নবীজী (স) এর একটি ঘটনা। হজরত আলী (রা) ও রসুলুল্লাহ (স), জামাই শ্বশুর একদিন একত্রে বসে একটি প্লেট থেকে খেজুর খাচ্ছিলেন। রসুলুল্লাহ (স) ইচ্ছে করেই এক একটি খেজুর খেয়ে ভেতরের আঁটি হজরত আলী (রা) এর দিকে ঠেলে দিচ্ছিলেন। হজরত আলী সেটা দেখেও না দেখার ভান করছিলেন।
শেষের দিকে রসুলুল্লাহ (স) স্মিতহাস্যে জামাইকে বললেন, ’দেখো আমার দিকে কোনো আঁটি নেই। তার মানে তুমি একাই প্রায় সবগুলো খেজুর খেয়েছো। হজরত আলী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন আমি তো আঁটি বাদ দিয়ে খেয়েছি, তাই আমার দিকে আঁটি দেখা যাচ্ছে। আর আপনি তো আঁটিসুদ্ধই খেয়ে ফেলছেন, তাই আপনার দিকটায় কোনো আঁটি নেই। এরূপ হাস্যরসে পরিপূর্ণ পরিবেশই হচ্ছে পরিবার।
পরিবার হচ্ছে একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী দুর্গ।পাখি যেমন দিনশেষে তার নীড়ে ফেরে আমরা বাইরে পেশাগত জীবনে যত বড় দায়িত্ব পালন করি না কেন, দিনশেষে পরিবারের দুর্গে ফিরতেই হয়। সারাদিন শত ব্যস্ততার পর আমরা সবাই ঘরে ফিরি একটু প্রশান্তির জন্যে। একটি মানব শিশুর প্রথম পাঠশালা তার পরিবার। মেধার বিকাশে, ব্যক্তিত্ব নির্মাণে প্রতিটি সফল মানুষের সাফল্যের সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি সুখী ও অনুকূল পারিবারিক পরিবেশ। পরিবার একজন মানুষের শেকড়, আশ্রয়স্থল, ভরসাস্থল, উজ্জীবনী শক্তি।
সেই পরিবারকে আনন্দের ভুবনে পরিণত করতে পরিবারে কোয়ালিটি সময় দিন- পারিবারিক সম্পর্কগুলোকে গ্যারান্টেড হিসেবে ধরে নিই বলে পরিবারে সময় দেয়ার গুরুত্ব অনুধাবন করি না। প্রতিদিন একই মুখগুলো দেখি বলে আমরা অনেক সময় মনোযোগ হারিয়ে ফেলি, তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি না।
অনেকে সারাদিনের ক্লান্তি, অবসাদ এবং বিরক্তি নিয়ে ঘরে ফেরেন। বাসায় গিয়ে কারো সাথে কোনো কুশল বিনিময় নেই, আলাপচারিতা নেই দরজা বন্ধ করে যিনি যার কক্ষে সময় কাটান। নগর জীবনের ব্যস্ততার কারণে স্বামী সারাদিনের কাজ শেষে যখন অনেক রাতে বাসায় ফেরেন।
স্ত্রীর সাথে তেমন আর কথা হয় না। সন্তানরা তো আগেই ঘুমিয়ে পড়ে। আবার যদি বাসায় আগে ফেরাও হয় তখন আমাদের সময় কেঁড়ে নেয় টেলিভিশন। অর্থাৎ আমাদের সবচেয়ে আপনজন পরিবারের সদস্যদের আমরা খুব কমই সময় দেই। আর যদিও বা সময় দেই তা হলো রুটিন সময় দেয়া তাতে কোয়ালিটি খুব কমই থাকে।
এই মনোযোগ না দেয়া, না শেয়ার করা থেকেই দূরত্ব সৃষ্টি হয়। আমরা মনে করি পরিবারের সদস্যদের বস্ত্তগত চাহিদা পূরণ হলেই তারা খুশি থাকবে। আসলে সাহচর্য বা মমতা ভালবাসার স্থান কখনও বস্ত্ত দিয়ে পূরণ হয় না। আর সে জন্যে পরিবারে কোয়ালিটি সময় দেয়ার কোনো বিকল্প নেই।
সম্পর্ক গভীর হয়, বন্ধন দৃঢ় হয় মনোযোগের কারণে। বাসায় থাকা আর পরিবারকে সময় দেয়া এক কথা নয়, টিভির পেছনে সময় নষ্ট না করে পরস্পরের সাথে কথা বলুন, ভাবের আদান-প্রদান করুন। হাস্যরসের পরিবেশ বজায় রাখুন। সারাদিনের শিক্ষামূলক কোনো ঘটনা পরিবারের সদস্যদের সাথে শেয়ার করুন।
দেখবেন পরিবারে আনন্দের হিল্লোল বইছে। আমরা পরিবারে মমতা, সমমর্মিতার দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ করতে পারি। পারিবারিক জীবনের প্রো-একটিভ থাকার প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি, অথচ এখানে আমরা রি-একটিভ হই সবচেয়ে বেশি। আমাকে সবাই বুঝলো না, এই ভেবে অভিমান করি, কষ্ট পাই।
তার প্রতি আপনার নিঃশর্ত ভালবাসা ও দেয়ার মনোভাব থাকলে কখনোই এই দ্বন্দ্ব চলতে পারতো না, কারণ নিঃস্বার্থ ভালবাসার শক্তিই এমন যে, তা অপরপক্ষের মধ্যে ভালো হওয়ার শক্তিকে জাগ্রত করে। অনেক সময় আমাদের অহমের কারণে অন্যকে মূল্যায়ন করতে পারি না। সাধারণভাবে আমাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি আমরা খুব কমই সম্মান প্রকাশ করে থাকি। অনেক সন্তান যেমন মা-বাবাকে সেভাবে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে না তেমনি মা-বাবাও মনে করেন সন্তানের আবার সম্মান কী? আসলে আমরা যা বিকিরণ করবো আমরা আসলে তা-ই পাবো।
সন্তানকে যখন আপনি নেতিবাচক কথা বলবেন একটা সময় আসবে সে আপনার সাথেও নেতিবাচক আচরণ করবে। পরিবারে সুসম্পর্ক তৈরি হয় সহজেই যদি মূলের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা মমতা ভালবাসা থাকে, আকর্ষণ থাকে। আর আমাদের পরিবারে সেই মূল হচ্ছেন আমাদের মা-বাবা। আমরা অনেক সময় পরিবার বলতে স্বামী-স্ত্রীকে বুঝি।
অথচ স্বামীও কারো ছেলে, স্ত্রীও কারো মেয়ে। অর্থাৎ পরিবারের মূল মা এবং বাবা। আর মা-বাবার সাথে সুসম্পর্ক তখন হবে যখন আপনার লালন-পালনে তাদের ত্যাগ, শ্রমকে আপনি অনুভব করতে পারবেন। তাদের ত্যাগের প্রতিদান দেয়া সম্ভব নয়, অনুভব করা সম্ভব। আমার মা, আমার বাবা, পরিবার তাদের ওপর আমি কতটা নির্ভর করছি- তাদের কাছ থেকে আমি কতটুকু নিচ্ছি, সে তুলনায় আমি কতটা দিচ্ছি- এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মায়ের ডাকে উন্মত্ত নদী পাড়ি দিয়েছেন, বায়েজীদ বোস্তামী (র) মায়ের জন্যে রাত জেগে পানির গ্লাস নিয়ে শিয়রে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। মায়ের জন্যে তাদের মমতা ছিলো, টান ছিলো। তাদের জীবনে মায়ের দোয়া ছিলো। তাই তারা স্মরণীয় হয়েছেন, বরণীয় হয়েছেন। এক ব্যক্তি নবীজীকে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমার সুন্দর আচরণের সবচেয়ে বেশি হকদার কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে জিজ্ঞেস করলো, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে আবার জিজ্ঞেস করলো, তারপর কে? তোমার মা। সে বললো, তারপর কে, তোমার বাবা।
এই হাদীস স্পষ্টভাবে বলে দেয় মায়ের গুরুত্ব ও মর্যাদা কত বেশি! যখন সন্তান অনুভব করতে পারে তাদের লালনপালনে মা-বাবার কত ত্যাগ, কত ভূমিকা এবং কত শ্রম ছিলো, তাহলে সে-ই সন্তান আলোকিত মানুষ হবার পথে সবসময় এক ধাপ এগিয়ে যাবে। সন্তানের সামনে মা-বাবাকে মডেল হতে হবে।
আসলে পারিবারিক জীবনে আমরা খুব বেশি ইনফরমাল যে কারণে কী বলছি না বলছি সে ব্যাপারে চিন্তা করি না। আমরা যে কথাই বলি না কেন তা শ্রোতার মনে পক্ষে বা বিপক্ষে ছাপ ফেলে। তাই পরিবারে সবসময় সুন্দর, শ্রদ্ধাপূর্ণ বাক্য ব্যবহার করুন। সন্তানদের ভালো নামে সম্ভোধন করুন।
কারো কোনো বিশেষ অর্জন ও কৃতিত্বের জন্যে প্রশংসা করুন। পারিবারিক জীবনে যতো সুন্দর ভাষা ও শব্দ প্রয়োগ করবেন ততো পারিবারিক পরিমণ্ডলে রাগারাগি, চিৎকার চেঁচামেচি কম হবে। সন্তান মা-বাবা যা বলে তা শেখে না, যা করে তা-ই শেখে। আপনি বাসায় থেকে সন্তানকে দিয়ে বলাবেন, আপনি বাসায় নেই।
তাহলে সন্তানকে যত শিক্ষা দেন মিথ্যা না বলতে সে সন্তান কখনও শিক্ষা গ্রহণ করবে না। আমরা সবাই পেতে চাই। পুত্রবধূ বলেন, আমি এত কাজ করি তার পরও শাশুড়ির প্রশংসা শুনি না।
শাশুড়ি আক্ষেপ করেন, ভেবেছিলাম ঘরে বউ এলে আমি একটু সেবাযত্ন পাবো। স্বামী বলেন, ভেবেছিলাম বিয়ের পর আর নিজের কাজগুলো নিজেকে করতে হবে না। স্ত্রীর অভিযোগ, সবদিকে খেয়াল থাকে, শুধু আমার দিকেই মনোযোগ নেই।…… এসব প্রায় প্রতিটি পরিবারের প্রতিদিনের চিত্র। পরিবারকে আমি কী দিলাম তা না ভেবে অধিকাংশ সময় আমাদের মানসিকতা কাজ করে যে পরিবার থেকে আমি কী পেলাম।
আবার যদি পরিবারের কোন সদস্যের দেয়ার মানসিকতা থাকে তার কাছ থেকে কত নেয়া যায় সে চিন্তায় থাকি। তাকে দেয়ার কথা আমরা খুব কমই চিন্তায় রাখি। আমাদের এত অভিযোগ, এত আক্ষেপের কারণ- আমরা পেতে চাই।
কিন্তু আমরা যদি শুধুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গিটাকে বদলে ফেলি- আমরা যদি দেখি আমি কার জন্যে কতটুকু করতে পেরেছি, আমার যতটুকু সামর্থ্য ছিলো তা আমি দিয়েছি কিনা। তাহলেই জীবন বদলে যাবে, সম্পর্ক বদলে মমতার, ভালবাসার সম্পর্ক তৈরি হবে। পরিবারের সদস্যদের কখনও বোঝা মনে করবেন না।
বরং পারিবারিক প্রতিটি কাজকে ইবাদত মনে করুন। সবসময় মনে রাখবেন মানুষ হিসেবে আপনি তখনই ভালো যখন পরিবারের কাছে আপনি ভালো। ছোটখাটো যে কাজগুলো আপনার পক্ষে করা সম্ভব তা নিজেই করুন। শিক্ষার্থী হলে নিজের বইখাতা ও কাপড় চোপড় নিজেই গুছিয়ে রাখুন।
পরিবারে যে কাজটি কেউ করতে চায় না সে কাজটি আগ বাড়িয়ে নিজে করুন। হাজবেন্ড হলে ঘরের টুকিটাকি কাজে স্ত্রীকে সহায়তা করুন। মেডিটেশন একজন মানুষের মমত্বের শক্তিকে বাড়িয়ে দেয়। আর মমতা হচ্ছে সকল সুসম্পর্কের পূর্ব শর্ত। আপনার সবচেয়ে কাছের মানুষগুলো যারা এখন অনেক দূরের।
হয়তো ভাবছেন এ সম্পর্ক আর ঠিক হবে না। মেডিটেশনের মাধ্যমে তাদেরকে আপনি অন্তর থেকে ক্ষমা করে দিয়ে বুকে টেনে নিতে পারবেন। পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি এড়িয়ে একাত্মতা বাড়াতে পারবেন। এই পরিবারই হয়ে উঠবে আপনার প্রশান্তির উৎস, আপনার আশ্রয়স্থল। তাই নিয়মিত মেডিটেশন করুন।
যে পরিবারে মেডিটেশনের চর্চা হয় তাদের মধ্যে মতবিরোধ কম হয়। কারণ স্বামী যা চিন্তা করছেন স্ত্রীও একই কথা ভেবে রেখেছেন। প্রতি বৃহস্পতিবার পারিবারিক মেডিটেশন করুন। পারিবারিক মনছবি দেখুন। পারিবারিক ঐতিহ্য তৈরি করুন। যেমন: অন্তত একবেলা পরিবারের সকলের সাথে একসাথে খাওয়া।
পারিবারিকভাবে ঘুরতে যাওয়া। পারিবারিক বন্ধন ছাড়া, সুসম্পর্ক ছাড়া মানুষ কখনো ভালো মানুষ হতে পারে না। সুখী পরিবারের জন্যে একে অপরের পরিপূরক হতে হবে, একাত্মতা থাকতে হবে। পরিবারের সদস্যদের যে কষ্ট তা তার মতো করে অনুভব করতে পারলে দেখা যাবে পরিবারের অনেক সমস্যা কমে যাচ্ছে।