স্বপ্ন বলতে কিছু যে আছে এটা শুনে প্রথমদিকে হাসি পেত। ক্যাম্পাসের বড় ভাইদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ার পেছনে তাদের কঠোর অধ্যবসায় আর মেডিটেশন—এই দুইটাকে আমি শুরুর দিকে অনেক বেশি উপেক্ষা করেছিলাম। প্রতিষ্ঠানের নিয়মগুলোকে একপাশে সরিয়ে রেখে চলার চেষ্টা করতাম। এগুলো বোঝা মনে হতো। কোনোভাবে পাশ করে পরের ক্লাসে উত্তীর্ণ হওয়ার চেষ্টায় থাকতাম। ক্লাসে সবচাইতে পেছনের বেঞ্চটা ছিল আমার ঘুমানোর জায়গা।
কিন্তু কসমো স্কুলে বড় ভাইদের কাছে শুনলাম ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারলে নাকি তেমন রুলস রেগুলেশন মানতে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম ও রুটিন এতটা কঠোর হয় না। এরপর থেকে বড় ভাইদের অনুপ্রেরণায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়ার মিশনে নেমে পড়লাম। কলেজে উঠে নিজেকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলাম। একটু একটু করে সবকিছুতেই মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা শুরু হলো। এছাড়া খেলাধুলার মাধ্যমে নিজের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় কোয়ান্টামের হয়ে খেলতে যাওয়ার আনন্দটাই ছিল আলাদা।
আমার বাড়ি প্রথমে ছিল বান্দরবানের লামা উপজেলায়। বর্তমানে মা-বাবা চকরিয়ার বানিয়ারছড়া গ্রামে থাকেন। আমার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তো দূরের কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সেভাবে শুনে নি। শোকর আলহামদুলিল্লাহ! আমিই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি।
যে পরিবেশে আমি ছোটবেলায় ছিলাম, আমি এসএসসি পাশ করতাম কিনা সন্দেহ ছিল। এই স্কুলে ভর্তি করানোর পর আমার মা-বাবা স্বপ্ন দেখতেন যে, আমি একজন ডাক্তার হবো। কিন্তু আমি ডাক্তার হতে পারি নি। এ নিয়ে কিছুটা আফসোস হতো। কিন্তু যখন এলাকার চারপাশে তাকাই তখন আমাদের পুরো গ্রামে আমি একাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি।
সবসময় তারা আমার সফলতার জন্যে কোয়ান্টামের কথা বলেন। জীবনের এই আটটি বছর আমার কাছে যে নিয়মগুলো বোঝা মনে হয়েছিল, যখন কোয়ান্টাম থেকে বের হলাম, সে-সময় বুঝতে পেরেছি ওগুলোই আমার জন্যে সবচেয়ে ভালো ছিল। কারণ আমি কোনোসময় মেধাবীদের কাতারে ছিলাম না। কোয়ান্টামে আসার আগে চিন্তা করতাম কোনোভাবে পাশ হয়ে গেলেই হবে।
কিন্তু এখানে এসে আমি এ প্লাসের মুখ দেখেছি। আমার গ্রামের স্কুলের ছোটবেলার যে বন্ধু টেনেটুনে ৩৩ পাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে স্কুলে পড়ত, সেই স্কুলের বন্ধুগুলোর হাতে এখন নেশাদ্রব্য। এলাকার সমবয়সী অনেকে সিগারেট থেকে শুরু করে অন্যান্য খারাপ অভ্যাসের সাথে যুক্ত। এগুলো থেকে আমি মুক্ত থাকতে পেরেছি। এটা ভেবে মা-বাবা আজও বার বার কোয়ান্টামের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির কোচিংয়ের সময়টা আমার বেশ সংগ্রামের একটা সময়। কোয়ান্টাম মেথড কোর্সের শিক্ষা এসময় আমার খুব কাজে দেয়। আগেই বলেছি যে, স্কুলে থাকা অবস্থায় যেহেতু কোয়ান্টামের নিয়মকানুন আমার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হতো, তাই কোয়ান্টামের শিক্ষাগুলো, যেমন—মনছবি আমি বিশ্বাস করতে চাইতাম না। কিন্তু একসময় আমি মনছবি নিয়ে অনেক ভাবি এবং নিয়মিত প্রার্থনা করার প্রতি আগ্রহী হই। গুরুজী দাদুর একটি কথা আমার খুব মনে পড়ত। তিনি বলতেন ‘প্রার্থনাকারী ও প্রার্থনা কবুলকারী যখন একাকার হয়ে যায় তখন সে প্রার্থনা কবুল হয়।’ আর মনছবি যে কাজ করে তা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পর বুঝতে পারি।
আমাদের মতো অসহায় বঞ্চিত শিশুদের কোয়ান্টাম যেভাবে পড়ালেখা করাচ্ছে এই বিষয়টা আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। তাই আমিও স্বপ্ন দেখি আমি আমার এলাকার মানুষকে শিক্ষিত হতে সাহায্য করব। লেখাপড়া শেষ করে আমি একজন বিসিএস ক্যাডার হতে চাই। আমাদের দেশে দুর্নীতি দমনে আমি ভূমিকা রাখতে চাই। কারণ বাংলাদেশকে স্বর্গভূমি করতে হলে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ আমাদের গড়তেই হবে। আর আমি মাদকমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি।
আমার ভ্রমণের শখ আছে। নতুন পরিবেশ দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। তাই যখনই সুযোগ পাই, একটু টাকার ব্যবস্থা হলে কোথাও না কোথাও থেকে ঘুরে আসি। এর মাধ্যমে আমি শুধু নতুন পরিবেশ দেখা নয়, নতুন কিছু শিখতে পারি। আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, কোয়ান্টামের নিবেদিত সদস্যদের প্রতি যারা নিজেদের অনেক সুযোগ-সুবিধা বিসর্জন দিয়েছেন বলেই আমার মতো স্বপ্নহীন শিশুরা স্বপ্ন দেখতে পারছে। আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে তারা নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]