1. [email protected] : আরএমজি বিডি নিউজ ডেস্ক :
সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:০০ অপরাহ্ন

জীবনের লক্ষ্য বলতে কী বোঝায়? কীভাবে তা দেখবো?

  • সময় মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২
  • ৫৪২ বার দেখা হয়েছে

জীবনের মূল লক্ষ্য হলো পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে আপনার আগমনকে অর্থবহ করা। আর তার উপায় হলো নিজেকে জিজ্ঞেস করা যে, কেন এসেছি আমি, কী করতে চাই। একটাই তো জীবন। এ জীবনটাকে আমি কীভাবে উপভোগ করতে চাই, সময়টাকে কীভাবে ব্যয় করতে চাই, চারপাশের মানুষের কাছ থেকে আমি কী চাই? তাদেরকে কী দিতে চাই? এ প্রশ্নগুলোর উত্তরই হচ্ছে জীবনের লক্ষ্য, জীবনের মনছবি বা জীবনছবি। এর আরো সহজ উপায় হচ্ছে-আপনি নিজের মৃত্যু সংবাদকে কীভাবে দেখতে চান, শুনতে চান সেটাকে অবলোকন করা। কারণ একজন কীর্তিমান মানুষের মৃত্যু সংবাদেই থাকে তার জীবনের সব অবদানের কথা। আপনার সুবিধার্থে এখানে তেমনি একটি কাল্পনিক সংবাদের বিবরণ দেয়া হলো-

ডা. তাসনীম জাহান আর নেই। গত ২০ মে রাত ১১টায় ঢাকার গুলশানে নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেছেন প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী প্রফেসর ডা. তাসনীম জাহান (ইন্নালিল্লাহে —— রাজেউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৭০ বছর। উপমহাদেশে কিডনি রোগের চিকিৎসা ও গবেষণার অন্যতম এই দিকপালকে হারিয়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া। আজ বাদ জোহর নামাজে জানাযার পর তার লাশ গাজীপুরে তার প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের গোরস্থানে দাফন করা হবে।

জন্ম ও ছেলেবেলা প্রফেসর তাসনীম জাহান ১৯৪১ সালে বর্তমান নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরের এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। রেলওয়ের একজন সাধারণ কর্মচারী বাবার পক্ষে আট সন্তানকে লেখাপড়া শেখানো সম্ভব ছিলো না। তাই বড় দুই বোনকে অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু ছোট তাসনীমের পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখে তাদের বড় ছেলেটির সঙ্গে তাকেও স্কুলে পাঠান মা-বাবা। অসাধারণ মেধার পরিচয় দিয়ে অচিরেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেন শিক্ষকদের। স্কুলের প্রতিটি পরীক্ষায় ফার্স্ট হতেন তিনি।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় সহপাঠীদের নিয়ে গড়ে তোলেন কিশোর-কিশোরীদের সংগঠন ‘আমরাও পারি’, যাদের প্রধান কাজ ছিলো কন্যাশিশুদের স্কুলে পাঠাতে অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করা। শিক্ষা ও কর্মজীবন মেট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট-দুই পরীক্ষায়ই ডা. তাসনীম জাহান সম্মিলিত মেধাতালিকায় যথাক্রমে তৃতীয় এবং প্রথম স্থান লাভ করেন।

এরপর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান লাভ করে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এমবিবিএস সম্পন্নের পর কানাডা সরকারের বৃত্তি নিয়ে তিনি চলে যান বিখ্যাত ম্যাকগিল মেডিকেল স্কুলে। কৃতিত্বের সাথে এমডি ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা দুটি মেডিকেল স্কুল থেকে একইসাথে দুটি পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এমআরসিপি-তে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং প্রথম এশীয় হিসেবে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে কিডনি বিশেষজ্ঞ হিসেবে যোগ দেন।

এরপর ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ফ্লোরিডা এবং ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটায় শিক্ষকতার পর তিনি যোগ দেন মেরিল্যান্ডের জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট বিভাগে। চিকিৎসাসুবিধা এবং সেবামানের বিবেচনায় জন হপকিন্স মেডিকেল হসপিটালকে যুক্তরাষ্ট্রে এক নম্বর বিবেচনা করা হয়। গবেষণা চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার অনন্য অবদানের জন্যে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

১৯৯১ সালে ম্যাকগিলের নেফ্রোলজি ইনস্টিটিউটে তিনি একটি গবেষণা প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে পিএইচডি ডিগ্রিও প্রদান করছে। তার অনেকগুলো গবেষণার একটি হলো কিডনির রক্ত পরীক্ষা। এর আগে কিডনি ফেইলিওরের ঘটনাকে আগেভাগে শনাক্ত করার কোনো উপায় ছিলো না। কিন্তু তার উদ্ভাবিত প্রক্রিয়ায় মারাত্মক পর্যায়ে চলে যাবার আগেই তা শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে বাঁচানো যাচ্ছে মূল্যবান জীবন।

ডা. তাসনীম ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী চিকিৎসক। রোগীকে বাহ্যিকভাবে পরীক্ষা করেই সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়ের এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিলো তার। কীভাবে তিনি এটা করেন, জানতে চাওয়ায় প্রফেসর তাসনীম বলেছিলেন রোগীর প্রতি সমমর্মিতা, আন্তরিকতা ও মনোযোগই তাকে তথ্য যোগায়। দেশে প্রত্যাবর্তন কিডনি রোগে তার চিকিৎসা ও গবেষণার অভিজ্ঞতাকে দেশের সেবায় কাজে লাগানোর জন্যে বিদেশের সফল ক্যারিয়ার, খ্যাতি, যশ সবকিছুকে উপেক্ষা করে ডা. তাসনীম জাহান ১৯৯৫ সালে ফিরে আসেন দেশে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে শুরু করেন দেশে তার নতুন কর্মজীবন। বাংলাদেশে কিডনি চিকিৎসায় পোস্ট গ্রাজুয়েট শিক্ষার তিনিই পথিকৃৎ।

২০০৫ সালে তার উদ্যোগে গাজীপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়ার বৃহত্তম ‘নির্বাণ কিডনি হাসপাতাল’। এ কাজে তিনি ব্যয় করেন তার গবেষণালব্ধ অর্থের পুরোটাই। সুলভে আধুনিকতম চিকিৎসাসেবার জন্যে এটি এখন বিশ্বখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। সেই সাথে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের কাছে কিডনি চিকিৎসাশিক্ষার একটি পীঠস্থান। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের জন্যে ডা. তাসনীম ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক। প্রতি সপ্তাহে বিনা ফি বা নামমাত্র ফি-তে তিনি দেখতেন শত শত রোগী। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে সারাদেশ ঘুরে আয়োজন করতেন কিডনি মেডিকেল ক্যাম্প। সম্মাননা সেরা কিডনি বিশেষজ্ঞ এবং ৪৫ বছরেরও কম বয়সে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণার জন্যে তিনি লাভ করেন দুটি সম্মানজনক পুরস্কার।

১৯৯৩ সালে প্রফেসর তাসনীম জন হপকিন্সের ফিজিশিয়ান অব অনার্স নিযুক্ত হন। তিনিই প্রথম এশীয় যিনি এ সম্মানে ভূষিত হলেন। আর চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনন্যসাধারণ অবদানের জন্যে স্বাধীনতা পদকসহ একাডেমি অফ সায়েন্স, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্মারক স্বর্ণপদক, গান্ধী শান্তি পুরস্কার ইত্যাদি অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা জাতীয় অধ্যাপক। পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেছেন ৪০টিরও বেশি সম্মানসূচক ডক্টরেট। আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন চিকিৎসাবিষয়ক সেমিনার সিম্পোজিয়ামে তিনি তার গবেষণা ও চিকিৎসা অভিজ্ঞতার ওপর বক্তৃতা দিয়েছেন। মুখোমুখি হয়েছেন বিবিসি, সিএনএন, টাইম ও নিউজউইকসহ বিশ্বখ্যাত টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রের। লেখালেখি এ পর্যন্ত তার ৩৬০টিরও বেশি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বসেরা সব মেডিকেল জার্নালে। এসব জার্নালের সম্পাদকীয় লেখার দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন বিভিন্ন সময়ে।

মেডিকেল স্কুলগুলোতে তার লেখা বই, জার্নাল ছাত্রছাত্রীদের আবশ্যিক পাঠের অন্তর্ভুক্ত। একাডেমিক লেখালেখির পাশাপাশি আত্ম উন্নয়ন বিষয়েও তিনি নিয়মিত লেখালেখি করেছেন। তার জার্নি টুওয়ার্ডস সাকসেস বইটি টানা ২১ সপ্তাহ ধরে নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার তালিকায় ছিলো। সাংগঠনিক জীবনে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ডা. তাসনীম অসংখ্য পেশাজীবী সংগঠন ছাড়াও দেশি-বিদেশি অনেকগুলো দাতব্য ও কল্যাণমূলক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। সফট ও এনার্জি ড্রিংকসবিরোধী সচেতনতা আন্দোলনে উপমহাদেশব্যাপী তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিজ্ঞানশিক্ষা ও গবেষণার প্রসার এবং নারীশিক্ষার জন্যেও তিনি কাজ করেছেন। সৃষ্টির সেবায় অনন্য সংগঠন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় সদস্য। অর্থ সময় মেধা ও শ্রম দিয়ে ফাউন্ডেশনের সেবামূলক প্রকল্পগুলোতে অংশ নিতে ব্যস্ততা কখনো তার অজুহাত হয় নি।

ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুখী এবং সফল মানুষ। তার স্বামী প্রফেসর ডা. ফওজুল করিম একজন নিউরোলজিস্ট। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সাবেক প্রধান। তার দুই মেয়ে দুই ছেলে। বড় মেয়ে ফারদিন করিম কার্ডিওলজিস্ট, কর্মরত আছেন বাংলাদেশ হৃদরোগ হাসপাতালে। ছোট মেয়ে ফারিয়া করিম একজন খ্যাতনামা আর্কিটেক্ট। বড় ছেলে বুলান্দ করিম একজন তরুণ চিত্রপরিচালক, তার নির্মিত বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রগুলো ইতোমধ্যেই বোদ্ধামহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ছোট ছেলে হুসেন করিম একজন পদার্থবিদ।

প্রিয় পাঠক, জীবনছবি কেমন হওয়া উচিত-এটি তার একটি কাল্পনিক উদাহরণ। আপনিও নিজের মতো করে সাজিয়ে নিতে পারেন এ জীবনছবি। তারপর প্রতিদিন মেডিটেশন করতে থাকুন। সেইসাথে লেগে থাকুন প্রাণান্ত প্রয়াসে। সহজ স্বতঃস্ফূর্ততায়ই আপনি এগুবেন মনছবি বাস্তবায়নের পথে।

শেয়ার করুন

এই শাখার আরো সংবাদ পড়ুন
All Rights Reserved © rmgbdnews24.com