পৃথিবীর অনেক বড় বড় সেতুর আপনারা নাম শোনেন। সেগুলো অধিকাংশ কিন্তু নদীতে নয়, সমুদ্রে। সেখানে স্রোত তেমন বেশি নয়। নদীতে বড় সেতু করা বাস্তবিক অর্থেই কঠিন। কারণ নদীতে সবসবময় স্রোত থাকে। পদ্মা নদীতে আমরা যেখানে সেতু বানাচ্ছি, সেখানে প্রতি সেকেন্ডে পানির বেগ ৩-৪ মিটার। এমন নদীতে আমরা সেতু বানাচ্ছি জেনে উন্নত দেশগুলোর ইঞ্জিনিয়াররা আমাদের বলত, ‘তোমরা নিশ্চয়ই গল্প করছ!’ কিন্তু এখন সারা পৃথিবীতে হার্ভার্ড এমআইটির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের এই সেতু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর সময় থেকেই আমরা জানতাম, সারা পৃথিবী আমাদের পর্যবেক্ষণ করছে। এর নেপথ্য কারণ প্রতিষ্ঠিত অনেক বড় বড় সেতু নির্মাতা কোম্পানি রায় দিয়ে দিয়েছে—এ নদীতে সেতু বানানো অসম্ভব। তারা আমাদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, আমরা কোনো ফাঁকি দেই কিনা! কিন্তু আমরা শুরু থেকেই স্বচ্ছ ছিলাম।
আমরা যখন প্রথমবারের মতো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামনে ২৯ হাজার কোটি টাকা বাজেটের পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প উপস্থাপন করলাম, তিনি অনুমোদন দিলেন। একইসাথে বলে রাখি, সেতু নির্মাণ জলদি শেষ করার বিষয়ে চারপাশ থেকে অনেক চাপ ছিল, তাগাদা ছিল। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কখনো কোনো তাড়া দেন নি; বরং সবসময় তিনি আমাদের ওপর আস্থা রেখেছেন এবং বিশ্ব মানের একটি কাজের পক্ষে ছিলেন।
আসলে এই পুরোটা সময় শুধু অর্থের ব্যাপারে নয়, কারিগরিসহ সব বিষয়ে আমরা স্বচ্ছ ছিলাম। বাজেট নির্ধারণ করার সময়েই আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি—কী কী কাজে কতটুকু অর্থ লাগে তা সুনির্দিষ্টভাবে হিসাব করে রাখতে। এর জন্যে অবশ্যই আমাদের পুরো টিমকে ধন্যবাদ দিতে হয়।
শুধু তা-ই নয়, কাজে বার বার প্রতিকূলতা এসেছে। কিন্তু সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কাছে যখন আমরা যেভাবে সাহায্য চেয়েছি, তারা আন্তরিকভাবে আমাদের সর্বোচ্চ সাহায্যটুকু করেছেন। ফলে সেতু নির্মাণে প্রতিকূলতাগুলো আমরা একের পর এক জয় করতে পেরেছি। আমাদের সকল প্রতিকূলতা জয়ের রহস্য বলতে গেলে এই একটিই—টিম ওয়ার্ক।
২০ নভেম্বর ২০২১ শনিবার মুক্ত আলোচনার ১০১ তম পর্বে এ কথাগুলো বলেন বাংলাদেশের নির্মাণ ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতুর প্রকল্প-পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. শফিকুল ইসলাম। এবারের আলোচনার বিষয় ছিল আমরা পারি। এ পর্বে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াডের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং শিক্ষাবিদ, লেখক, বিজ্ঞানী ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ।
প্রধান অতিথির আলোচনায় ইঞ্জিনিয়ার মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এখানে আমাদের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া নেই। আমরা একটা ভিশনের জন্যে কাজ করছি। আমাদের যখন নদীশাসনের টেন্ডার হয়, তখন তিনটা টেন্ডার জমা পড়ল। চাইনিজরা দিল ৮ হাজার কোটি টাকা, কোরিয়ানরা দিল ১২ হাজার কোটি টাকা আর ইউরোপিয়ানরা দিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। ইরোপিয়ানদের কাজ দেয়ার ব্যাপারে বড় ধরনের তদবির এলো। আমাদের টিম দেখল, এভাবে হলে আমরা কাজ করতে পারব না, ব্যয় বাড়বে কিন্তু কাজের মান থাকবে না। কিন্তু বিষয়টি অবহিত করলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকে আশ্বস্ত করলেন। শেষ পর্যন্ত আমরা চাইনিজদের কাজটি দিলাম। অনেকে বলেন, ইউরোপিয়ানরা ভালো কাজ করে, তাদের দিলেই ভালো হতো। কিন্তু বাস্তবতা সে-রকম নয়। আপনারা জানেন, আইফোন তৈরি করে চাইনিজরা। কাজটি তারা ভালো করে বলেই আমেরিকানরা তাদের কাছ থেকে বানিয়ে নিচ্ছে। আবার অনেক নিম্নমানের পণ্যও তারা বানায়। তাই তাদের কাছ থেকে ভালো কাজটা আদায় করে নিতে হবে।
আমাদের এখানে আমেরিকান কনসাল্টেন্ট এসে দেখলেন, এখানে ১৪টি দেশের বিভিন্ন কারিগরি টিম কাজ করছে। তখন তিনি আমাকে বললেন, তোমাদের কাজের প্রশংসা করতেই হয়। তবে তার চেয়ে বড় ব্যাপার তুমি যে ১৪টি ভিন্ন দেশের এবং ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষদের একসাথে কাজ করিয়ে নিচ্ছ, এজন্যে তোমাকে প্রথমে অভিনন্দন জানাচ্ছি। অর্থাৎ দেশি-বিদেশি যে কোম্পানি কাজ করুক, আমাদের চাওয়া অনুযায়ী তাদের কাছ থেকে কাজটা আদায় করে নিতে হবে, এটাই আসল কথা। পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে কাজ আদায় করে নেয়ার এ চ্যালেঞ্জিং কাজটিই আমরা করছি।
সমাপনী বক্তব্যে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের ইতিহাস শুনতে গিয়ে আমরা জানলাম, একটা বড় প্রকল্পের সঙ্গে কতগুলো বিষয় জড়িয়ে থাকে। সবগুলো প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই একটা মেগা প্রজেক্টকে সফল করতে হয়।
আমাদের দেশের তরুণরা অনেক সম্ভাবনাময়। এবছরের ৪ অক্টোবর রাশিয়ার মস্কোতে প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার একটা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয়। সেই পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে পশ্চিম এশিয়ায় প্রথম এবং সারা বিশ্বে ২৮ তম স্থান অর্জন করে বুয়েট (বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে ১৫টি প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় অংশ নিলেও তারা প্রত্যেকেই আমাদের পরের স্থান অর্জন করেছে। এ থেকেই আমরা বুঝতে পারি, আমাদের ছেলেমেয়েরা কতটা মেধাবী! আসলে আমরা চাইলেই পারি।
অনুষ্ঠান শেষে অংশগ্রহণকারীরা ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ রচিত ‘মেধাবী ও বিনয়ী মানুষের গল্প’ বইটি বিশেষ মূল্যছাড়ে সংগ্রহ করেন এবং এতে লেখকের অটোগ্রাফ নেয়ার সুযোগ পান।
[মো. শফিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৫৫ সালের ২ জানুয়ারি, কুমিল্লায়। বাবা আব্বাস আলী সরকার, মা রওশন আরা বেগম। ১৯৭০ সালে গৌরিপুর এসএ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৭২ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ১৯৭৭ সালে বিএসসি সম্পন্ন করেন।
১৯৭৮ সালে ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালটেন্ট লিমিটেডে জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ইঞ্জি. মো. শফিকুল ইসলাম। সে-সময় তিনি সোনারগাঁ হোটেলের পাইলিংয়ের কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। পরের বছর বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে খুলনা-মংলা হাইওয়ে প্রকল্প, ফেনী বাইপাস, কুমিল্লা চান্দিনা বাইপাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে তার রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
সরকারি দায়িত্ব পালনকালে তিনি নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে ফরেন এইড প্রজেক্টের সব চ্যালেঞ্জিং কাজে দেখিয়েছেন স্বচ্ছতা, সৃজনশীলতা ও পারদর্শিতা।
২০১১ সালের আগে বাংলাদেশে মহাসড়ক নির্মাণের প্রস্তাবনা ছিল দুই লেন ভিত্তিক। ইঞ্জিনিয়ার মো. শফিকুল ইসলামই প্রথম চার লেন বিশিষ্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে প্রজেক্টের প্রস্তাবনা দেন। একসময় বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ও উদ্ভুত পরিস্থিতির দরুন যখন পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্মাণ কাজ কিছুটা শিথিল হয়ে পড়ে, সেই চ্যালেঞ্জিং সময়ে তিনি প্রত্যয় ও সাহসের সাথে সেতুর নির্মাণ কাজের দায়িত্বভার হাতে নেন। ফলত ২০১৪ সালে স্ব-অর্থায়নে শুরু হয় দ্বিতল পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ কাজ। তার নিরলস প্রচেষ্টা, অক্লান্ত পরিশ্রম আর সুষ্ঠু টিমওয়ার্কের কারণে ১০ ডিসেম্বর ২০২০-এ সম্পন্ন হয় এ সেতুতে সর্বশেষ স্প্যান বসানোর কাজ।]