ছোটবেলায় বাবা আমাকে বাল্যশিক্ষা ও ধারাপাত নামের দুটি বই পড়িয়েছিলেন। তারপর আমাকে ২০০৯ সালে গ্রামে শিলছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। আমি অনেক দুষ্টু ছিলাম। মা-বাবার খুব আদরের হওয়ায় পড়াশোনা ঠিকমতো করতাম না। এভাবেই ক্লাস ফাইভ শেষ করলাম।
কাছাকাছি কোনো হাই স্কুল না থাকায় মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার জন্যে বাবা চিন্তায় পড়ে যান। অবশেষে বাবা আমাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার বলীপাড়া বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে আমি ষষ্ঠ শ্রেণি ভালোমতো পার করলাম। এরপরে সপ্তম শ্রেণিতে চার-পাঁচ মাস পড়ে, সেখান থেকে সবকিছু ছেড়ে বাড়িতে পালিয়ে গেলাম। বাড়িতে পালিয়ে যাওয়ার পর, আবার আমাকে অন্য একটি স্কুল ঘিলাতলী নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেয়া হয়। সেই স্কুল থেকে আমি জেএসসি পরীক্ষা দিলাম।
জেএসসি পরীক্ষার পর আবার ভর্তি হলাম বান্দরবান জেলায়। এবার নবম শ্রেণিতে জেনারেলে ভর্তি না হয়ে ভর্তি হলাম বান্দরবান কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। কারণ আমার তখন স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। নবম ও দশম শ্রেণি আমি সেই কারিগরি স্কুলেই পড়েছিলাম এবং ২০১৯ সালে ভোকেশনাল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিলাম।
এবার বাবা বললেন, আমি আর খরচ দিতে পারছি না। তিনি আমাকে নিজ উদ্যোগে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে বললেন। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম, কী করা যায়। তারপর আমার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে যায়। কিন্তু কোয়ান্টাম কসমো কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলাম। কোয়ান্টাম কসমো কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হলাম। কোনো খরচ দেয়া লাগল না। সবকিছু কলেজ থেকেই দেয়। তারপর শুরু হলো কলেজ জীবন, এখানে এসে পেলাম নতুন পরিবেশ।
প্রথমে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে একটু কষ্ট হয়েছিল। যদিও পরে সব ঠিক হয়ে যায়। সাধারণত এসময় ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে। ইঞ্জিনিয়ার যেহেতু হতে পারব না, তাই আমি মানসিকভাবে ভেঙে গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন চিন্তা করলাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্বাদ কেমন তা জানা দরকার।
তারপর একদিন বন্ধুদের ছবি আঁকা দেখে আমিও মজা করে আঁকতে বসলাম। তখন থেকে ঠিক করলাম আমি চারুকলায় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেব। মেডিটেশনে মনছবি দেখতাম চারুকলা নিয়ে। তারপর থেকে সময় পেলে মাঝে মাঝে ছবি আঁকতাম, ভালোই লাগত। এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম জিপিএ ৪.৯৩ নিয়ে।
তারপর শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি যুদ্ধ। অনেকে বিভিন্ন জায়গায় চলে যায় কোচিং করার জন্যে। আর আমরা কয়েকজন ক্যাম্পাসে নিজেরাই পড়ি। মাঝে মাঝে বড় ভাইয়েরা আসতেন পড়াশোনার সমস্যাগুলো সমাধান করে দিতেন। এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় এসে গেল। পরীক্ষা দিলাম চ ইউনিটে। বাড়িতে গিয়ে অপেক্ষা করছিলাম ফলাফলের জন্যে। সবসময় বিশ্বাস করেছি যে, আমি পারব। আমি সত্যিই পেরেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি।
মানুষের জীবনের লক্ষ্যটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অনেকেই জানি না আমাদের জীবনের লক্ষ্য কী। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হতো তোমরা বড় হয়ে কী হতে চাও? তখন আমরা উত্তর দিতাম যে—পাইলট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, সৈনিক, শিক্ষক ইত্যাদি। একজন মানুষের অনেক ইচ্ছা থাকতে পারে। আমিও একদম ছোটবেলায় হতে চেয়েছিলাম ডাক্তার। আবার আমি যখন একটু বড় হলাম তখন হতে চেয়েছিলাম ইঞ্জিনিয়ার। সেই সুবাদে জেএসসি পরীক্ষার পর ভর্তি হয়েছিলাম কারিগরিতে। আবার শিক্ষক হতে চাই এটাও বলতাম।
তারপর কোয়ান্টাম কসমো কলেজে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত বলা হতো তোমার জীবনের লক্ষ্য কী? আমার কাছে তখন আর কোনো উত্তর ছিল না। কারণ ছোটবেলা থেকে আমার মাঝে নানা দ্বিধা কাজ করত। তারপর স্কুলে আমাদেরকে ‘শিক্ষার্থী মেডিটেশন’ করানো হলো। মনছবি দেখতে বলা হলো। সকল দ্বিধা-সংশয় ঝেড়ে কোথায় আমার মেধা এবং আগ্রহ তা নিয়ে চিন্তা করলাম। ধ্যানে আমি আমার করণীয় বুঝতে পারলাম। আমি তখন মনে মনে ঠিক করলাম চারুকলা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে।
একজন ছাত্র প্রাথমিক শিক্ষাটা পায় পরিবারের কাছ থেকে। একজন ছাত্রের গাইডলাইন তার পরিবার সবচেয়ে ভালোভাবে দিতে পারে। আমি ছোটবেলায় ভালো গাইডলাইন পাই নি। কোনোকিছু করতে গেলে আমাকে হাজার বার চিন্তা করতে হয় পরিবার টাকা দিতে পারবে কিনা। তবে আমার এত মানসিক চাপ আর আর্থিক সমস্যার মধ্যেও আমি কখনো পড়ালেখা ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবি নি। সবসময় চিন্তা করেছি, যে করেই হোক পড়ালেখা চালিয়ে যাব। আজ পর্যন্ত লেখাপড়ার জন্যে সকল বাধা অতিক্রম করে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছি। এটাই আমার কাছে অনেক গর্বের বিষয়।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি কোয়ান্টামের সাথে থেকে সৃষ্টির সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাই। আমার লক্ষ্য এখন মানুষের সেবা করা। সবসময় হাসিমুখে আমি মানুষের সেবা করতে চাই। আর ভবিষ্যতে আমি একজন বড় ভাস্কর হবো।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]