আমাদের পাড়ায় তখন প্রাথমিক স্কুল বলতে একটিমাত্র বেসরকারি স্কুল ছিল। আমি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানে পড়ালেখা করেছিলাম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় তেমন খরচ হয় নি বলেই মা-বাবা আমাকে পড়াতে পেরেছিলেন।
পরবর্তী পড়াশোনার জন্যে পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য না থাকায়, আমার নানি আমাকে পড়ালেখা বাদ দিয়ে ইলেকট্রনিক্সের যন্ত্রপাতি ঠিক করার জন্যে বাজারে একটি দোকান করে দিতে চাইলেন। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল উচ্চশিক্ষা নিয়ে একজন ইলেকট্রি্রক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হবো। তাই কিছুটা বাধ্য হয়েই বাবা আমাকে মাটিরাঙ্গা সরকারি মডেল হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন।
আমাকে ভর্তি করে দেয়ার জন্যে বাবাকে আর্থিকভাবে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল, যা আমি ঐ সময়ে নিজের চোখে দেখেছিলাম।
স্কুলটি আমাদের পাড়া থেকে অনেক দূরে ছিল। প্রতিদিন হেঁটে স্কুলে যেতাম। বৃষ্টির সময় ছাতা না থাকার কারণে স্কুলে যেতে পারতাম না। তারপর রাস্তায় কাদা। যখন বেতন ও পরীক্ষার ফি দিতে হতো, তখন ঠিকমতো দিতে পারতাম না। এসময় মা-বাবা পাড়ার মানুষের কাছ থেকে ধার নিয়ে ফি পরিশোধ করেন। ধার না পেলে বাবা স্কুলের স্যারদের অনুরোধ করে আমাকে পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করে দিতেন। মা-বাবা আমাকে কখনোই অভাব জিনিসটা বুঝতে দিতে চাইতেন না। আমি কোনো সময় প্রাইভেট পড়ি নি। কারণ ভালোভাবেই জানতাম টাকা জোগাড় করতে বাবার বেশ কষ্ট হবে।
কিন্তু অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় এক স্যারের সাথে আমার পরিচয় হয়। তিনি আমাকে বিনামূল্যে প্রাইভেট পড়িয়েছিলেন। অনেক সময় তিনি আমাকে নিজের টাকায় খাতা, কলম, বই কিনে দিতেন। একবার অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষায় ফি দেয়ার সামর্থ্য না থাকায় তিনি আমার ফি পরিশোধ করে দিয়েছিলেন। এভাবেই আমি অষ্টম শ্রেণি শেষ করেছিলাম। স্যারের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। ভালো কিছু মানুষের সান্নিধ্য আমি পেয়েছি।
আমার একটি সমস্যা হলো আমার লেখার গতি খুব কম ছিল। কারণ একবার গাছ থেকে পড়ে আমার ডান হাত ভেঙে গিয়েছিল। এ কারণে দ্রুত লিখতে পারতাম না। তাই ভেবেছিলাম অষ্টম শ্রেণি পাশের পর কারিগরি শাখায় ভর্তি হবো। কারণ জেনারেলে পড়াশোনা করলে অনেক বেশি পড়তে হবে, আর কারিগরিতে পড়লে লেখাপড়া কম, হাতের কাজ বেশি থাকবে।
কিন্তু বাবার আর্থিক অভাবের কারণে আমি নবম শ্রেণিতে কোথাও ভর্তি হতে পারছিলাম না। এসময় পরিচিত একজন স্যার আমাকে কোয়ান্টাম কসমো স্কুল সম্পর্কে বলেন। জানতে পারলাম সেখানে দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের বিনামূল্যে পড়ানো হয়। তাই নিজের লক্ষ্য পূরণ করতে ২০১৯ সালে কারিগরি শাখায় নবম শ্রেণিতে আমি কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে ভর্তি হলাম।
আর এটাই ছিল আমার জীবনে প্রথম আবাসিক স্কুল। নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্যে সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু সাত দিন ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম করার পর এতই ভালো লেগেছিল যে, থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এছাড়াও এখান থেকে ফিরে গেলে আমার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যেত। এই স্কুলে আমরা বাঙালি-পাহাড়ি মিলে
একসাথে পড়ালেখা ও খেলাধুলা করতাম। এ স্কুলের পড়ালেখার পদ্ধতি বাইরের স্কুল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আমরা প্রতিদিন মেডিটেশন করে ক্লাস শুরু করতাম। এখানে এসে আমি আমার মনের ও ব্রেনের অফুরন্ত শক্তিকে কাজে লাগাতে শিখেছি। একসময় যে নেতিবাচক কথাগুলো আমি বাইরে শুনতাম যেমন—তুই পারবি না, তোর দ্বারা হবে না, তোর তো সামর্থ্য নেই! এগুলো এখানে বলা হয় না।
কোয়ান্টামে এসে বিভিন্ন প্রোগ্রাম করে বুঝতে পারলাম প্রত্যেক মানুষের ভেতরে পারার অফুরন্ত শক্তি রয়েছে। এটি আমি কোয়ান্টাদের সাফল্য দেখেই শিখেছি। তখন আমিও পারার এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমার লক্ষ্যটি আরো দৃঢ়ভাবে স্থির করলাম যে, এ প্লাস পাব এবং আমি ইঞ্জিনিয়ার হবো। তাই নিয়মিত লেখাপড়া করতে শুরু করি এবং মেডিটেশনের মাধ্যমে জীবনের মনছবি দেখতে থাকি।
এভাবে এসএসসি পরীক্ষা চলে আসে। প্রভুর আশীর্বাদে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪.৯৬ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। এ স্কুলের কারিগরি শাখার প্রথম ব্যাচের কোয়ান্টা হিসেবে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে নিজের নামটা লিখতে পেরে খুব ভালো লেগেছে। আমাদের এলাকা থেকে এই প্রথম আমি পলিটেকনিক কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। এজন্যে আমি কোয়ান্টামের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। কারণ এখানে না এলে আমি আমার মেধাকে বিকশিত করতে পারতাম না।
এছাড়া মাথাব্যথা রোগ থেকে মেডিটেশন আমাকে মুক্ত করেছে। আগে যখন আমার মাথাব্যথা শুরু হতো, তখন আমি টানা এক-দুই দিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারতাম না, খেতে পারতাম না। কোয়ান্টামে এসে আমার এই রোগটি একবার হয়েছিল। তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম চিকিৎসা করাব। কিন্তু কোয়ান্টামে নিয়মিত মেডিটেশন করে এবং সুস্থ থাকার অটোসাজেশন দেয়ার ফলে প্রভুর কৃপায় এখন পর্যন্ত এটা আমার আর একবারও হয় নি।
এখন আমার মনছবি হলো ডিপ্লোমার পর বিএসসি এবং এমএসসি সম্পন্ন করে একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হবো। আর কোয়ান্টামের সাথে যুক্ত থেকে দেশের সেবা করব এবং অসহায়-বঞ্চিত মানুষকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করব।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]