আসসালামু আলাইকুম।
আমাদের বীর শহীদান, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বীর নারীদের যাদের ত্যাগ যাদের ঘাম যাদের রক্ত আমাদের দেশকে স্বাধীন করেছে এবং স্বাধীন দেশের মানুষ হিসিবে পরিচয় দেয়ার আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে এবং আমাদের জাতির স্বাধীন আত্মবিকাশের পথকে যারা উন্মুক্ত করেছেন সেই বীর শহীদান, বীর মুক্তযিোদ্ধা এবং বীর নারীদের প্রতি গভীর গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
আসলে এই যে ‘কৃতজ্ঞতা’ কৃতজ্ঞতা হচ্ছে শান্তির শুরু। কৃতজ্ঞ না হতে পারলে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে না পারলে একজন মানুষ কখনো ঋণমুক্ত হয় না এবং সে কখনো শিথিল হতে পারে না। আর শিথিল হতে না পারলে সে কখনো প্রশান্তি বা সুখরে সন্ধান পায় না।
সুখের শুরু, শান্তির শুরু, প্রজ্ঞার শুরু, শিথিলায়নের শুরু-সবকছিুর শুরু হচ্ছে শুকরিয়া, কৃতজ্ঞতা।
তো আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি তাদের প্রতি।
আসলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা যেরকম অবদান রেখেছিলেন, তাদেরকে যারা সহায়তা করেছেন, তাদেরকে যারা আশ্রয় দিয়েছেন, তাদেরকে যারা রান্না করে শুধু গরম ভাত, একটু নুন-ভাত দিয়েছেন, এর চেয়ে বেশে সার্মথ্য হয়তো তার ছিল না, সেই নুন ভাতটুকুর জন্যেও আমরা তাদের প্রতি সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
যারা মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচানোর জন্যে নিজেরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কিন্তু কোনো তথ্য প্রকাশ করনে নাই, যারা আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্যে আশ্রয় দিয়েছেন, যারা মানুষকে অনুপ্রাণিত করছেন গান লিখে কবিতা লিখে ভাষা লিখে, সেই শব্দসৈনিকদের প্রতিও আমরা গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
এবং সেই সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন দেশের সব মানুষ কিছু কিছু দুরাত্মা দুরাচারী বাদ দিয়ে সব মানুষ। এবং মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন সব মানুষ।
স্বপ্ন একসাথে দেখলে সবাই দেখলে জাতিগত স্বপ্ন যে কত প্রবল হতে পারে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হচ্ছে তার প্রমাণ।
২৬শে মার্চ আমরা যুদ্ধ শুরু করলাম। ১৬ই ডিসেম্বর যুদ্ধ শেষ।
এত অল্প সময়ে পৃথিবীর কোনো জাতি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে কখনো স্বাধীনতা র্অজন করতে পারে নাই যেটা আমাদের জাতি আমাদের দেশ করেছে!
এবং সেই সময়ে আসলে যারা সাহায্য করেছেন সহযোগিতা করেছেন, অধিকাংশের নামই মানুষের ইতিহাসে লেখা হবে না।
কিন্তু আল্লাহর যে ইতিহাস, স্রষ্টার যে ইতিহাস, সেই আমলনামায় তাদের এই সৎর্কমগুলো অবশ্যই যুক্ত হবে।
আমাদের এক গ্রাজুয়েট, বীর মুক্তিযোদ্ধা, তিনি বলেছিলেন যে যুদ্ধের সময় ক্ষুধা কত তীব্র হতে পারে, সেই উপলব্ধির কথা।
একবার টানা কয়েক সপ্তাহ শুধু গুড়-চিড়া খেয়ে কাটাতে হলো। গুড়-চিড়া।
তাও প্রতিবেলা নয়।
এরপর এক অপারেশনে যে অপারেশন সাকসেসফুলি সম্পন্ন করলেন তিনি, মিশন শেষ হওয়ার পরে নিকটবর্তী এক গ্রামে তারা আশ্রয় নিয়েছেন, ছোট্ট দল।
এক কৃষক, তার ৮-১০ বছরের মেয়েকে সাথে নিয়ে দেখা করতে এলো। সে মুক্তিযোদ্ধাদের একবেলা ভাত খাওয়াতে চায়।
এবং যখন কৃষক ভাত খাওয়াতে চাইল, তার যে ছোট মেয়ে সে বায়না ধরল যে তার পোষা ছাগলটা সে মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে দেবে খাওয়ার জন্যে। তো স্বাভাবিকভাবেই দরিদ্র কৃষক পরিবার তাদের কাছ থেকে টাকা ছাড়া ছাগল নেয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা কীভাবে নেয়! আবার সাথে তেমন টাকাপয়সাও নাই।
তো তাদের সবার যা ছিল, একত্রে জড়ো করে ১০ টাকার মতো হলো। সেটাই ঐ বাচ্চা মেয়েটিকে তারা দিল উপহার হিসেবে। এবং সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলছিলেন ৪৮ বছর পরে এই ঘটনা গত বছর।
যে সেদিনের গরম ভাত আর দু’টুকরো মাংস, এর চেয়ে তৃপ্তি নিয়ে কোনো খাবার আজ র্পযন্ত খাইনি। কেন?
সেই গরম ভাত আর সেই মাংসের টুকরার মধ্যে মমতা ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ভালবাসা ছিল। এবং এই কৃষক এবং কৃষক কন্যার দেশপ্রেম ছিল, যে দেশের জন্যে যারা ত্যাগ করছে, জীবন বাজি রেখে যারা কাজ করছে, তাদের জন্যে এই সামান্য তার কাছে যা ছিল তা দিয়েই তাদেরকে মেহমানদারি করার সুযোগ সে নিয়েছে।
আসলে সবাই যে যুদ্ধ করবে তা না। যার যে কাজ, যতটুকু কাজ, সেটাই সেটুকু করতে পারা এইটাই হচ্ছে সর্বোচ্চ দেশপ্রেম।
ধরেন, ঐ কৃষক কন্যা, ৮-১০ বছরের শিশু। তার প্রিয় সবচেয়ে মানে… আসলে এখনকার ছেলেমেয়েরা বোঝে না যে মুরগি যে পালে বা ছাগল যে পালে ওটার প্রতি তার মমতা কতটুকু! এই ছাগলটিই হচ্ছে তার মমতা এবং তার সম্বল সবটাই।
এবং সে সেটুকুও দিয়ে দিয়েছিল। কিসের জন্যে? দেশের জন্যে। মুক্তিযোদ্ধারা যেমন দেশপ্রেমিক, এই শিশুটিও দেশপ্রেমে তাদের কাছ থেকে পেছনে পড়ে ছিল না। অর্থাৎ, এই শিশুটিও দেশপ্রেমের চূড়ান্ত উদাহরণ স্থাপন করেছে তার পালা ছাগলটি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দেয়ার মধ্য দিয়ে।
কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে, যারা যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছেন তারা জানেন যে যুদ্ধক্ষেত্রে গুলি পাওয়া যায় কিন্তু খাবার পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। যে বুলেটের চেয়ে খাবার হচ্ছে অনেক বেশি মূল্যবান। কারণ বুলেট তো শত্রুকে মারলইে বুলেট। কিন্তু শত্রুকে মারলে তো খাবার আসবে না। তাই খাবারটা হচ্ছে এত ইম্পরট্যান্ট।
অতএব সেই সময়ে, যিনি যতটুকু ত্যাগ করেছেন, অন্তর থেকে ত্যাগ করেছেন, সেটার জন্যে সবার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
আসলে দেশের জন্যে সবাই যে পেশায় থাকুন, যে কাজে থাকুন সবাই কিন্তু তার অবদান রাখতে পারেন। কিন্তু সেই অবদানটা হতে হবে নিঃস্বার্থ এবং তখনই সেটা দেশের জন্যে হয়। আর যখন স্বার্থের জন্যে হয়, তখন সেটা দেশের জন্যে হয় না, সেটা স্রষ্টার জন্যে হয় না।
যে মানুষের লেখা ইতিহাসে এই শিশুটির নাম কোনোদিন জানা যাবে না, লেখা হবে না।
কিন্তু আল্লাহর যে ইতিহাস, তিনি যে আমলনামা লিখেছেন, লিখে রাখার জন্যে ফেরেশেতা নিয়োগ করেছেন সেই আমলনামায় তার এই অবদান লেখা হয়ে থাকবে।
এবং আখেরাতে এই আমলনামা প্লেস করা হবে এবং এটার উসিলায়ই হয়তো দেখা যাবে যে এই শিশুটি বড় হয়ে যত পাপ করেছে, সমস্ত পাপ তার মোচন হয়ে গেছে ঐ একটি অবদান রাখার জন্যে।
কারণ আপনি আল্লাহর ইবাদত করতে গাফলতি করলেন, আল্লাহ মাফ করে দিতে পারেন। কিন্তু কোনো মানুষের ওপর যদি আপনি অন্যায় করেন, সেটা আল্লাহ মাফ করবেন না, সে মাফ না করা পর্যন্ত।
আর আরেকজন মানুষ যখন কারও উপকার করে, যার উপকার হলো সে হয়তো সেই কৃতজ্ঞতা ছাড়া তার দেওয়ার মতন আর কিছু থাকে না। কিন্তু আল্লাহ তাকে বহুগুণ পুরস্কৃত করেন যে উপকারটা করল তাকে সেটা পৃথিবীতে, ইহকালে এবং পরকালে।
[কোয়ান্টামম সাদাকায়ন, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২০]