যায় ঝিমাতে ঝিমাতেই। ফলে অবসাদগ্রস্ত, খিটখিটে মেজাজ, মুড অফ এবং যত রকম স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে এসবের শিকার হয় তারা।
রাতের ঘুমটা হচ্ছে প্রকৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী ওষুধ। রাতে ঘুমালে আপনার সুস্থতার পরিমাণ বেড়ে যাবে। আর রাতে যদি না ঘুমান তাহলে আপনার শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। আপনার অবসাদ বিষণ্নতা এবং অনিদ্রা আপনার জীবনের অঙ্গ হয়ে যাবে।
যে-কারণে যারা এই প্রযুক্তি নির্মাণ করেছে যে প্রযুক্তি দিয়ে আমরা রাত জেগে থাকি এই আইপ্যাড, স্মার্টফোন থেকে শুরু করে যতরকম স্ক্রিন আছে, যারা যারা প্রযুক্তি দিয়ে লাভবান হয়েছে, প্রযুক্তি বিক্রি করে যারা লাভবান হয়েছে এই প্রযুক্তি দানবরা কিন্তু রাতে ঘুমায় তারা কিন্তু রাতে জাগে না।
ইয়াহুর যিনি প্রধান নির্বাহী তিনি চার ঘণ্টা ঘুমান কিন্তু রাতে এবং ভোর সাড়ে চারটায় তিনি ওঠেন। ইমেইল চেক করেন। তারপরে জিমে চলে যান।
আর ইয়াহু আমরা যারা ব্যবহার করি, ভোর সাড়ে চারটায় ঘুমোতে যাই।
তারপরে টুইটার। টুইটারের যিনি সহপ্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসি। তিনি ভোর সাড়ে পাঁচটায় ওঠেন। উঠে প্রথম মেডিটেশন করেন।
এবং তারপর ছয় মাইল জগিং করেন। এরপরে দিনের কাজ শুরু করেন।
অর্থাৎ প্রযুক্তি দানব যারা, প্রযুক্তি ব্যবহার করে যারা বিলিয়ন বিলয়ন ডলার উপার্জন করেছেন, তারা কিন্তু এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের ঘুম হারাম করেন নাই। তারা নিজেরা ভালোমতন ঘুমিয়েছেন এবং বুদ্ধি পাকিয়েছেন যে অন্যের ঘুম কীভাবে হারাম করা যায়।
তো আসলে আপনি দুটো হতে পারেন। রাতের প্যাঁচা হতে পারেন। প্যাঁচা কী করে জানেন তো? রাতে জেগে থাকে।
আবার ঐ যে, ছড়া আছে না- ‘আমি হবো সকাল বেলার পাখি’। রাতের প্যাঁচাও হতে পারেন, সকালবেলার পাখিও হতে পারেন। এখন কী হবেন এটা হচ্ছে আপনার ওপরে নির্ভর করছে।
একদিন দুইদিন পরীক্ষার জন্যে তিনদিন চারদিন রাত্রি জাগলেন এটা আলাদা ব্যাপার। কিন্তু রাত জাগাটাই যখন অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই, বিশেষত মেলাটোনিন এই যে হরমোন, এই হরমোনের সাইকেলটা নষ্ট হয়ে যায়। হরমোনের প্রবাহের যে ছন্দ এই ছন্দটা নষ্ট হয়ে যায়।
এবং এটা ছন্দ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে কী হয়, জ্বর জ্বর ভাব থাকে। জ্বর না। থার্মোমিটার লাগালে জ্বরর নাই কিন্তু জ্বর জ্বর ভাব। ঠান্ডা লাগা, এসিডিটি এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায়।
অনিদ্রা তো আছেই। এবং অনিদ্রার পরিণতি হচ্ছে অল্প বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া। এবং তার যে বুদ্ধিবৃত্তিক যে কর্মধারা সৃজনশীলতা বলেন প্রাণবন্ততা বলেন কর্মতৎপরতা বলেন কমে যায় যদি রাতের ঘুমটা ঠিকভাবে একজন ঘুমোতে না পারে।
সবসময় মনে রাখবেন- প্রকৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী ওষুধ। রাতে যদি আপনি ঘুমান এবং সকালবেলা যদি ওঠেন চিকিৎসার পেছনে আপনার ব্যয় হবে সবচেয়ে কম। অর্থাৎ চিকিৎসা ব্যবসায়ীরা আপনার টাকা লুটে নিতে পারবে না হাইজ্যাক করতে পারবে না।
এক, রাতে যদি জাগেন তাহলে আপনার এই যে দেহঘড়ি, এই দেহঘড়িটা নষ্ট হয়ে যায়। জৈবছন্দ, যেটাকে বায়োরিদম বলা হয় ইংরেজিতে, এই বায়োরিদমটা নষ্ট হয়ে যায়।
এবং এই বায়োরিদমের কথা আমরা ৪০ বছর ধরে বলে আসছি যে, এই ছন্দটাকে নষ্ট করবেন না। আপনার দেহের একটা ছন্দ আছে। এই ছন্দ অনুসারে কাজ করবেন।
দুই, দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাবার হচ্ছে সকালের নাশতা। আমাদের পূর্বপুরুষরা কিন্তু নাশতা করত না। তারা ভাত খেত। এবং এইজন্যেই তারা এত শক্তিমান ছিল বুদ্ধিমান ছিল।
এই যে আমাদের কোয়ান্টারা সকালে নাশতা করে না, সকালে ভাত খায়। যে কারণে তাদের সাথে মানে দৌড়ে কেউ পারে না তো।
এই যে আর্সেনাল ক্লাবের যে মানে খেলোয়াড়দের মানে খাবার হচ্ছে যে সকালবেলা চাল সিদ্ধ। চাল সিদ্ধ মানে কি? ভাত। সবজি, ডাল।
মানে আর্সেনাল ক্লাবের যে কোচ, যিনি ২২ বছর কোচ ছিলেন, যিনি ক্লাবকে দাঁড় করিয়েছেন, তিনি দেখলেন অনেক গবেষণা করে যে বাঙালি খাবার না খেলে খেলোয়াড়দের এনার্জি বাড়ে না। তাদের স্ট্যামিনা বাড়ে না।
এই যে আমাদের কোয়ান্টারা, দৌড় দিলে কী হয়? অন্যরা তাকিয়ে থাকে। কারণ সে আর দৌড় দেয়ার সাহস পায় না। এমনকি ম্যারাথন দৌড়ে দেখা গেছে যে, শেষ পর্যন্ত যে আচ্ছা আমাদেরকে একটু থার্ড ফোর্থ তো দেবেন জায়গা। তো থার্ড ফোর্থ জায়গা দেয়ার জন্যে কী করা হয়েছে যে, তাদেরকে মোটরসাইকেলে করে নিয়ে, বলে যে আচ্ছা ঠিক আছে এবার দৌড় দাও।
তো এই সকালের নাশতা ভরপেট নাশতা, রুটি ভাত যেটা পাওয়া যায়। রুটি ভাত একই জিনিস। সেটা দিয়ে ভরপেট নাশতা।
তো সকালের নাশতা এটা হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী।
আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি, তারা ২০১৯ সালে একটা গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেটা হচ্ছে সকালের নাশতা জীবন রক্ষাকারী হতে পারে।
আর সকালের নাশতা যদি বাদ দেয়া হয় তাহলে কী হয়? আমাদের অনেকে এখন কী করে? এখন কিন্তু ব্রেকফাস্ট করে না। এখন ব্রাঞ্চ করে দুপুর ১২টার সময়। ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চ একত্রে এটার নাম হচ্ছে ব্রাঞ্চ।
এবং এই ব্রাঞ্চ যারা করে তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার ঝুঁকি ১৯ শতাংশ বেশি। এবং সকালবেলা যারা ওঠে পরীক্ষার স্কোর তাদের ভালো। যারা দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে তাদের পরীক্ষার স্কোর খারাপ। মর্নিং শিফটে যারা ক্লাস করে তাদের পরীক্ষার স্কোর ভালো, ইভনিং শিফটে যারা ক্লাস করে তাদের চেয়ে।
তো আমাদের এই কোয়ান্টারা, বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট চুয়েট তারপর মেডিকেলে আছে। এই বছর নিয়ে ১৫৪ জন বঞ্চিত পাহাড়ের কোনো স্কুল থেকে আজ পর্যন্ত এত ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল বা কোথাও ভর্তি হয় নি।
তো কেন? তারা সাড়ে ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালবেলা উঠে ফজরের সময়, ব্যায়াম করে, ইয়োগা করে, তারপর মেডিটেশন করে।
এবং তারপরে ভরপেট নাশতা করে, ভাত খায়। আমাদের পূর্বপুরুষরা যেরকম ভাত খেতেন। তারাও ভাত খায়। সবজি খায় ডাল খায়। এবং সেইসাথে ডিমও খায়।
ব্যস! তাদের এনার্জি তাদের ফিটনেস যে-কোনো স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে অনেক অনেক ভালো। কেন? এই কারণে যে তারা রাতে ঘুমায় এবং সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠে।
তো আসলে যখন একজন মানুষ রাত্রি ১১টার মধ্যে ঘুমোতে যায় এবং ফজরের সময় ওঠে তখন তার জীবনে শৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
এবং জীবনে এই শৃঙ্খলাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে ডায়াবেটিক সমিতির মেম্বার হয়ে জানতে হবে মানে ৪০ বছর ৫০ বছর বয়সে যে, ডিসিপ্লিন ইজ লাইফ। আরে এটা জানতে হবে স্কুলে থাকতে! শিশুশ্রেণিতে যে ডিসিপ্লিন ইজ লাইফ, যে শৃঙ্খলা হচ্ছে জীবন। এটা শিখতে যদি ৫০ বছর লাগে তো আর কয় বছর বাঁচবেন!
তখন তো মিষ্টি খেতে পারবেন না, তখন এইটা খেতে পারবেন না, ঐটা খেতে পারবেন না। এইটা খেলে সুগার বাড়বে, এইটা খেলে সুগার কমবে। ঐটা খেলে হাইপো হবে, ঐটা হলে আরো কী কী হয়। অনেক কিছু হবে।
তো আসলে এই যে শৃঙ্খলা, যখন আপনি তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাবেন এবং ফজরের সময় সুবহে সাদিকে উঠবেন মানে ভোরবেলা উঠবেন, সূর্যের কিরণ আসার আগে উঠবেন তখন কী হবে?
আমাদের কবিগুরু কী করতেন? সূর্যের কিরণ ওঠার আগে উঠতেন। অর্থাৎ আজানের সময় তিনি উঠতেন। উঠে তিনি ধ্যানমগ্ন হতেন যেন সূর্যের কিরণ তার চেহারার ওপর এসে পড়ত, তখন তিনি ধ্যান থেকে উঠে তার প্রতিদিনের কাজ শুরু করতেন। যে কারণে দেখেন না তার বইয়ের যে পরিমাণ কত! কত যে কাজ করেছেন তার শেষ নাই।
তো একজন মানুষ এই ডিসিপ্লিনটা সৃষ্টি হয়। কবিগুরু অত্যন্ত ডিসিপ্লিনড অত্যন্ত সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করেছিলেন বলেই এত রচনা এত লেখা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে।
সাইকোলজিস্টরা গবেষণা করেছেন ধরেন একজন মানুষের ডিসিপ্লিন এবং মেধার অনুপাত, মেধার অনুপাত ৯৩ শতাংশ, ডিসিপ্লিনের অনুপাত হচ্ছে সাত শতাংশ। তার জীবনে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম।
আর একজন মানুষ যদি ৯৩ শতাংশ ডিসিপ্লিনড হয় এবং সাত শতাংশ মেধা থাকে, তার জীবনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
কারণ শৃঙ্খলা মানেই হচ্ছে নিয়ম। শৃঙ্খলা মানে হচ্ছে একটা প্রক্রিয়া। শৃঙ্খলা মানে হচ্ছে একটা চর্চা। শৃঙ্খলা মানে হচ্ছে একটা অনুশীলন।
এবং যিনি নিয়মিত অনুশীলন করেন তার যে সাফল্য এটা অন্য কারো জীবনে আসতে পারে না। ৯৩ শতাংশ মেধা নিয়ে তিনি ব্যর্থ হতে পারেন।
আপনিই দেখেন, জোসেফ স্কুলিং, সিঙ্গাপুরে অলিম্পিকে প্রথম স্বর্ণজয়ী সাঁতারু। তার ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল যে, অলিম্পিকে সোনা জিতবে।
তার বয়স যখন আট বছর, তার বাবা তাকে বেড়াতে নিয়ে গেছেন। ভোর চারটার সময় উঠে বাবাকে নক করছে বাবার হোটেল রুমে।
বাবা! আমাকে সুইমিং পুলে নিয়ে চলো। আমাকে প্র্যাকটিস করতে হবে।
চিন্তা করেন! আট বছরের একটা ছেলে ভোর চারটায় বাবার রুমে নক করছে যে, বাবা! আমাকে সুইমিং পুলে নিয়ে চলো।
বেড়াতে গেলে তো আমরা কী মনে করি? যে আরে! কীসের প্র্যাকটিস! এখন আমি বেড়াচ্ছি। কী সমুদ্রের পাড়ে বসে, বালুর ওপরে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। কীসের প্র্যাকটিস!
এবং তার যিনি আইডল ছিলেন, যিনি আদর্শ ছিলেন, মডেল ছিলেন মাইকেল ফেল্পস। তার সাথে ছোটবেলায় তিনি ছবি তুলেছেন যে, এই হচ্ছে আমার মডেল। এবং ফেল্পসকে এক সেকেন্ডের ব্যবধানে হারিয়েছেন।
এবং ফেল্পসের মহত্ম হচ্ছে তিনি তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, তুমি জিতেছ!
তো ডিসিপ্লিন এই শৃঙ্খলাটা হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ জীবনের জন্যে।
আপনি দেখেন, এই যে এপিজে আব্দুল কালাম ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন।
তিনি নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে অংক কষতে চলে যেতাম শিক্ষকের কাছে।
শিক্ষক পাঁচজনকে অংক করাতেন দেড় ঘণ্টা। এরপর সাড়ে পাঁচটায় ছুটি পেয়ে তিন কিলো দৌড়াতেন। দৌড়ে স্টেশনে যেতেন। স্টেশনে তখন গাড়ি থামত না। স্টেশনে পত্রিকা ঐ গাড়ি থেকে ছুঁড়ে মারত।
তো সেই ছুড়ে মারা পত্রিকা সংগ্রহ করে নিয়মমতো ছুড়ত, এমনি ছুঁড়ে দিত না। গাড়ি থামার কোনো সুযোগ নাই। জাস্ট দিয়ে দিল। এবং সেটা শহরে ফেরি করতেন, বিলি করতেন তিনি।
অর্থাৎ পড়াশোনার পয়সা জোগাড় করার জন্যে হকারি করা, পত্রিকা বিলি করা এবং এই মেহনত এই পরিশ্রম করে তিনি কী করেছেন? ৮০ বছর বয়সেও কাজ করেছেন এবং তিনি মানুষকে উজ্জীবিত করার জন্যে আলোচনা করতেন।
এবং আলোচনার ডায়াসে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে তিনি মারা যান। অর্থাৎ কর্মময় মৃত্যু। ডিসিপ্লিন।
এপিজে আব্দুল কালামের জীবনে যে শৃঙ্খলা যদি দেখেন, অসাধারণ সুশৃঙ্খল জীবন। এবং সেজন্যে তিনি জেলের ছেলে হয়েও লেখাপড়া শিখে এত বড় হতে পেরেছেন।
এই যে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক, মাহাথির মুহাম্মদ। যিনি ৯২ বছরে আবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।
তিনি প্রথম মালয়েশিয়াতে কর্মচারিদের উপস্থিতির সময়টাকে ঠিক করার জন্যে এই পাঞ্চকার্ডের ব্যবস্থা করেন। এবং সমস্ত সরকারি কর্মকর্তাদের অফিসে ঢোকার সময় পাঞ্চকার্ডে সময় লিপিবদ্ধ হয়ে যেত।
তো টাইম ম্যাগাজিন তার অফিস সময় অর্থাৎ উনি কখন ঢোকেন অফিসে, পাঁচদিন পর পর ওখানে থেকে রেকর্ড করেছে।
এবং তার মধ্যে, একদিন হচ্ছে সকাল ৭টা ৫৭ মিনিট, একদিন সকাল ৭টা ৫৬ মিনিট, আরেকদিন সকাল ৭টা ৫৭ মিনিট, আরেকদিন সকাল ৭টা ৫৯ মিনিট, আরেকদিন সকাল ৭টা ৫৭ মিনিট। আটটা বাজার আগেই তিনি অফিসে ঢুকতেন।
প্রধানমন্ত্রী উনি অফিসে ঢুকলে কী না ঢুকলে কী! ওনার তো সবই অফিস। বাসাও অফিস, বেডরুমও অফিস, সবই অফিস। তারপরও যেটা বাস্তব অফিস সে অফিসে আটটা বাজার এক মিনিট আগে হলেও তিনি অফিসে ঢুকেছেন।
তো এই যে ডিসিপ্লিন এই ডিসিপ্লিনটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট।
নবীজী (স) কিন্তু বলেছেন, খুব সহজভাবে যে, ‘হে আল্লাহ! আমার উম্মতের জন্যে সকালকে বরকতময় করে দাও’।
এবং রসুলুল্লাহর (স) কন্যা, মা ফাতেমা (রা) তার বর্ণনা হচ্ছে, একদিন রসুল (স) ভোরবেলা এসে আমাকে ঘুমে দেখতে পেলেন।
তখন তিনি আমাকে নাড়া দিয়ে বললেন, হে প্রিয় কন্যা! ওঠো! তোমার রবের পক্ষ থেকে রিজিক গ্রহণ করো। অলসদের দলভুক্ত হয়ো না। কারণ আল্লাহতায়ালা সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত মানুষের মাঝে রিজিক বণ্টন করে থাকেন।
বাইবেলে কী আছে? বাইবেলে আছে, আরেকটু ঘুম আরেকটু তন্দ্রা বিছানায় আরেকটু গড়াগড়ি, দারিদ্র্য ও অভাব দস্যুর মতো হানা দেবে তোমার অন্দরে।
যদি বিছানায় আরেকটু গড়াগড়ি কী হবে? দারিদ্র্য ও অভাব দস্যুর মতো হানা দেবে তোমার অন্দরে। তোমার ঘরে।
ধম্মপদে বলা হয়েছে, আলস্য ও অতিভোজনের দরুন স্থূলকায় নিদ্রালু হয়ে বিছানায় গড়াগড়ি দেয়া স্বভাবে পরিণত হলে সেই মূর্খের জীবনে দুঃখের পুনরাবৃত্তি ঘটবে!
ভগবদ্গীতায়, ধ্যানযোগে ১৬ এবং ১৭ নম্বর শ্লোক হচ্ছে, যিনি নিয়মানুযায়ী আহার করেন, কাজ করেন, বিশ্রাম নেন, যার নিদ্রা ও জাগরণ নিয়মের ছন্দে ছন্দায়িত, তিনি ধ্যানে সফল হন। তার দুঃখের বিনাশ ঘটে। বিচরণ করেন আত্মার আনন্দলোকে।
আসলে যাদের ঘুমে একটু প্রবলেম হয় আসতে চায় না, কী করবেন? বিছানায় শুয়ে যান। দম নিতে থাকেন, দম ছাড়তে থাকেন। চলে আসবে।
আর ঐ সময় স্রষ্টাকে স্মরণ করতে থাকবেন। স্রষ্টাকে যেই নামে ডাকেন, ভগবান নামে ডাকেন ঈশ্বর নামে ডাকেন আল্লাহ নামে ডাকেন, আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকেন। ‘ঈশ্বর ঈশ্বর’ করতে থাকেন, ভগবান ভগবান জপতে থাকেন।
কারণ শয়তান একটিভ হয়ে যাবে যে, ব্যাটা! ঘুম না আসা পর্যন্ত তো খালি আল্লাহ আল্লাহ করবে! ঘুম পাড়িয়ে দাও ওকে! দেখবেন যে, ঘুম চলে আসছে। আল্লাহর নাম নিতে নিতেই দেখবেন যে আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
তো আসলে ১১টায় ঘুমোতে যাওয়া এবং ফজরের সময় ওঠা এটা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হোক। এবং আমাদের জীবন সুশৃঙ্খল হোক, কর্মময় সফল সৃজনশীল জীবনযাপন করি, জীবনযুদ্ধে সবাই জয়ী হই।