1. [email protected] : আরএমজি বিডি নিউজ ডেস্ক :
  2. [email protected] : adminbackup :
রবিবার, ২৩ মার্চ ২০২৫, ০৬:৩৯ পূর্বাহ্ন

মায়ের দুধের বিকল্প আর কোনো খাবার আছে কি?

  • সময় মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
  • ১০৫ বার দেখা হয়েছে

মায়ের দুধ শিশুর জীবনের প্রথম খাবার হওয়া উচিত—এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা এক বাক্যে রায় দিয়েছেন। কারণ এটি সবচেয়ে আদর্শ ও প্রাকৃতিক শিশুখাদ্য। শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানো শুধু শিশুর জন্যেই যে উপকারী তা নয়, বরং শারীরিক-মানসিক নানা দিক থেকে স্তন্যদানকারী মা-ও এ থেকে উপকৃত হন।

জন্মের পর প্রথম দিনগুলোতে শিশুর শরীরে নানারকম রোগজীবাণু সংক্রমণের ভয় থাকে। এ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় খাবারটি হলো মায়ের দুধ। এতে থাকা বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক উপাদান শিশুর বেড়ে ওঠা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর জীবনের প্রথম দিনগুলোতে মায়ের বুকের শাল দুধ হওয়া উচিত শিশুর প্রথম খাবার।

শিশুর জন্যে প্রকৃতির প্রথম টিকা হলো শালদুধ। হলুদাভ আঠালো এই পদার্থটি পুষ্টিবিজ্ঞানীদের ভাষায় তরল সোনা। কারণ এতে রয়েছে বিভিন্ন রকম রোগ প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি, প্রোটিন, ক্যারোটিন, ভিটামিন এ, ডি, ই, বি-১২ এবং রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় শ্বেতকণিকা। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের কাছে এই শালদুধ বিস্ময়কর একটি খাদ্য উপাদান। এ-ছাড়াও মায়ের দুধপানের মাধ্যমে শিশু মায়ের কাছ থেকে জন্মগতভাবে লাভ করে রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোষগত স্মৃতি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শিশুকে দুই বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ খাওয়ানো উচিত। শিশুর ছয় মাস বয়স থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবারও দেয়া যাবে। চিকিৎসকদের মতে, প্রথম ছয় মাস এক ফোঁটা পানিরও প্রয়োজন নেই। সব ধরনের প্রয়োজন পূরণে তখন মায়ের দুধই যথেষ্ট।

শরীরের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে উৎপাদিত অক্সিটোসিন নামক হরমোনের প্রভাবেই মায়ের দুধ নিঃসরিত হয়। গবেষকেরা বলেন, এ হরমোনটি মায়ের শরীর-মনে এক প্রশান্তিময় অবস্থার সৃষ্টি করে ও নানাভাবে মায়ের শরীরকে পুষ্টিসমৃদ্ধ করে, যা তাকে পরবর্তীতে টেনশন বা চাপজনিত অনেক অসুস্থতা থেকে মুক্ত রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মা তাদের নবজাত সন্তানদের টানা সাত সপ্তাহ ধরে স্তন্যদান করেছেন তারা অন্যান্য মায়েদের তুলনায় অনেক বেশি প্রশান্ত, স্থির ও টেনশনমুক্ত। এ-ছাড়াও স্তন্যদান প্রক্রিয়ায় মায়ের শরীরের আরো একটি হরমোনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বিটা-এন্ডোরফিন নামক এ হরমোন স্তন্যদায়ী মায়ের মধ্যে এক ধরনের আনন্দ অনুভূতির জন্ম দেয়। এ হরমোনের প্রভাবে মা ও শিশুর পারস্পরিক সম্পর্ক হয়ে ওঠে আরো গভীর ও মমতাপূর্ণ। এন্ডোরফিন ব্রেনে আলফা ওয়েভ সৃষ্টির মাধ্যমে মনকে করে প্রশান্ত।

শুধু তা-ই নয়, জন্মের পরপরই শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান করালে মায়ের রক্তক্ষরণ তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়, গর্ভফুল তাড়াতাড়ি পড়ে যায় এবং জরায়ু দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। শিশুকে বুকের দুধ পান করালে মায়ের সুস্থতা, শারীরিক পুনর্গঠন ও গড়ন দ্রুত পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান করানোর সময় পর্যন্ত গর্ভধারণের কোনো সম্ভাবনা থাকে না। মা তার দুধ শিশুকে পান করানোর মাধ্যমে আত্মতৃপ্তি লাভ করে এবং মা ও তার সন্তানের মধ্যকার বন্ধন দৃঢ় হয়। যেসব মা যথানিয়মে তাদের সন্তানদের বুকের দুধ খাওয়ান তাদের ক্ষেত্রে স্তন ও জরায়ুর ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি, বার্ধক্যজনিত হাড়ক্ষয় ও ডায়াবেটিসের আশঙ্কা কমে যায় অনেকখানি।

ইংল্যান্ডে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত মায়ের দুধ পান করে এমন নবজাতকেরা তুলনামূলক বেশি কাঁদে, যা সদ্যজাত শিশুর ফুসফুসের সুষম গঠন ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করে। এ-ছাড়াও কুইন্সল্যান্ডে চার হাজার শিশুর ওপর পরিচালিত আরেকটি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মায়ের দুধ পান করে যেসব শিশু, বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে তারা তুলনামূলক বেশি প্রখর। তাদের মতে, যেসব মা তাদের নবজাতকদের পূর্ণ সময় অর্থাৎ দুবছর স্তন্যদান করেছেন সেসব শিশু বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে থাকে। যে শিশু মায়ের দুধ পায় তার বুদ্ধিবৃত্তি মাতৃদুগ্ধ বঞ্চিত শিশুর চেয়ে ৮.৫ পয়েন্ট বেশি। কারণ মাতৃদুগ্ধে টরিন নামক রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা শিশুর ব্রেন টিস্যু তৈরি ও পরিপক্কতায় সাহায্য করে। সুষম মানসিক বিকাশের জন্যে এটি প্রয়োজনীয় উপাদানে সমৃদ্ধ। শিশুর দাঁত ও মাড়ির গঠন সুন্দর হয়। পরবর্তী জীবনে হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। নির্ধারিত সময়ের আগে জন্ম নেয়া অপরিণত ও কম ওজনের শিশুর জন্যে মায়ের দুধ সবচেয়ে নিরাপদ খাবার।

স্থূল বিজ্ঞাপন আর লোভনীয় প্রচারের ফাঁদে পড়ে পৃথিবীব্যাপী মায়ের দুধের পরিবর্তে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত শিশুখাদ্য। পশ্চিমা বিশ্বে জন্মহার কমে যাওয়ায় এসব প্রক্রিয়াজাত শিশুখাদ্যের প্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ীরা মুনাফার জন্যে এখন ঝুঁকেছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর দিকে।

এসব মিথ্যা প্রচারণার ফাঁদে পড়ে অনেকেই তাই অধিকতর পুষ্টির আশায় মায়ের দুধের পরিবর্তে শিশুর জন্যে প্রক্রিয়াজাত খাবারকেই বেছে নিচ্ছেন। প্রাণঘাতী ও দীর্ঘমেয়াদে আশঙ্কাজনক এ শিশুখাদ্যগুলো প্রকৃতপক্ষে শিশুর বেড়ে ওঠা ও সুস্বাস্থ্যের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর। প্রক্রিয়াজাত শিশুখাদ্য খেয়ে পৃথিবীজুড়ে শিশুরা যেসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সেগুলোকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘বটল বেবি ডিজিজ’। গুঁড়া দুধ যেভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয় তাতে ব্যাকটেরিয়া অক্ষত থেকে যায়। এ দুধ খাওয়ার ফলে টাইফয়েড ও মেনিনজাইটিস-সহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে শিশুর মৃত্যুও হতে পারে।

২০০৮ সালের নভেম্বরে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এক সেমিনারে বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের মহাসচিব ও দেশের প্রখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সুফিয়া খাতুন এ তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি সেই সেমিনারে বলেন, ২০০৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গুঁড়া দুধ ও অন্যান্য শিশু খাদ্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছে।

দেখা গেছে, গুঁড়া দুধ যেভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয় তাতে ব্যাকটেরিয়া মারা যায় না, অক্ষত থেকে যায়। এসব গুঁড়া দুধে ই-কোলাই ও সালমোনেলা নামক ব্যাকটেরিয়া থাকার প্রমাণ পায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তিনি বলেন, গুঁড়া দুধ শিশুদের জন্যে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ এবং এ দুধ খাওয়ার ফলে টাইফয়েড, ম্যানিনজাইটিস, নিউমোনিয়া ও পুষ্টিহীনতাসহ বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার ও শিশুমৃত্যুর আশঙ্কা থেকে যায়।

সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে যেমন লেখা থাকে ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর’ তেমনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও গুঁড়া দুধ উৎপাদক এবং প্রক্রিয়াজাতকারীকে শিশুদের জীবন রক্ষার্থে দুধের কৌটার গায়ে ‘এই দুধ জীবাণুমুক্ত নয়’ কথাটি লেখার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু কোনো দেশ আজও তা বাস্তবায়ন করতে পারে নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সেমিনারে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. খুরশীদ তালুকদার বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার বেশিরভাগ নারী-পুরুষ মরণব্যাধি এইডসের জীবাণু বাহক এবং অধিকাংশই এইডস রোগী। তাই সে দেশে শিশুদের মায়ের দুধের বদলে গুঁড়া দুধ খাওয়ানোর জন্যে সরকারিভাবে ঘোষণা দেয়া হয়। পরবর্তীতে দেখা যায়, অপুষ্টির কারণে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, টাইফয়েডসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে শিশুমৃত্যুর হার সেখানে ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। পরে সরকার বাধ্য হয়ে শিশুদের গুঁড়া দুধের বদলে মায়ের দুধ খাওয়ানোর নির্দেশ জারি করে। এর ফলে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্তমানে শিশুমৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে এবং শতকরা একজন শিশুও সেখানে এইডস-এ আক্রান্ত হয় নি।

সে দেশের বিশেষজ্ঞরা গবেষণায় প্রমাণ পেয়েছেন, এইডস আক্রান্ত মায়ের দুধও শিশুর জন্যে নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত। ঐ সেমিনারে দেশের প্রখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম কিউ কে তালুকদার বলেন, শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানো পবিত্র কোরআনে নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ। যে মা জন্মের পর দুবছর পর্যন্ত তার সন্তানকে নিয়মিত বুকের দুধ খাইয়েছেন তার জন্যে জান্নাত ওয়াজিব। মা হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসসহ যে-কোনো সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকলেও মায়ের দুধ শিশুর জন্যে সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং তাতে শিশুর সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। তিনি শিশুকে প্রক্রিয়াজাত কোনো দুধ, দুগ্ধজাত খাবার ও বিকল্প শিশু খাদ্য না খাওয়ানোর পরামর্শ দেন। তাই চিকিৎসা-সংক্রান্ত কোনো জটিলতা না থাকলে শিশুকে অবশ্যই মায়ের দুধ দিন।

শেয়ার করুন

এই শাখার আরো সংবাদ পড়ুন
All Rights Reserved © rmgbdnews24.com