– শেখ শাহাদাৎ হোসেন
পর্ব -২
দু’ভাই দাঁড়িয়ে আছি নাড়ার ওপর; পানি আর কাদায় গোড়ালি পর্যন্ত ডুবে আছে। আমাদের বামে একটু দুরে পশ্চিমে অল্প উচ্চতার ভিটা; তার ওপর নিঃসঙ্গ এক বরই গাছ। আরো অনেকটা দুরে, দক্ষিণ-পশ্চিমে বেশ উঁচু একটা ভিটা; সেখানে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে বড় তালগাছ; নিশ্চুপ, সঙ্গীহীন যেন। পাশেই অনেকটা জায়গা জুড়ে বিশাল বিল; জলে ভরে টই টুম্বুর। এরপর বেশ দুরে ছায়াবৃত কয়েকটি গ্রাম। পরবর্তীতে সেগুলোর নাম জেনেছি – গোপালপুর, বাজড়া, পানাইল। একটু এগিয়ে ডানদিকে বড় এক ভিটায় অনেক বাবলা গাছ নিবিড় ঘণ হয়ে যেন জড়াজড়ি করে আছে। তার ঠিক পাশের ভিটার ওপর ডালপালা ঝাপটানো অনেক বড় এক আমগাছ। সবই নিঃসঙ্গ; কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব নেই। সেটা ছাড়িয়ে পূব দিকে একটা গ্রাম। ফাঁকা ফাঁকা বেশ ক’টা বাড়ি ; নাম নন্দীগ্রাম। এলাকার অধিকাংশ মানুষ বলে- নান্দী গাঁ।
সূর্যের তেজ বেশ বেড়েছে; শীত শীত ভাবটা কমে আসছে ক্রমশঃ। আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ; গোটা প্রান্তর যেন সোনালি রঙে রাঙা। বাবার হাতে পরা ’কেমি’ ঘড়িটার কাটা যখন সাড়ে সাতটার ঘরে, তখন রওনা দিয়েছি দু’ভাই। যত রাত করেই ঘুমান না কেন, খুব ভোরে তাঁর বিছানা ছাড়ার অভ্যাস। আমাদের পাঠিয়ে দিয়ে বাবা তীরে নেমে পড়েছেন শ্রমিকের খোঁজে। মেজো ভাই লিয়াকত একটু নবাব টাইপের; ভোরের শীতল হাওয়ায় টেনে ঘুম দিচ্ছে। সূর্যের দিকে তাকিয়ে অনুমান করলাম,সকাল সোয়া আটটার মত বাজে। ভেবে দেখলাম, আর ভাবার মত সময় নেই; এবার গ্রামের দিকে যাওয়ার পালা। মিয়াভাইও পুনরায় তাড়া দিল; আমি সোজা উত্তর দিকে হাঁটা শুরু করলাম। দেখতে পেলাম সর্ষে আর কলাইয়ের শিশুচারাগুলো নাড়া ভেদ করে বেড়ে উঠতে শুরু করেছে। হয়তো আর কিছুদিন পরই সারাটা দিগন্ত সবুজ আর হলুদ রঙে সেজে উঠবে। তবে বড় অদ্ভূত যাত্রা আমার; গ্রামে যাচ্ছি, অথচ নিজেদের বাড়িটাই চিনি না।
রওনা দেয়ার কিছুক্ষণ পরে বেশ চওড়া একটা পথ পেয়ে পুব দিকে হাঁটা শুরু করলাম। কারণ ভেবে দেখলাম, জেলেরা যখন পুকুরে ঝাকি জাল ফেলে; তখন একদিক দিয়ে তারা বেড় দেয়। এর অর্থ হল, মাছগুলোর কোন দিক দিয়ে পালিয়ে যাবার উপায় থাকে না। তেমনি আমি যদি পুরো গ্রামটার প্রতিটি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিই; দেখা যাবে একসময় না একসময় নিজেদের বাড়িটা ঠিকই পেয়ে যাব। মাঠে লোকজন তেমন নেই। যারা আছে, তারা-ও অনেকটা দুরে দুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তা ছাড়া আমার যে অবয়ব; তাতে সহজে কারো চোখে পড়ার কথা নয়। সূর্য কিরণ সরাসরি আমার চোখে মুখে লাগছে; উত্তাপটা ভালোই টের পাচ্ছি। একসময় গ্রামের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেলাম; এখন আমাকে সোজা উত্তর দিকের মাঠটুকু পাড়ি দিয়ে প্রথম বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু নিচু জায়গা বলে পানি থই থই করছে গোটা গ্রামটার সামনে। এ অবস্থায় কি করে ওপারে পৌঁছাবো, তাই ভেবে চিন্তায় পড়ে গেলাম। হঠাৎ ডানদিকে তাকিয়ে দেখি কলমি, কচুরিপানা আর কিছু জলজ আগাছা স্তুপ করে একটা ভাসমান পথ তৈরি করা হয়েছে। তাই দেখে যেন অকুলে কুল পেলাম। তারপর বিকল্প পথ বেয়ে সাবধানে চলতে শুরু করলাম; কারণ তখনো আমি সাঁতার জানি না।
( ছবি সংগৃহীত; লেখাটি ধারাবাহিকভাবে চলবে )