আমি প্রাইমারি পড়াশোনা করেছি খুলনার এক মিশনারি স্কুলে। তারপর আমার হাই স্কুল জীবন শুরু হয় ঢাকায়, আমাদের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর একটা প্রতিষ্ঠান জ্যোতি বিদ্যানিকেতনে। অনেক সুন্দর সময় পার করেছি ওখানেও। একজন ম্যাডাম আমাদের বাংলা পড়াতেন খুব সুন্দর করে। আমার বাংলা ভাষা সঠিকভাবে আয়ত্তের কারিগর তিনি। আর বিজ্ঞান পড়ার মজাটা পেয়েছিলাম স্বপন স্যারের কাছ থেকে। আমাদের প্রিন্সিপাল উখ্যিং ম্যামেরও অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। তার কাছেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন পেয়েছিলাম।
আমার বাবার খুব ইচ্ছে ছিল আমি যেন কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে পড়ি। সেই সূত্রে কসমো স্কুলে ২০১৬ সালে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হই। আমি সায়েন্স নিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় নম্বর কিছুটা কম থাকার কারণে স্যার প্রথমে আমাকে সায়েন্স দিতে রাজি হন নি। পরে তিনি আমার আগ্রহ দেখে সায়েন্স বিভাগে সুযোগ দেন। আর বিজ্ঞানের প্রতি আমার আগ্রহ অনেক আগে থেকেই। অষ্টম শ্রেণি থেকে আমার ইচ্ছে ছিল সিএসই (কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং) নিয়ে পড়ার।
কোয়ান্টামে আমার সময়গুলো খুব দ্রুত কেটে গেছে। তবে অনেক মূল্যবান ছিল সময়গুলো। সুজন স্যারের কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। তার সাথে সুন্দর কিছু স্মৃতি আছে। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার সুজন স্যারের সাথে।
মনে আছে, বিজ্ঞানমেলায় অংশগ্রহণের জন্যে প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করার মুহূর্তগুলো। অটোমেটিক ইরিগেশন সিস্টেম, লাইন ফলোয়ার রোবট, আল্ট্রা-সাউন্ড সেন্সর রোবট—আরো কত কী! খুব মজা লাগত। আব্দুর রাব্বি তোতা আমার সহপাঠী। সে-ও এখন কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছে। আমরা দুজন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কম্পিউটার ল্যাবে যেতাম। যদিও ক্লাস ফাঁকি দেয়াটা অনেক কঠিন ছিল। তারপরও কীভাবে যেন ম্যানেজ হয়ে যেত। ল্যাবে গিয়ে প্রোগ্রামিং শিখতাম। তখন ল্যাব টিচার আমাদের কিছুটা প্রশ্রয় দিতেন। বিজ্ঞান প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন প্রজেক্ট বানিয়ে আমরা লামা ও বান্দরবান দুই জায়গায় প্রথমবার অংশগ্রহণ করেই প্রথম হয়েছিলাম।
আমার সবচেয়ে অবাক লাগত শোভন স্যারকে দেখলে। সেই শুরু থেকেই তিনি আমার নজর কাড়েন। আমরা এতজন কোয়ান্টা কিন্তু সবার নাম আর কোয়ান্টা নম্বর কেমন করে যেন মনে রাখতেন। আবার প্রত্যেকের ব্যাপারে তিনি বিস্তারিতও জানতেন। আমাকে তা সত্যিই অবাক করত।
আমি এসএসসি ও এইচএসসিতে এ প্লাস পেয়েছিলাম। এরপর ইউনিভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার সময় করোনা পরিস্থিতির কারণে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। তাই ভর্তি প্রস্তুতি আমাকে ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে নিতে হয়েছে। এক্ষেত্রে আমি সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছি লেংঙি ভাইয়ের কাছে। তিনিও একসময় কোয়ান্টা ছিলেন। এখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়ছেন। আমি ও আমার বন্ধুরা তার কাছে পড়তাম। লেংঙি ভাই বাংলা ও ইংরেজি পড়াতেন। বিজ্ঞানের শিক্ষক না থাকায় আমাদের নিজেদের পড়ে নিতে হতো। আরেক কোয়ান্টা শৈক্যচিং ভাইও পড়াতে এসেছিলেন। তিনি এখন বুয়েটে পড়েন। এরপর করোনার কারণে আমাদের ভর্তি পরীক্ষা পিছিয়ে গেল।
এসময় আমার আর্থিক সমস্যাও দেখা দিল। আমি বাড়ি চলে এলাম। কম্পিউটারের বিভিন্ন কাজ শিখতে শুরু করলাম, যাতে ভবিষ্যতে কাজে লাগে। এরপর ভর্তি পরীক্ষার সময় দেয়া হলে আমি আবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম এবং কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্ট পেলাম।
আমার দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে এতদূর নিয়ে এসেছে, যা আমি প্রথম শিখেছিলাম আমার মায়ের কাছে। আর এই শিক্ষার পূর্ণতা পেয়েছে কোয়ান্টামে এসে। এছাড়াও আমার ব্যক্তিত্ব বিকাশে বৈজ্ঞানিক জীবনাচার, আচার-আচরণে শুদ্ধাচার, শরীরচর্চার জন্যে ইয়োগা আমি কোয়ান্টাম থেকেই শিখেছি। আমাদের মার্মা সম্প্রদায় শিক্ষায় এখনো পিছিয়ে আছে। তাদের শিক্ষিত করার কাজে থাকতে চাই। এছাড়াও কম্পিউটার সায়েন্সের ওপর আমি নিজের কিছু গবেষণাপত্র বের করতে চাই যেটা মানুষের কল্যাণে কাজে লাগবে। আরেকটি স্বপ্ন আমি এখনো দেখি, তা হলো প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমি মা-বাবাকে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে দেখাতে চাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে একটা ধানী জমির মাঝে এখন আমাদের হোস্টেল। পরিবেশটা অনেক সুন্দর। চারপাশে সবুজ ধান আর জমি। বিকেলের হালকা হাওয়ায় মাঝে মাঝে মনটাও অতীতে হারিয়ে যায়। একের পর এক ছবি ভাসতে থাকে মনের ক্যানভাসে। ভাগ্যবান মনে হয় নিজেকে। কত সুন্দর সুন্দর সময় পেয়েছি আমি! কত চমৎকার মানুষদের সাথে আমার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। সেই মুহূর্তগুলোকে মনে পড়ে অনেক।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]