একসময় আমাদের গ্রামবাংলায়, এমনকি শহরের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ব্যবহার করা হতো মাটির থালা, গ্লাস, কলস, পানির জগ, মটকা, হাঁড়ি ইত্যাদি। সভ্যতার উন্নতির কারণে ঘরোয়াভাবে মাটির পাত্র এখন তেমন একটা ব্যবহার হয় না। মাটির পাত্রের স্থানে জায়গা করে নিয়েছে প্লাস্টিক, মেলামাইন, এলুমিনিয়াম, সিরামিকের তৈজসপত্র। তবে এলুমিনিয়ামসহ অন্যান্য পাত্রের চেয়ে ক্লে-পট বা মাটির পাত্রে খাবার রান্না, খাওয়া ও সংরক্ষণের বহুমুখী উপকারিতার কথাই এখন বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
খাবারের স্বাদ বাড়ে
স্বাদ ও পুষ্টি বিবেচনায় সব ধরনের রান্নার জন্য মাটির পাত্র উপযোগী। বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারাহ মাসুদা বলেন, মাটির পাত্রে রান্না করা হলে খাবারের পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে এবং স্বাদ ভালো হয়।
স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী
মাটির ছিদ্রযুক্ত প্রকৃতি তাপকে সমানভাবে সঞ্চালন ও খাবারের পুষ্টি ধরে রাখতে সাহায্য করে। মাটি অ্যালকালাইন গোত্রের হওয়ার কারণে মাটির পাত্রে রান্না করলে খাবারে আয়রন, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।
হৃৎপিণ্ডের জন্যও উপকারী
ইউনানী শাস্ত্রে শরীর সুস্থ রাখার জন্য মাটির পাত্রে রান্না করার কথা বলা হয়েছে। আসলে মাটির পাত্রে রান্নায় তেল লাগে কম। তাই যারা হৃদরোগী এবং যারা হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে চান তাদের জন্যে মাটির পাত্র আদর্শ। বাড়তি পাওনা ব্যয়হ্রাস।
হজমে সুবিধা
কাদামাটি দিয়ে তৈরি হওয়ায় মাটির পাত্র প্রাকৃতিকভাবে ক্ষারযুক্ত। রান্নাকালে এই ক্ষারীয় উপাদান খাবারের অ্যাসিড প্রক্রিয়াজাতকরণে সাহায্য করে এবং পিএইচ-এর ভারসাম্য বজায় রাখে। ফলে খাবার হয় সহজপাচ্য এবং হজম হয় ভালো।
প্লাস্টিকের নিরাপদ বিকল্প
মাটির পাত্র প্লাস্টিকের পাত্রের তুলনায় পরিবেশবান্ধব এবং কাচের পাত্রের চেয়ে সাশ্রয়ী। তাই প্লাস্টিকের অতি ব্যবহার দরুন মাটি ও পরিবেশ দূষণের যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে তা কমাতে দারুণ কার্যকরী হলো মাটির পাত্র।
এছাড়াও, প্লাস্টিকের পরিবর্তে মাটির গ্লাস বা পাত্রে পানি পান করা হলে তা টেস্টোস্টেরনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
পাকস্থলীর জন্যে ভালো
আমরা যে খাবার গ্রহণ করি তার বেশিরভাগই শরীরে অ্যাসিডিক হয়ে যায়। মাটির পাত্র ক্ষারীয় গঠনের হওয়ায় এতে খাবার খেলে অ্যাসিডিটি ও পাকস্থলীর সমস্যা প্রতিরোধ হয়।
এছাড়া, পানির সুষম পিএইচ বা অম্ল-ক্ষার নিয়ন্ত্রণে রেখে গ্যাসের যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে মাটির গ্লাসে পানি পান।
ফ্রিজের ঠান্ডা পানির বিকল্প
অনেকেই সাথে ব্যক্তিগত কাঁচের বা প্লাস্টিকের বোতলে করে পানি রাখেন। প্রচণ্ড গরমে একটু ঠান্ডা পানি না হলেই নয়! কিন্তু সরাসরি ফ্রিজের ঠান্ডা পানি শরীরের জন্যে ক্ষতিকর। করণীয় কী? খুব সহজ! এখন থেকে পানি পান করুন মাটির বোতল থেকে। কারণ মাটির বোতলে পানি থাকবে প্রাকৃতিকভাবে ঠান্ডা।
খাবার দীর্ঘসময় ভালো থাকে
পোড়ামাটির পাত্রের অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি খাবারের টক্সিন অপসারণ করে। পোড়ামাটির পাত্রের সূক্ষ্ম ছিদ্র আর্দ্রতা অপসারণ ও দীর্ঘ সময় খাবার সংরক্ষণ করতে সাহায্য করে।
মাটির পাত্র খাবার গরমও রাখে। এধরণের পাত্র উচ্চতাপে পুড়িয়ে বানানো হয় বলে তা অনেকটাই তাপরোধী হয়ে ওঠে। ফলে তা রান্না খাবারকে দীর্ঘ সময়ের জন্য গরম রাখতে পারে।
মাটির পাত্রে পানি সংরক্ষণে মিলবে যেসব উপকার
আগে মাটির কলসিতে পানি রাখার প্রচলন ছিল। প্রাকৃতিকভাবে শীতল করার বৈশিষ্ট্য রয়েছে মাটির। বিশেষ করে গরমকালে মাটির কলসি, জগ ও গ্লাস ব্যবহার করলে পানি যেমন ঠান্ডা থাকে; তেমনি উপকৃত হয় শরীরও।
লোহা, স্টিল কিংবা প্লাস্টিকজাতীয় পাত্রে পানি রাখলে সেখান থেকে নানা ধরনের দূষিত পদার্থ ঢুকতে পারে শরীরে। কিন্তু মাটির পাত্রে পানি রাখলে এমন আশঙ্কা নেই। বরং আছে স্বাস্থ্যগত উপকারিতা।
মাটির পাত্রে পানি রাখলে পানিতে হরেক রকমের খনিজ পদার্থ মেশে। ফলে শরীর পায় প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাপ্লাইড সায়েন্সেস অ্যান্ড টেকনোলজি (IJEAST) দ্বারা পরিচালিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, মাটির পাত্রে সংরক্ষণ করা পানিতে প্লাস্টিকের বোতলে সংরক্ষিত পানির তুলনায় গুণমান বজায় থাকে বেশি।
খনিজ উপাদান এবং ইলেকট্রোম্যাগনেটিক শক্তিতে সমৃদ্ধ থাকে কাদামাটি। তাই মাটির পাত্রে পানি সংরক্ষণ করা হলে তা পানির নিরাময় ক্ষমতা বাড়ায়।
দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারকে ভালো রাখে
মাটির পাত্র দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার সংরক্ষণের জন্য খুবই উপযোগী। মাটির একটি শীতল প্রভাব রয়েছে যা দুধকে টক হতে বাধা দেয়।
এখনকার মাটির পাত্র ব্যবহারে কিছু সতর্কতা অবলম্বর করা উত্তম। কারণ এগুলোতে কেমিকেল ব্যবহার করে চকচকে করা হয়। এই চকচকে প্রলেপ পোড়ামাটির ছিদ্রকে বন্ধ করে দেয়।
ফারাহ মাসুদা বলেন, পলিশ করা বা চকচকে মাটির পাত্র রান্নায় ব্যবহার না করাই ভালো। পলিশের সময় রাসায়নিক উপাদান ব্যবহারে এর প্রাকৃতিক গুণাগুণ নষ্ট হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে খাবারে বিষক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
তাই দেখতে সুন্দর হলেও চকচকে প্রলেপযুক্ত মাটির পাত্র ব্যবহার না করে সাধারণ পোড়ামাটির পাত্র ব্যবহার করুন খাবার রান্না, সংরক্ষণ ও খাওয়ার কাজে। এ ধরনের পাত্রেই মাটির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে। কোনো রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহৃত না হওয়ায় তা নিরাপদও।