এটাই কি লিওনেল মেসির ক্যারিয়ারের শেষ এল ক্লাসিকো ছিল? হয়তো। সে ক্ষেত্রে শেষটা ভালো হলো না মেসির। ভালো হলো না বার্সেলোনারও।
রিয়াল মাদ্রিদের ‘আপৎকালীন’ মাঠ ভালদেবেবাসে আজ মৌসুমের শেষ এল ক্লাসিকোতে ২-১ গোলে হেরে গেছে বার্সা।
একেবারে ধ্রুপদী না হলেও দারুণ রোমাঞ্চে ঠাসা এক ম্যাচ হয়েছে। এল ক্লাসিকো কেন স্পেন ছাড়িয়ে ক্লাব ফুটবলেরই অন্যতম সেরা ম্যাচ, সেটির প্রমাণ রেখে গেছে ভালদেবেবাসের ৯০ মিনিট। কতটা রোমাঞ্চ ছিল তার প্রমাণ হয়তো এই যে, একেবারে শেষ সেকেন্ডে বার্সার ইলাইশ মরিবার শট বারে লেগে না ফিরলে ম্যাচটা শেষ হয় ড্র-তে।
তা হয়নি, শেষ পর্যন্ত বার্সাকে খালি হাতে ফেরত পাঠিয়েছে জিনেদিন জিদানের রিয়াল। লিগে মৌসুমের দুই ক্লাসিকোর দুটিই হেরেছে বার্সা, যেমনটা ২০০৭-০৮ সালেও করিয়েছে। রিয়ালের জন্য সুখবর, সেবার লিগ জিতেছিল রিয়াল।
আজকের জয়ে এবারও নিজেদের লিগ শিরোপার আশা আরও উজ্জ্বল করেছে রিয়াল। স্প্যানিশ লিগের শিরোপাদৌড়ে এই মুহূর্তে রিয়াল মাদ্রিদ সবার ওপরে। অন্তত ২৪ ঘন্টার জন্য তো বটেই! রিয়াল মাদ্রিদ ও আতলেতিকো মাদ্রিদ দুই দলেরই পয়েন্ট ৬৬, যদিও আতলেতিকো ম্যাচ খেলেছে রিয়ালের (৩০ ম্যাচ) চেয়ে একটি কম। বার্সেলোনার পয়েন্ট ৩০ ম্যাচে ৬৫। আতলেতিকো কাল রাতে খেলবে রিয়াল বেতিসের বিপক্ষে।
স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম কিংবা ইউরোপের কেউই এখনো জানে না মৌসুম শেষে বার্সার সঙ্গে শেষ হতে যাওয়া চুক্তিটা আবার মেসি নবায়ন করবেন কি না। না করলে এই হারই হয়ে থাকল ক্লাসিকোতে মেসির শেষ পদচারণার স্মৃতি।
তাতে বার্সা অধিনায়কের একটা রেকর্ড হওয়ার কথা ছিল। হলো। রিয়াল অধিনায়ক সের্হিও রামোস চোটের কারণে ম্যাচে নেই। মেসি তাই মাঠে নামলেই ছুঁয়ে ফেলতেন রামোসের সবচেয়ে বেশি ৪৫টি এল ক্লাসিকো খেলার রেকর্ড। বার্সেলোনা ফরোয়ার্ড তা ছুঁয়ে ফেললেন। এল ক্লাসিকোর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গোল ও অ্যাসিস্টের রেকর্ডও তাঁরই ছিল।
কিন্তু মেসির অযাচিত আরেকটা ব্যক্তিগত রেকর্ডও হয়ে গেল। এর আগের ছয় এল ক্লাসিকোর মতো এবারও গোলহীন থেকে গেলেন আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড। ক্যারিয়ারে এর আগে শেষ কবে টানা ৭ ম্যাচ গোলহীন ছিলেন মেসি, কখনো ছিলেন কি না, ভাবার ব্যাপার।
মেসির আরেকবার হতাশ হওয়ার রাতে করিম বেনজেমা উজ্জ্বল। আগের ৯টি এল ক্লাসিকোতে গোল পাননি। নিজেদের ‘আপৎকালীন’ মাঠ ভালদেবেবাসে আজ দশম ম্যাচে এসে গোলের দেখা বেনজেমা পেলেন ১৩ মিনিটে।
গোলটা কী দারুণই না হলো! দারুণ আক্রমণের পর ডানদিক দিকে বার্সা বক্সে নিচু ক্রস দিলেন রিয়াল রাইটব্যাক লুকাস ভাসকেজ। দারুণ এক ব্যাক ফ্লিকে বলটা জালে পাঠিয়ে দিলেন বেনজেমা। ফরাসি স্ট্রাইকারের উদ্যাপন দেখে মনে হলো, একা হাতে রিয়ালকে লিগ এনে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা যেন আসলেই করেছেন তিনি। সেটিতে এখন পর্যন্ত দারুণ সফল বেনজেমা।
ম্যাচটা রিয়ালের জন্য আক্ষরিক অর্থেই ফাইনালের মতো ছিল, না জিতলে লিগের শিরোপাদৌড়ে আর থাকার সম্ভাবনা থাকত না জিনেদিন জিদানের দলের। যে কোনো ম্যাচকেই ফাইনালের সম্মান দেওয়া জিদান যে এই ম্যাচেও দলকে সেভাবে উজ্জ্বীবিত করেছেন, তা নিয়ে সংশয় তাই কমই। ‘ফাইনাল’টা ফাইনালের মতোই খেলেছে রিয়াল।
পুরো ম্যাচে বার্সার বলের দখল ছিল ৬৯ শতাংশ। কিন্তু বার্সার এই বলের দখল যে অর্থহীন, তা-ই যেন প্রমাণ করে দিয়েছে রিয়াল। ম্যাচে প্রতিপক্ষের পোস্ট লক্ষ্য করে বার্সা শট নিয়েছে ১৮টি, রিয়াল ১৪টি।
এর মধ্যে রিয়ালের দ্বিতীয় একটা শটও পেল জালের আশ্রয়। সময় তখন ২৮ মিনিট, বক্সের বাইরে ফ্রি-কিক পেল রিয়াল। টনি ক্রুসের শট বার্সার দুই ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে ঢোকে জালে।
মাদ্রিদ তখন অনেক এগিয়ে, মাদ্রিদের মাঠে তখন তুমুল বৃষ্টি। বার্সার সামনে তখন পাহাড়ি পথ পাড়ি দেওয়ার লড়াই। যে লড়াইয়ে এবার আর উতরে যেতে পারেনি লিগে আগের ১৯ ম্যাচে অপরাজিত বার্সা।
রিয়ালের গোলসংখ্যা যে এর কিছুক্ষণ পরই ৩ হয়ে যায়নি, তার জন্য গোলকিপার টের স্টেগেন আর পোস্টকে ধন্যবাদ দেবে বার্সা। পাল্টা আক্রমণকেই কৌশল বানিয়ে খেলা রিয়াল দারুণ গতিতে উঠে আসে বার্সা বক্সে, এরপর ফেদেরিকো ভালভার্দের শট লেগেছে পোস্টে। ফিরতি বলে ভাসকেজের শট দারুণভাবে ঠেকিয়ে দেন টের স্টেগেন।
বিরতির ঠিক আগে প্রাণ ফেরে বার্সার আক্রমণে। মেসির একটা শট ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিরিয়ে দেন রিয়াল গোলকিপার কোর্তোয়া। তার কিছুক্ষণ পর মেসিরই কর্নার থেকে সরাসরি গোলের চেষ্টা ফেরে বারে লেগে। ২-০ গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় রিয়াল।
৩-৫-২ ছকে শুরু করা বার্সার কোচ রোনাল্ড কোমান দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই রাইটব্যাক সের্হিনিও দেস্তকে সরিয়ে মাঠে নামান আঁতোয়ান গ্রিজমানকে। বার্সা বদলে যায় ৪-৩-৩ ছকে। সেটির ফলই কিনা বার্সা পেল ৬০ মিনিটে। মেসির পাস ধরে বাঁ দিক থেকে ক্রস করেন জর্দি আলবা, কোনোরকমে তাতে পা ছুঁইয়ে গোল করেন ডিফেন্ডার অস্কার মিঙ্গেসা।
দুদলই এরপর কিছু সুযোগ পেয়েছে। আক্রমণ পাল্টা আক্রমণে জমে উঠেছে ম্যাচ। কিন্তু নাটক জমে ক্ষীর হয়েছে একেবারে শেষ দিকে এসে। পরপর দুই মিনিটে দুই হলুদ কার্ড দেখে ৯০ মিনিটে লাল কার্ড দেখেন রিয়ালের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার কাসেমিরো। শেষ মুহূর্তে মরিবাকে নিজেদের বক্সের সামনে ফাউল করেন রিয়ালের মিডফিল্ডার ইসকো। এর মধ্যে শট নিতে পোস্ট ছেড়ে উঠে যান বার্সার গোলকিপার টের স্টেগেন।
ফ্রি-কিক থেকে আসা বলে বক্সের মধ্যে থেকে প্রথমে শট নেন মরিবা। অবিশ্বাস্যভাবে বারে লেগে ফিরে আসে সেটি। এরপর বল যায় বক্সের কোণে দাঁড়ানো টের স্টেগেনের কাছে। শটও নিয়েছিলেন বার্সার জার্মান গোলকিপার, কিন্তু সেটি নিজেদেরই দলের খেলোয়াড় ত্রিনকাওয়ের গায়ে লেগে হয়ে যায় গোলকিক। এর মধ্যে রেফারি বাঁশি বাজিয়ে জানিয়ে দেন, আজ এই পর্যন্তই