কোয়ান্টাম আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের গৌরবময় ভাষা আন্দোলনের কথা। একুশ আমাদের জীবনে শপথের প্রতীক, অর্জনের প্রতীক। এমন জাতি পৃথিবীতে দুর্লভ যারা ভাষার জন্যে অকাতরে রক্ত দিতে পারে। একুশে রক্ত দেয়ার মাধ্যমেই আমরা অর্জন করেছিলাম আমাদের ভাষার অধিকার। আমরা একটি শপথ দিয়ে-‘বিশ্বাসের আলোকে বদলাবো নিজেকে।’ আর এ বদলানোর সূচনা আমরা করতে চাই ভাষা থেকে। এই বদলানোর শপথ নিয়েই .
কীভাবে একজন মানুষ বিশ্বাসের আলোকে নিজেকে বদলাতে পারেন। আর বিশ্বাসের আলোকে বদলানোর প্রথম ধাপই হচ্ছে দায়িত্ব নেওয়া। আর এ দায়িত্ব প্রকাশ পেয়েছে আমাদের শপথ বাক্যে-
আমি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবো।
অশ্লীল ও ব্যঙ্গাত্মক শব্দ বর্জন করবো।
একটি মানুষ ভালো না খারাপ তার প্রকাশ ঘটে ভাষার মাধ্যমে। পরিশীলিত মানুষের ভূষণ একটাই-সুবচন আর সদাচরণ। কারণ সুবচন ছাড়া সদাচরণ হবে না। আবার সদাচরণ করলে বচন সুবচন হবেই।
শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার পথে একটি অন্তরায় হচ্ছে ‘তুই’। কাউকে তুচ্ছার্থে তুই ডাকা থেকে আমরা বিরত থাকতে চাই। বিশেষ করে রিকশাচালক, গৃহকর্মী, রাস্তার টোকাই থেকে শুরু করে কাউকেই তুই ডাকা উচিত নয়।
অশুদ্ধ ভাষা হচ্ছে রূঢ় কথা বলার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম। কাউকে অসম্মানিত করারও সহজ মাধ্যম। যেমন ধরুন, ঘরের কাজ যারা করেন তাদেরকে চাকর/ চাকরানি/ কামলি/ কাজের মেয়ে না বলে যদি বলা হয় গৃহকর্মী বা হাউজ এসিস্ট্যান্ট বা কেয়ার গিভার, তাহলে তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু রেখেই কিন্তু পরিচয় বলা হয়ে যায় এবং সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখা যায়।
শুদ্ধ ভাষা মানে শ্রুতিমধুর, পরিশীলিত, মার্জিত কথা। কিন্তু বিভিন্নভাবে বর্তমানে শব্দের পরিবর্তনে ভাষা শ্রুতিকটু হয়ে গেছে।
যেমন, কয়েক বছর আগে ‘জিজ্ঞেস করার’ অশুদ্ধ এবং অত্যন্ত শ্রুতিকটু একটি প্রচলন হয়েছিলো-‘আবার জিগায়’ হিসেবে। ডিজুস জেনারেশন কখনো কখনো বলতো-‘আবার কয়’। এগুলো শুধু উচ্চারণের বিকৃতি নয় আসলে এসব হচ্ছে ভাষার অসম্মান।
আসলে ভাষা যত শুদ্ধ ও সুন্দর হয় পারস্পরিক সম্পর্ক তত গভীর হয়। ভুল বোঝাবুঝি কমে, সমমর্মিতা বাড়ে, আরেকজনকে সহজে অনুপ্রাণিত করা যায়, পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়ে। পৃথিবীর সকল মনীষীরা সুভাষী ছিলেন। সকল ধর্মে সুন্দর ভাষায় কথা বলার বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে
শপথের দ্বিতীয় বাক্য হচ্ছে-‘অশ্লীল ও ব্যাঙ্গাত্মক শব্দ পুরোপুরি বর্জন করবো।’
দেখা যায় যে আমরা যখন ঘরোয়া আলাপে আত্মীয়স্বজনদের মাঝে কিংবা ঘনিষ্ঠ বন্ধু/ বান্ধবী বা সহকর্মীদের সাথে বসে আড্ডা বা হালকা রসিকতায় মত্ত হয়ে উঠি তখনই সাধারণত আমরা অশ্লীল ও ব্যাঙ্গাত্মক শব্দ বেশি প্রয়োগ করি। আর ছাত্রছাত্রীরা দেখা যায় ইচ্ছায় অনিচ্ছায়, কারণে অকারণে বন্ধুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক সময় ব্যাঙ্গাত্মক শব্দ বাক্য বলে থাকে। ছাত্রছাত্রীরা যেসব ‘অশ্লীল ও ব্যাঙ্গাত্মক শব্দ’ ব্যবহার করে-
‡ মানুষের বা কোনো স্থানের নামের বিকৃত উচ্চারণ করে। যেমন, একজনের নাম বোরহান তাকে বলছে এই বোরহানি এদিকে আয়। কারো বাড়ি পটুয়াখালি কিন্তু একজন বিকৃত করে বলছে অমুকের বাড়ি পইট্যা।
‡ আবার, পরীক্ষার আগে ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রিপারেশন কেমন হয়েছে জানতে চাইলে উত্তরে বলেন এক্কেবারে ফটোস্ট্যাট প্রিপারেশন। মানে ফটোস্ট্যাট করলে হুবহু আসে তাই পরীক্ষার প্রস্ত্ততিও এমন হয়েছে।
‡ অনেক সময় বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে বলে আজকে পরীক্ষা ভালো হবে তার সম্ভাবিলিটি (সম্ভাবনা ও প্রবাবিলিটির মধ্যে সন্ধি করেছে) শূন্য।
আঞ্চলিক বা অশ্লীল ব্যাঙ্গাত্মক কথার তালিকা তৈরি করলে এটা শুধু দীর্ঘই হবে। কিন্তু আমরা জানি শব্দের প্রচন্ড শক্তি আছে আর এভাবে কথা বলার কারণে একেতো এটা অন্যায় হচ্ছে অন্যদিকে পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। শুদ্ধ শব্দে, ব্যাঙ্গ পরিহার করে কথা বলার চর্চা এবং চেষ্টা শুরু করতে হবে। একবারে সম্ভব না হলে ক্রমাগত করলে এটা সম্ভব। আর আমরা এই প্রচেষ্টা ধরে রাখতে চাই ঘরে-বাইরে সমানভাবে।
‘সবার সাথে সদাচরণ করবো’ আমরা বলতে পারি, যিনি সবার সাথে ভালো ব্যবহার করেন, যার মাঝে সবার প্রতি সমমর্মিতা বোধ রয়েছে, যাকে দেখলে আমাদের ভালো লাগে, আমরা ভরসা পাই, নতুন আশায় জেগে উঠি, তিনিই সদাচারী মানুষ।
আর সদাচারণ এত গুরুত্বপূর্ণ কারণ- ধরুন, কেউ একজন বেশ জ্ঞানী, গুণী, বিজ্ঞ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। কিন্তু বদমেজাজ আর দুর্ব্যবহারের কারণে কেউ তার কাছে যেতে সাহস পায় না। তার মানে তিনি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারেন নি। এমনকি যে বাবা-মা সবসময় দুর্ব্যবহার করেন, সন্তানরাও তাদের এড়িয়ে চলে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা দুর্ব্যবহার করে থাকি আমাদের অধীনস্থদের সাথে বিশেষত গৃহকর্মী, দারোয়ান, ড্রাইভার, অফিস সহকারী বা পিয়নের সাথে। আর এই দুর্ব্যবহারটা এখানেই যে শেষ হয়ে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়। এটা প্রকৃতিতে জমা থাকছে এবং যেকোনো সময় এটি বহুগুণ হয়ে আমাদের দিকে ফিরে আসতে পারে। তাই মা-বাবা, ভাই-বোন, প্রতিবেশী, সহকর্মী প্রত্যেকেই আমাদের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পাওয়ার অধিকার রাখেন।
ধর্মের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও আমরা সদাচারী হতে পারি না। এক্ষেত্রে মূল প্রয়োজন হচ্ছে সদাচারী হওয়ার সদিচ্ছা। আমি সদাচারী হবো-এই সদিচ্ছাটুকু যদি নিজের মধ্যে নিয়ে আসি। এই ইচ্ছার সাথে সাথে প্রয়োজন বাস্তবে কিছু চর্চা-
• নিজেকে দিয়ে চিন্তা করা যে, আমরা সাথে অন্যরা কী আচরণ করলে, কী কথা বললে আমি খুশি হই। তাহলে সেইভাবে কথা বলা, সেরকম আচরণ করা।
• সদাচরণ হচ্ছে ক্রমাগত অনুশীলনের একটা বিষয়। এজন্যে শিষ্টাচার কণিকা ১১টি পর্ব এবং সুবচন কণিকা, তিনটি পর্ব আছে। একটু ধৈর্য, মমতা আর আন্তরিকতার সাথে যদি তিনটি মাসও এই কণিকাগুলো নিয়মিত পড়া, অনুশীলন করা যায় তাহলে নিজের পরিবর্তনে নিজেই মুগ্ধ হবেন।
• কাউকে কোনো অনুরোধ করতে প্লিজ বলা বা মেহেরবানি করে বলা, ভুল হয়ে গেলে সরি বা দুঃখিত বলা-এটুকু দিয়েই শুরু করা যেতে পারে।
• যারা সদাচরণে অভ্যস্ত, তারা খেয়াল করে দেখতে পারেন আচরণের আর কী কী ফাঁক আমাদের মাঝে এখনো রয়ে গেছে। তারপর সেইভাবে নিজেকে শোধরানোর পদক্ষেপ নিয়ে শুরু করা।
• যেহেতু ভাষা ও আচরণের ব্যাপারে আমরা সচেতন হওয়ার চেষ্টা করছি, খুচরা শয়তান এই দিক দিয়েও আমাদেরকে বিপথগামী করার চেষ্টা করতে পারে। সে ব্যাপারেও সচেতন থাকা প্রয়োজন।
সবশেষে আমরা যদি মনছবি দেখি জীবনে আমরা যেন লাখো মানুষের ভরসাস্থল হতে পারি। মৃত্যুর পরও আমরা যদি বেঁচে থাকতে চাই প্রজন্মের পর প্রজন্মে-শ্রদ্ধায় আর ভালবাসায়। তাহলে প্রয়োজন সদাচারী হওয়া। পরম করুণাময় আমাদের সবাইকে সদাচারী হওয়ার সুযোগ দান করুন।
কোয়ান্টাম শিক্ষার্থী ওরিয়েন্টেশনের আলোচনা থেকে নেয়া।