1. [email protected] : আরএমজি বিডি নিউজ ডেস্ক :
  2. [email protected] : adminbackup :
মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১০:৫৪ অপরাহ্ন

ভাবনার দুয়ার খুলে গেল

  • সময় শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪
  • ১৩০ বার দেখা হয়েছে

ভাবনার দুয়ার খুলে গেল

মো. আব্দুল মোমেন

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
২০০৭ সাল, তখন আমি শিশুশ্রেণিতে পড়ি। বাবার কাছে প্রথম জানতে পারলাম কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের কথা। লেখাপড়া, খেলাধুলা করা যায় এমন এক স্কুলে বাচ্চাদের ভর্তি নিচ্ছে। বাবা আমাকে জানালে আমি প্রথমে রাজি হই নি। পরে পরিচিত একজন আমাকে রাজি করায় কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্যে।

কুয়াশাচ্ছন্ন এক সন্ধ্যায় ভারি কাপড় পরা দুজন ব্যক্তি একটি মোটরবাইক নিয়ে আমাদের গ্রামে আসেন। আমি স্কুলের খেলার মাঠ থেকে ময়লা কাপড় পরা অবস্থায় তাদের সামনে যাই। আমাকে বলা হয় ডান হাত মাথার উপর দিয়ে বাম কান ধরার জন্যে। আমি মনে করি, এটা পারলে মনে হয় আমি কসমো স্কুলে যেতে পারব। কিন্তু না, কান ধরার সাথে সাথে বলে দিল হবে না। আমি মন খারাপ করে চলে আসলাম।

কী আর করা! ২০০৮ সালে গ্রামের হযরত শাহ আব্দুল মালেক (রাহ) একাডেমিতে ভর্তি হই। আমাদের পাঁচ ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ বহন করা বাবার পক্ষে অসম্ভব ছিল। কিন্তু বাবা চাইতেন কৃষিকাজ করে যেন তার সন্তান জীবনযাপন না করে। ২০০৯ সালে বড় ভাই কলেজে পড়ত, মেজো ভাই অষ্টম শ্রেণিতে। তাদের পড়ার চাপ বেশি থাকায় আমাকে বাবার কাজের সঙ্গী হতে হয়েছিল। এভাবে চলতে চলতে ২০১৩ সালে পিইসি পরীক্ষায় সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পাই।

আবারো আমাকে কোয়ান্টামে ভর্তির কথা উঠল। কিন্তু তখন বাবা দিতে ইচ্ছুক নন। কারণ বাবার সঙ্গী বলতে কেউ থাকবে না। আমারও ইচ্ছে ছিল না। ২০১৪ সালে ভর্তি হই শাক্যমুনি উচ্চ বিদ্যালয়ে। আমার পিইসি রেজাল্ট দেখে স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ আমাকে খুব পছন্দ করতেন।

তখন থেকে বাবার সাথে নিয়মিত ক্ষেতে কাজ করে নিজের পড়ার খরচ নিজেকে বহন করতে হতো। ক্ষেতে কাজ করতাম আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। আমি আর আমার বাবা রাত ৩টা/ সাড়ে ৩টায় বাড়ি থেকে টর্চ লাইট নিয়ে বের হয়ে ভোর ৬টায় জমিতে পৌঁছাতাম। সেখান থেকে সবজি নিয়ে সকাল ৮টায় গ্রামের বাজারে নিয়ে যেতাম। তারপর স্কুলে যেতাম। মাঝে মাঝে ক্লান্তির কারণে স্কুলে যাওয়া হতো না। এভাবে চলতে থাকে আমার জীবন। লেখাপড়া খারাপ হতে থাকে। তাই শিক্ষকেরা আগের মতো খবরও নেন না। কয়েকজন শিক্ষক আমাকে আদর করে ‘ফাঁকিবাজ’ নাম ধরে ডাকা শুরু করলেন। পরিবারের আর্থিক অনটন আর কৃষিকাজের মতো কষ্টের মধ্য দিয়ে আরো দুটি বছর পার করলাম।

পাশাপাশি পড়াশোনা চলছে, জেএসসি মডেল টেস্ট দিলাম। আমার রেজাল্ট তেমন ভালো হলো না। আমার বড় ভাই, চাচাতো ভাই, বাবাসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে একটি মিটিং করলাম। আমার দাবি ছিল অক্টোবরে একমাস কাজে যাব না, বাড়ির কোনো কাজ করব না। পরীক্ষার পর নিয়মিত কৃষিকাজ ও বাড়ির কাজ করব। এমন না হলে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব। কারণ এসময়টা আমি পড়তে চাই।

পরে সবাই সিদ্ধান্ত নেয় যে, আমি একমাস পড়াশোনা করব। এই একমাস পড়াশোনা হলো রুটিন মতো। পরীক্ষা শেষ হলো নভেম্বরে। তারপর বাবা আমাকে বড় ভাইয়ের দোকানে কাজের জন্যে পাঠিয়ে দিলেন লামায়। আমিও নতুন কাজ শিখতে আগ্রহী, তাই রাজি হয়ে গেলাম।

জেএসসি রেজাল্ট প্রকাশিত হলো। আমাদের স্কুল থেকে চার জন গোল্ডেন এ প্লাস পেল। তাদের মধ্যে আমি একমাত্র আমাদের গ্রাম থেকে সকল বিষয়ে এ প্লাস পাওয়া ছাত্র। পরিবারে সবাই অনেক খুশি হয়েছিল। আমি দোকানের কাজ ছেড়ে বাড়ি চলে এলাম। গ্রামে যারা শিক্ষিত তারা আমার বাবাকে বলতে থাকে আমাকে ভালো স্কুলে ভর্তি করে দেয়ার জন্যে।

বাবা পড়ে যান মহাবিপদে। বাবারও স্বপ্ন জাগে আমাকে ডাক্তারি পড়ানোর। আর তিনি জানতেন এজন্যে অনেক টাকা প্রয়োজন। কিন্তু তখন আমার চিন্তা—আমি একজন ডেকোরেশন মিস্ত্রি হবো। কারণ এই কাজ অনেকটা আমার আয়ত্তে চলে আসে সে-সময়।

২০১৫-এর ডিসেম্বরে আমি জানতে পারলাম, কোয়ান্টাম কসমো স্কুল থেকে শিক্ষার্থীরা লামায় আসবে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে। আমার আগ্রহ জন্মে তাদের একবার হলেও দেখতে যাব। কিন্তু দুঃখের বিষয় দোকানে কাজের চাপ বেশি থাকায় তাদের দেখার সুযোগ হলো না, দেখলাম শুধু তাদের গাড়ি। ২০১৭ সালে হঠাৎ বাবা ফোন করে আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে ভর্তি হবো কিনা। আমি কোনো উত্তর না দিয়েই কথা শেষ করি। পরে আমি আমার বড় ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম। তিনি আমাকে ভর্তির পরামর্শ দিলেন।

কিন্তু আমার সেখানে ভর্তি হওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। অবশেষে আমাকে বসতে হলো ভর্তি পরীক্ষায়। আমাদের গ্রাম থেকে আমরা চার জন আসি, তার মধ্যে আমার চাচাতো ভাই একজন। আমরা দুজনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা ভালোমতো পরীক্ষা দেবো না। কিন্তু বাবার দিকে তাকিয়ে মনে হলো—ভালোমতো পরীক্ষা দেই। লিখিত পরীক্ষা শেষ করলাম। চান্সও পেলাম। শুরু হলো আমার কোয়ান্টা জীবন।

প্রাকৃতিক পরিবেশ, শিক্ষকবৃন্দ ও কোয়ান্টাদের আচরণ আমাকে মুগ্ধ করল। ক্লাসে গিয়ে দেখলাম একেকজন একেকটি বিষয়ে অসাধারণ মেধাবী। অনেকের আবার খেলাধুলায় জাতীয় পুরস্কার আছে। তাদের দেখে আমারও ইচ্ছে হয় এই পুরস্কার অর্জনের। আমাকে দেয়া হয় ভলিবলে। এর মধ্যে নতুন ভর্তি হওয়া কয়েকজন কোয়ান্টা—আশরাফ আলী, ওসমান, সাকিব ও হ্লানুমং মার্মা আমার খেলার সঙ্গী হয়। বড় ভাই শৈক্যচিং, তিনি আমাকে অনেক পছন্দ করতেন। সময় পেলেই তার সাথে কথা বলতাম। তার কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানতে পারলাম।

কিছুদিন পর আমাদের ট্রেইনার বজলুর স্যার যোগ দিলেন। আমাদের পুরোদমে অনুশীলন শুরু হয়। আমরা স্বপ্ন দেখতে থাকি জাতীয় স্কুল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার। মাঠে চলে তুমুল প্রতিযোগিতা। আমাদের চান্স পেতে হবে ১২ জনের স্কুল টিমে।

একদিকে নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা অন্যদিকে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় প্রতিযোগিতা। ডিসেম্বরে পরীক্ষা হলো। কিছুদিন পর রেজাল্ট প্রকাশিত হলো। পাশও করলাম।

জানুয়ারিতে আমাদের খেলা শুরু। জীবনে প্রথম গ্রামের বাইরে স্টেডিয়ামে খেলা। ফাইনাল খেলায় আমরা চ্যাম্পিয়ন হই। এটা ছিল কোয়ান্টাদের প্রথম ভলিবল জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ। তারপর শুরু হয় আমাদের এসএসসি প্রস্তুতি। ২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষা সম্পন্ন করে কলেজে ভর্তি হই। কিন্তু বছর শেষ না হতেই চলে আসে করোনা ভাইরাস। তারপরও এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিলাম। এ প্লাস পেলাম। যদিও মেডিকেলে চান্স পেলাম না, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় হাতছাড়া হয় নি।

এখন মনে পড়লে অবাক লাগে, আগে চিন্তার পরিধি কত ক্ষুদ্র ছিল! আগে হতে চাইতাম ডেকোরেশন মিস্ত্রি। ভাবতাম বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বিয়ে বাড়িতে ডেকোরেশনের কাজ করাটা মস্ত বড় কাজ। অথচ কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে এসে ভাবতে শুরু করলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। সেই ভাবনাটাই সত্যি হলো। আমি এখন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী।

২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছিল আমার কোয়ান্টা জীবন। এসময় আমি শিক্ষকদের অনেক ভালবাসা পেয়েছি। আর শিখেছি ভালো আচরণ এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। সবকিছুর জন্যে মহান আল্লাহর নিকট আমি কৃতজ্ঞ।

[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]

শেয়ার করুন

এই শাখার আরো সংবাদ পড়ুন
All Rights Reserved © rmgbdnews24.com