একজন সাধারণ মানুষও অনেক কিছু করতে পারে যদি সে ফোকাসড থাকে এবং কাজটাকে আনন্দের সাথে করে। আর যদি সে পজিটিভ থাকতে পারে। আমার কাজ মানুষ, সমাজ, পরিবেশের উপকারে আসবে—এরকম একটি মহৎ লক্ষ্য অনেক বড় শক্তির জন্ম দেয়। তখন চারদিক থেকে সাহায্য আসতে থাকে। গমের ব্লাস্ট রোগ নিয়ে আমাদের গবেষণা ও সমাধানের ক্ষেত্রে ঠিক এরকমটাই হয়েছে। দেশ-বিদেশের বহু অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী আর দেশের মাঠপর্যায়ের কৃষকদের অনেক রকম সাহায্য আমরা অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়েছি।
আসলে যে-কোনো সমস্যাকে মোকাবেলা করার জন্যে প্রথমত সমস্যাটিকে চিহ্নিত করতে হয়। তাই গমের ব্লাস্ট রোগ নির্ণয়ে আমরা একটি স্মার্ট ডায়াগনোস্টিক কিট উদ্ভাবন করি। সারাবিশ্বে এটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আমাদের একটি কৃষি প্রযুক্তি পৃথিবীর বহু দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে, এটি আমাদের জন্যে অত্যন্ত আনন্দের ও গর্বের।
৯ নভেম্বর ২০২৪ শনিবার কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আয়োজিত মুক্ত আলোচনার ১২৬ তম পর্বে এ কথাগুলো বলেন বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক ও কৃষি-জীবপ্রযুক্তিবিদ এবং গাজীপুরস্থ বিএসএমআরএইউ-এর ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম। আলাপচারিতার আঙ্গিকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিশিষ্ট প্রযুক্তি-উদ্যোক্তা, রিভ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এবং কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমের পরিচালক (মোটিভেশন) এম রেজাউল হাসান।
মুক্তচিন্তার প্রসার ও শত ভাবনার বিকাশে নানা বিষয়ে ২০০৩ সাল থেকে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আয়োজন করছে মুক্ত আলোচনা কার্যক্রম।
আলাপচারিতার এক পর্যায়ে ড. তোফাজ্জলের কাছে জানতে চাওয়া হয় যে, যে-কোনো মানুষ জীবনে সফল হতে পারে যদি সে ফোকাসড থাকে, ক্রমাগত চেষ্টা করে যায়—একজন জিনিয়াস আর গড়পড়তা লোকের মধ্যে এটাই কি পার্থক্য?
এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জিনিয়াস হওয়া আর স্যোশালি ইমপ্যাক্টফুল হওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। যিনি স্যোশালি ইমপ্যাক্টফুল তার দৃঢ় মাইন্ডসেট থাকে। কোনো বাধাকেই সে বাধা মনে করে না। চলার পথে বড়-ছোট যত প্রতিবন্ধকতা আসুক, সে অতিক্রম করতে পারে। এটা মানুষের অনেক বড় একটা শক্তি।
বিশ্বমানের গবেষণাগার নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে ২০১০ সালে আমি দেশে ফিরি। বিএসএমআরএইউ-তে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) যোগদানের পর লক্ষ করলাম, যে ধরনের গবেষণার স্বপ্ন আমি দেখছি তার জন্যে ল্যাব ও সুযোগ-সুবিধা সেখানে নেই। সে-সময় ডিপার্টমেন্টে একটা টেস্টটিউব পর্যন্ত ছিল না। শুধু ভাবছিলাম, শূন্য থেকে কীভাবে শুরু করব? এরপর চিন্তার প্যাটার্নটাই বদলে ফেলি এভাবে—শূন্যই ভালো! কোনেকিছু পরিবর্তন করতে হবে না, বরং সবকিছুই নতুন করে শুরু করতে পারব। ধ্যানীরা মেডিটেশনে মনের বাড়ি যেভাবে তৈরি করেন, আমি অনেকটা সেভাবে ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটি ছবি কল্পনা করলাম। বিশ্বাসে দৃঢ় ছিলাম—এটি সম্ভব। আমি ভেবেছিলাম ১০ বছর লাগবে। কিন্তু অতটা সময় লাগে নি। আট বছরেই আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছি।
তরুণদের জন্যে বলি, স্বপ্নপূরণের পথে বাধা বা প্রতিকূলতা খুব স্বাভাবিক বিষয়। বাধা অতিক্রম না করে পৃথিবীতে বড় কোনো অর্জন হয় নি। যা হয়েছে বাধা অতিক্রম করেই হয়েছে। অসম্ভবকে মানুষ সম্ভব করতে পারে, যদি সে হতাশাকে জয় করতে পারে। জীবনে হতাশা আসবে, কিন্তু একে বয়ে বেড়াবেন না।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব নটিংহামের প্রো-ভিসি যেদিন আমাকে ওখানে প্রফেসর হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব দিলেন, সেদিন রাতে অনেক ভেবে দেখলাম—নিশ্চয়ই আমি একটা পর্যায়ে পৌঁছতে পেরেছি বলেই এমন একটি প্রস্তাব পেয়েছি। এ সক্ষমতা দিয়ে আমি নিজের দেশে কিছু করতে চাই। মাতৃভূমির কাছে আমার অনেক ঋণ। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার দেশের মানুষের জন্যে আমি কাজ করব। অনেকেই আমাকে দেশে ফিরতে নিরুৎসাহিত করেছে। তাদের কথা হলো—অন্যরা পারে নি, তুমিও পারবে না! কিন্তু আমি ভেবেছি, জীবন তো একটাই। অতএব আমি চেষ্টা করে যাব। বলা যায়, একরকম দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ নিয়েই আমি দেশে ফিরি। কিন্তু আজ এটুকু বলতে পারি—দেশে ফিরে একবারের জন্যেও আমার মনে কোনো অনুশোচনা হয় নি। কারণ আমি লক্ষ্যে অটল ছিলাম। আমাদের ইনস্টিটিউটে এখনকার যে সক্ষমতা সেটা গবেষণার দিকে থেকে বিশ্বমানের এবং বিশ্বস্বীকৃত।