হঠাৎ আমার বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন। চিকিৎসা চলতে থাকে। আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে সহযোগিতা করে চিকিৎসার জন্যে। প্রচুর অর্থ খরচ করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় বাবাকে। তারপরেও অসুখ ভালো হচ্ছিল না। সবাই চিন্তায় পড়ে যায়, কোথায় নিয়ে গেলে তিনি সুস্থ হবেন। এভাবে প্রায় দুবছর চলতে থাকে চিকিৎসা। দিন দিন খারাপ হতে থাকে বাবার অবস্থা। একদিন বাবা আর এই ভোগান্তি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করার জন্যে বিষ খেয়ে নেন। কোনোরকম তাকে এই বিপদ থেকে বাঁচানো গেল। কিন্তু কয়েকদিন পর অসুখ ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। শত চেষ্টায়ও রাখা গেল না তাকে, অবশেষে চলে গেলেন বাবা।
সবাই চিন্তায় পড়ে গেল, আমাদের অবস্থা কী হবে! তখন আমার বয়স আট বছর। প্রাইমারিতে পড়তাম। বড় ভাই পড়ত অষ্টম শ্রেণিতে আর মেজো ভাই ষষ্ঠ শ্রেণিতে। এসময় কেউ কেউ বলতেন মাকে আবারো বিয়ে করতে। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য, মা আর বিয়ে করলেন না। মা আমাদের ওপর ভরসা রেখে কাজ করতে লাগলেন।
টাকার অভাবে পড়ালেখা ছাড়তে হয় বড় ভাইকে। আর মেজো ভাইকে পাঠানো হয় এক আত্মীয়ের বাড়িতে। মা সংসার সামলানোর পাশাপাশি দিনমজুরি করে টাকা জোগাড় করতেন। স্কুল থেকে যখন আসতাম, বাড়িতে ভাত থাকত না। বাড়ির আশেপাশে কাঁঠাল গাছ ছিল, কাঁঠাল খেয়ে ক্ষুধা মেটাতাম। এভাবে পঞ্চম শ্রেণিতে সমাপনী পরীক্ষাও দিলাম ২০১৩ সালে।
এবার ক্লাস সিক্সে কোথায় পড়ব? কীভাবে পড়ব? সমস্যা আরো বেড়ে গেল। গ্রামে একটা জুনিয়র স্কুল ছিল। ঐ স্কুলে মাসিক বেতন ২০০ টাকা। কারণ স্কুলটি ছিল বেসরকারি, এজন্যে ফি একটু বেশি। যাক, তবুও মা হাল ছেড়ে দেন নি। অনেক কষ্ট করে মা উত্তর মুবাছড়ি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আমাকে ভর্তি করে দিলেন। কয়েকদিন পরে ক্লাস শুরু হলো। তারপরেও আমি ক্লাসে যেতে পারছি না। কারণ তখনো আমার স্কুল ড্রেসের ব্যবস্থা হয় নি।
বেশি দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাই মা একদিন ইউনিফর্ম ছাড়া স্কুলে পাঠিয়ে দিলেন। ঐ দিন ছিল মঙ্গলবার। মা বলতেন মঙ্গলবার দিয়ে শুরু করলে নাকি মঙ্গল হয়। ক্লাসে যখন ঢুকলাম সবার চোখ আমার দিকে। কারণ অনেকদিন পর ক্লাসে উপস্থিত হওয়া, আবার স্কুলের পোশাক নাই, যা ছিল তা-ও পুরনো। স্যার ক্লাসে এসে বললেন, এতদিন পর কেন? আর তোমার স্কুলের ইউনিফর্ম কোথায়? আমি বললাম, স্যার, মা এখনো কিনে দিতে পারেন নি। স্যার বললেন, তাহলে আজকে পুরো সময়টা দাঁড়িয়ে ক্লাস করো। তোমার মাকে বলো স্কুল ইউনিফর্ম কিনে না দিলে স্কুল থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হবে।
ঘটনাটা মাকে যখন বললাম, মা এক সপ্তাহের মধ্যে ইউনিফর্ম সংগ্রহ করে দিলেন। তারপর থেকে খুশিতে স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম। বহু কষ্টে বছরটা শেষ করলাম। একসময় জেএসসি পরীক্ষাও সম্পন্ন করে ফেললাম। এভাবে তিনটা বছর কেটে গেল সেই স্কুলে। মা চিন্তায় পড়ে গেলেন আমার পরবর্তী ভর্তি নিয়ে। একদিন আমার বন্ধু রিকন বলল, আমার বাবা আমাকে দূরের একটি স্কুলে ভর্তি করে দেবে। আমার সাথে যাবে? সে আরো বলল, সেই স্কুলে নাকি পড়ালেখা অনেক ভালো। আমি বললাম, বাড়িতে বলে দেখব। ব্যাপারটা রাতে মাকে বললাম, তখন পাশে বড় ভাইও ছিল।
কী সৌভাগ্য! বড় ভাই বলল ঠিক আছে ভর্তি করে দেবো। তারপর বড় ভাই আমার বন্ধুর বাবার সাথে কথা বলে সব ঠিক করে ফেলল। স্কুলটি আমাদের কাউখালী থেকে ৪০/৪২ কিলোমিটার দূরে। ভর্তি হতে যাওয়ার সময় গাড়িতে বমি বমি ভাব হচ্ছিল আমার। কারণ ঐদিন ছিল আমার প্রথম দূরের ভ্রমণ। এর আগে কোনোদিন এত দূরে যাওয়ার সুযোগ হয় নি। অনেক কষ্ট করে পৌঁছে গেলাম স্কুলে। মানবিক বিভাগে ভর্তি হয়ে গেলাম সেদিন। ভর্তি শেষ করে রওনা হলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। এবার বমি না করে আর পারলাম না। গাড়িতে চড়ার অভ্যাস নেই যে!
কয়েকদিন বাড়িতে কাটানোর পর ক্লাস শুরু হলো, তাই চলে গেলাম দুজনে হোস্টেলে। হোস্টেলটা ছিল একটু অন্যরকম। নিজের টাকা দিয়ে নিজে রান্না করে খেতে হয়। হোস্টেলের ভাড়া দেয়া লাগে না। টাকার অভাবে লাকড়ি কিনতে না পারায় বিভিন্ন জায়গা থেকে তা খুঁজে নিয়ে আসতাম। আমি আর আমার বন্ধু দুজনে মিলে রান্না করে খেতাম। আলু আর ডাল একটু সস্তা বলে সবসময় আলু ও ডাল দিয়ে ভাত খেতাম।
ক্লাসের প্রথমদিন গিয়ে দেখি আমার বন্ধু ছাড়া কাউকে চিনি না। তাছাড়া বাংলাও শুদ্ধভাবে বলতে পারতাম না। ক্লাসে স্যার এসে জিজ্ঞেস করলেন আমার পরিচয়। আমি কোনোরকম উত্তর দিলাম। আমার কাণ্ড দেখে সবাই হাসল। একদিন এক মজার ঘটনা ঘটল—সেদিন আমি আলু ভাজা করেছিলাম। রান্না শেষে যখন খেতে বসলাম, দেখি আলু ভাজাতে লবণ এত বেশি হয়েছে যে একদম খাওয়া যাচ্ছে না। অন্য খাবার তো নেই। তাই আমার বন্ধু আলু ভাজাটা নতুন করে ধুয়ে আবার রান্না করল। তারপরেও খেতে পারলাম না, আলু ভাজায় এত লবণ।
হোস্টেলে যারা থাকে সবাই মদ সিগারেট খেত। ধীরে ধীরে আমিও একসময় আসক্ত হয়ে গেলাম। এভাবে চলে গেল ঐ বছরটা। নিয়মিত মদ খাওয়াও আমার চলতে থাকল। কোনোরকম কাটিয়ে দিলাম ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষাটা।
দশম শ্রেণিতে মডেল টেস্ট পরীক্ষার আগে স্যারেরা বলে দিয়েছেন, এই পরীক্ষাতে যারা ফেল করবে তাদের ফাইনাল পরীক্ষাটা দিতে দেয়া হবে না। এটা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম মদ-সিগারেট খাওয়া বাদ দিতে হবে। কিন্তু এটা তো খুব কঠিন! চেষ্টা করলাম পড়াশোনায় মন দেয়ার। মায়ের কষ্টকে অনুভব করলাম।
এসএসসি পরীক্ষা এসে গেল। পরীক্ষা শেষ করে বাড়িতে চলে গেলাম। একদিন আমার মা বললেন, পাশ করলে বাবা তুমি কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে চলে যাও। ঐদিন প্রথম শুনলাম নামটা, এর আগে কখনো শুনি নি। মা আরো বললেন ঐখানে তোমার মামাতো ভাই অমিয় পড়ে। আগে জানতাম সে বান্দরবানে পড়ে কিন্তু এই স্কুলে পড়াশোনা করে সেটা জানতাম না। মা বললেন, ঐখানে কিছুই দেয়া লাগে না, সব ফ্রি। মনে মনে চিন্তা করলাম, ঐখানে যাওয়াটা ভালো হবে। বাড়িতে থাকলে অনেক কষ্ট হবে, পড়াশোনাটাও হবে না। আমি বললাম, ঠিক আছে আমি যাব। তারপর বড় ভাই ভর্তির ফরম জোগাড় করে ফেলল। কয়েকদিন পরে খবর এলো ভর্তি হওয়ার জন্যে নাকি পরীক্ষা দিতে হবে চট্টগ্রামে। তাই পরীক্ষা দিতে চট্টগ্রামে গেলাম। তারপর কয়েকদিন পরে এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হলো। যাক, ভগবানের আশীর্বাদে পাশ করলাম।
তারপর কোয়ান্টাম কসমো স্কুল থেকে খবর এলো মে মাসের ১৯ তারিখে আসতে হবে। মা এসব বিষয় বোঝেন না তাই আমার সাথে বড় ভাই গেল পৌঁছে দিতে। কোয়ান্টামে এসে আমার প্রথম চোখে পড়ে এটি ধূমপানমুক্ত এলাকা! নতুন পরিবেশে, নতুন নিয়মকানুন আমার কাছে কিছুই ভালো লাগছে না। তাই অমিয় ভাইকে বললাম, আমি চলে যাব বাড়িতে। সে আমাকে বুঝিয়ে বলল কয়েকদিন থাকো সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপর ক্যাম্পাসের বড় ভাইয়েরা এসে সান্ত্বনা দিতেন। বলতেন, এখানে থাকো তোমার জীবনে অনেক কিছু হবে। আরো বলতেন তুমি এখান থেকে ভার্সিটি পড়তে পারবে। শুরু করে দিলাম পড়াশোনা। স্কুলের দৈনিক রুটিন সব মেনে চলতাম। নিয়মিত মেডিটেশন করতাম আর মনছবি দেখতাম, যেভাবে হোক ভার্সিটি পড়তেই হবে। একসময় হয়ে গেলাম প্রকৃত কোয়ান্টা।
একটা জিনিস খুব ভালো লাগত, সেটা হচ্ছে ক্যাম্পাসে রাগ জিনিসটা একদম দেখা যেত না। একটা কাগজে দেখলাম লেখা আছে—রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। তারপর থেকে আমিও রাগটা একেবারে কমিয়ে দিলাম। এভাবে চলতে লাগল। একসময় এইচএসসি পরীক্ষাও শেষ হয়ে যায়। তারপর শুরু হয় ভার্সিটি ভর্তি কোচিং। আমরা কয়েকজন কলেজে থেকে নিজেরাই পড়াশোনা করলাম। পরে চান্স পেলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। গ্রামের সবাই আমার প্রশংসা করে এখন। কারণ আমাদের এলাকায় আমি প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি।
এসব সাফল্যের কারণ হলো কোয়ান্টামের শিক্ষা এবং আমার আত্মবিশ্বাস। কোয়ান্টাম মেথড কোর্সও করানো হয়েছিল আমাদের কলেজ থেকে। এই কোর্সের শিক্ষা অনুসরণ করে আমার জীবনে ইতিবাচকতা এসেছে। তাই আমি গুরুজী দাদুর কাছে বিশেষ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
বর্তমানে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়ালেখা করছি। ভবিষ্যতে ফুল স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে গিয়ে সেখানে পিএইচডি সম্পন্ন করে দেশে ফিরতে চাই। কারণ দেশের মানুষের জন্যে আমাকে কাজ করতে হবে।
আর একজন দাতা হতে চাই। বৌদ্ধধর্মে দানের গুরুত্বের কথা বলা আছে। আমাদের ধর্মে সবচেয়ে বড় দানের উৎসব হচ্ছে ‘কঠিন চীবর দান’— (এই অনুষ্ঠানে পুণ্যের উদ্দেশ্যে বৌদ্ধ শ্রমণদের পরিধেয় পোশাকসহ প্রয়োজনীয় নানা উপকরণ দেয়া হয়) এই মহতি পুণ্যানুষ্ঠান আমাদের স্থানীয় বিহারে এখনো অনুষ্ঠিত হয় নি। সুতরাং আমি প্রথমবারের মতো সেই মহতি অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক হতে চাই।
বৌদ্ধ দর্শনের মূল লক্ষ্য সত্যকে উপলদ্ধি করে দুঃখমুক্তি। বুদ্ধের শিক্ষা—মানুষ কর্মের অধীন, জগতে কর্মই সব। যার যেমন কর্ম, তিনি ফলও পাবেন তেমন। এ দর্শনের মূলমন্ত্র—সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্তু অর্থাৎ জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক। দুঃখ হতে মুক্তি লাভ করুক। সাধু সাধু সাধু!
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]