জেএসসির পর আমাকে বাড়িতে ফিরতে হলো। ক্লাস নাইনে ভর্তি হলাম বালাঘাটা বিলকিস উচ্চ বিদ্যালয়ে। আমার ইচ্ছে ছিল কমার্স নিয়ে পড়ার। কিন্তু ভর্তির কয়েকদিনের মধ্যে আমাকে সায়েন্স নিতে বাধ্য করেন স্যারেরা। কারণ যাদের জিপিএ ৪-এর উপরে তাদের বাধ্যতামূলকভাবে সায়েন্স নিতে হবে। না হলে টিসি দিয়ে দেবে।
ভর্তি বাতিলও করতে পারছিলাম না। ভর্তি ফি ছিল ৫০০ টাকা। অনেকের কাছে এটা কিছুই না। কিন্তু তখন আমার কাছে ছিল সেটা অনেক টাকা! যেটা মা-বাবা অনেক কষ্ট করে যোগাড় করেছিলেন। আবার সায়েন্সে পড়লে কোচিং করতে হবে, সেটা আরেকটা ভয়। তাদের সাথে কথা বললাম, কী করা যায়? এখানে না পড়লে ভোকেশনালে যেতে হবে, সেখানেও সায়েন্স নিয়ে পড়তে হবে, আর সেটাও যদি না পড়তে চাই তাহলে বান্দরবান সদরে এসে পড়তে হবে। তা আরো কঠিন হয়ে যাবে। বাধ্য হয়ে সায়েন্স নিয়েই পড়লাম।
ভর্তির প্রথম দুই বছর আমি বাড়ি থেকেই ক্লাস করেছি। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে আমাকে স্কুলে যেতে হতো। যাওয়ার পথে কখনো কখনো কেউ আমাকে তাদের গাড়িতে উঠিয়ে নিত। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার। এমন দিনও গেছে সকালে খেয়েছি, আর দুপুরে খাওয়া হয় নি। বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা ক্লাস হতো। বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। বাসায় পৌঁছে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। ফ্রেশ হয়ে পড়ার টেবিলে বসতে পারতাম না। ঘুম চলে আসত। এভাবে এসএসসি পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট হলো ৩.৫৯।
এসময় পরিচিত এক মামা আমাকে কোয়ান্টামের খবর দেন। ছেলে ভালো কিছু করবে—এক বুক আশা নিয়ে বাবা আমাকে কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজে রেখে গেলেন। ২০১৭ সালের ১৩ মে আমি একাদশ শ্রেণিতে মানবিক বিভাগে ভর্তি হলাম।
প্রায় দেড় বছর আমি কোয়ান্টাম কসমো কলেজে ছিলাম। এইচএসসি সম্পন্ন করলাম ২০১৯ সালে। পরীক্ষার পরে এই কলেজে ভর্তি কোচিংয়ের জন্যেও বাছাই পরীক্ষা হয়। আমার আত্মবিশ্বাস ছিল যে, আমি টিকে যাব এবং ঐখানে কোচিং করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাব। আমরা ছিলাম ৭২ জন। কোচিংয়ের জন্যে ৩০ জনকে রাখা হলো। আমি চান্স পেলাম।
নিয়মিত মেডিটেশন করতাম। ‘শিথিলায়ন’ আমার পছন্দের মেডিটেশন। এটা আমার মনকে শিথিল রাখত। ফলে পড়ালেখা সহজেই মনে রাখতে পারতাম। মনছবি দেখতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি। কোয়ান্টামের দেখানো গাইডলাইন, মোটিভেশন, প্রত্যেকটা শিক্ষকের আন্তরিকতা ও মমতা আমার খুব ভালো লেগেছিল। এছাড়াও কোয়ান্টামে যাওয়ার আগে আমি যে-কোনো বিষয়ে একটুতেই রেগে যেতাম। কিন্তু এখন আমি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। সহজেই যে কারোর সাথে মানিয়ে নেয়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছে।
যা-হোক আমি ছবি অঁাকতে পছন্দ করতাম। কিন্তু ছবি এঁকে যে উচ্চশিক্ষা বা স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করা যায় তা জানতাম না। এই ক্যাম্পাসে এসে বড় ভাইদের সাথে কথা বলেই তা জানতে পারি। কোচিং করার সময় মাঝে মাঝে আলসেমি চলে আসত, তখন পাশের বন্ধুকে পড়তে দেখে অনুপ্রাণিত হতাম।
এইচএসসির রেজাল্ট বের হলো। আমি পেলাম জিপিএ ৪.৬৭। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। চান্স পেলাম কাক্সিক্ষত গন্তব্য চারুকলায়। সাবজেক্ট পেলাম প্রাচ্যকলা।
আসলে আমার ছবি আঁকার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু কারো কাছ থেকে যে দেখে শিখব বা কারো কাছে গিয়ে শিখব এই সুযোগটা ছিল না। যখন ক্লাস থ্রি-তে পড়তাম, স্কুলে একজন স্যার ছিলেন। আমরা সবাই উনাকে দাদু স্যার বলে ডাকতাম। স্কুলের স্যারদের মধ্যে বয়সে তিনি প্রবীণ ছিলেন। স্যারের ক্লাস আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে করতাম। স্যার আমাদের খুব ভালবাসতেন এবং অনেক যত্ন সহকারে পড়াতেন। পড়ালেখার পাশাপাশি আমাদের আনন্দ দেয়ার জন্যে উপদেশমূলক গল্প, কৌতুক শোনাতেন এবং সংখ্যা দিয়ে ছবি এঁকে দেখাতেন। মূলত সেখান থেকে আমার ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
মাধ্যমিকে হোস্টেলে থাকার সময় গাইড বইয়ের যে লেখকদের ছবি দেয়া থাকত তা অনুকরণ করতাম। এছাড়াও চারু ও কারুকলা বই থেকেও আমি ছবি অঁাকতাম। এটা আমার খুব পছন্দের বই ছিল। যেহেতু এটা আমার পছন্দের বই, তাই এই বিষয়ে জেএসসি পরীক্ষায় আমি এ প্লাস পেয়েছিলাম। নবম-দশম শ্রেণি বিজ্ঞানে নিজের প্র্যাকটিক্যাল খাতার ছবিগুলো আঁকতাম। পাশাপাশি বন্ধুদের খাতায়ও এঁকে দিতাম।
আমি সবসময় মনে করি, একজন মানুষকে বিকশিত করতে হলে প্রথমে তার মনোজগতে পরিবর্তন আনতে হয়। বিশেষত যারা অন্যদের তুলনায় সমাজে পেছনের কাতারে পড়ে আছে, এই পিছিয়ে পড়া কিশোর এবং তরুণরা নিজের সম্পর্কে খুবই নিচু ধারণা পোষণ করে। এই ধারণা কখনো তার নিজের সৃষ্টি করা, নয়তো সমাজ তাকে এভাবে ভাবতে শেখায়। আমি আমার চিত্রকলা অথবা লেখনির মাধ্যমে তাদের ভাবাতে চাই—তুমিও পারবে! শুধু ভাবনাটা রাখতে হবে পারা’র প্রতি। তাহলে সব সম্ভব।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]