জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্প নির্মাণের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চরম দুর্নীতি হয়ে থাকে। এই দুর্নীতি কমানোর একটি বাস্তবমুখী পদ্ধতি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। প্রথমত, যখন স্থানীয় প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যরা নিজ স্বার্থে প্রকল্পে দুর্নীতি প্রতিরোধে তদারক করতে শুরু করে, দুর্নীতি দ্রুত কমে আসে। দ্বিতীয়ত, এবং আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ যখন জলবায়ু প্রকল্পের ‘দ্বৈত ব্যবহারের’ দিকগুলো জোরদার করা হয়, প্রভাবশালী পরিবারগুলোর তদারকি বেড়ে যায়, কারণ প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে তারা তাৎক্ষণিকভাবে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়।
অতএব, জলবায়ু প্রকল্পের ডিজাইন যদি কিছুটা রদবদল করে দ্বৈত ব্যবহারের দিকগুলোকে আরো জোরদার করা যায় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রভাবশালীদের বাড়তি তদারকির ফলে দুর্নীতে কমে যাবে। আমরা জানি যে জলবায়ু প্রকল্পে দ্বৈত ব্যবহারের সুযোগ থাকে, যেমন বাঁধ সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে বা ঘূর্ণিঝড়ের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হতে পারে স্কুল বা কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে। যে প্রকল্পে দ্বৈত ব্যবহারের সম্ভাবনা বেশি, সেগুলোয় দীর্ঘমেয়াদি লাভ ছাড়াও স্থানীয় সমাজের তাৎক্ষণিক ফায়দাও বেশি হয়। বিশ্বের জলবায়ুগতভাবে সবচেয়ে নাজুক দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। প্রতি বছরই দেশটির নিম্নভূমি ও উপকূলীয় অঞ্চলগুলোয় বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড় মানুষের জীবন, সহায়-সম্পদ, ভূমি ও অবকাঠামো বিপর্যস্ত করে, হুমকিতে ফেলে। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা ও অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের পৌনঃপুনিকতা ও তীব্রতা অনুমান করা হচ্ছে বাড়বে, সেহেতু সরকার ও উন্নয়ন সহায়ককারীরা অভিযোজন অবকাঠামোয় বিনিয়োগের জন্য কয়েক বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থের প্রয়োজন স্বীকার করে।
এসব বিনিয়োগ গত দশক থেকে শুরু হয়েছে। বিশেষত বন্যাপ্রবণ এলাকায় নদী-তীরবর্তী বাঁধ এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অর্থ অবৈধ সাবকন্ট্রাক্টিংসহ ব্যাপক দুর্নীতির কারণে সেগুলোর বাস্তবায়ন অনেকাংশে ব্যাহত হয়েছে। দুর্নীতি দমনের অনেক আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন প্রকল্পে প্রক্রিয়াগত স্বচ্ছতা, জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা এবং জবাবদিহিতার ঘাটতির কারণে বড় আকারে দুর্নীতি দেখা যায়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সমীক্ষায় ৩৮টি জলবায়ু প্রকল্প থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অনুমান করা হয় যে প্রায় ৩৫ শতাংশ তহবিল তছরুপ হয়েছে। এ মাত্রার দুর্নীতির কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিম্নমানের অভিযোজন অবকাঠামো তৈরি হয়ে থাকে। তবে সব জলবায়ু প্রকল্প সমানভাবে দুর্নীতির শিকার হয়নি, এমনকি একই প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে বাস্তবায়ন হলেও।
সোয়াসের অ্যান্টি-করাপশন এভিডেন্স রিসার্চ কনসোর্টিয়াম (SOAS-ACE) এবং আমাদের সহযোগী টিআইবির যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে এসব প্রকল্পে দুর্নীতির পার্থক্যের কারণ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তদারকির মাত্রা এবং কার্যকারিতায় পার্থক্য রয়েছে। এই তদারকির মাত্রা ও কার্যকারিতা বাড়ানোর উপায়ও আমরা শনাক্ত করেছি। স্থানীয় তদারকি ভালো হয় যদি প্রভাবশালী পরিবারগুলো নিজ স্বার্থে তদারকিতে নেমে পড়ে। বাংলাদেশের মতো দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের কাঠামো দুর্বল হলেও স্থানীয় প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যরা যখন ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চায়, তখন তারা অনানুষ্ঠানিক চাপ ও অনানুষ্ঠানিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানগুলো এবং আইনের শাসন অত্যন্ত দুর্বল, যা ঠিক করতে দীর্ঘদিনের সংগ্রাম প্রয়োজন।অনানুষ্ঠানিক চাপ এভাবে কাজে লাগাতে পারলে দুর্নীতি দমন অনেক বেশি কার্যকর করা সম্ভব বলে মনে হয়।
এ যুক্তি পরীক্ষা করার জন্য আমরা সম্প্রতি শেষ হওয়া চারটি প্রকল্পের আশপাশে বসবাস করা দুই হাজার পরিবারের ওপর জরিপ চালিয়েছি। এই চারটি প্রকল্পে (দুটি বাঁধ ও দুটি আশ্রয়কেন্দ্র) দুর্নীতির পরিমাণে অনেক পার্থক্য ছিল। আমাদের জরিপে মূলত দুটি প্রশ্ন ছিল, (ক) এই ধরনের জলবায়ু প্রকল্পে তাৎক্ষণিকভাবে সবচেয়ে বেশি লাভবান কোন ধরনের পরিবার হয়ে থাকে এবং (খ) কোন ধরনের পরিবার তদারকিতে জড়িত হলে দুর্নীতির ওপর সবচেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি হয়। এই চারটি প্রকল্পে দুর্নীতির মাত্রা নির্ণয় করা হয় ৩০ জন স্থানীয় বিশেষজ্ঞ তথ্যদাতার কাছ থেকে দুর্নীতির ছয়টি ডাইমেনশনের ওপর প্রকল্পওয়ারি তথ্য সংগ্রহ করে। জরিপে দেখা যায় যে জমির মালিক আর ব্যবসায়ী সমাজ প্রকল্পগুলোর সবচেয়ে বড় সুফলভোগী কিন্তু তাদের লাভের মাত্রা নির্ভর করে প্রকল্পগুলোর আঙ্গিক এবং নকশার ওপর। যে প্রকল্পের ডিজাইনের ফলে জমি আর ব্যবসার মালিকরা বেশি লাভবান হন, সেই প্রকল্পে তারা বেশি তদারক করেন। ফলে এ প্রকল্পে দুর্নীতিও কম হয়।