আসলে সেবা বলতে আমরা মনে করি যে, একটা পুকুর বা খাল খনন করলেই সেবা হয়ে গেল। একবার একজন আমাকে বললো, খাল খনন করতে হবে। আমি বললাম, আমার হাতের যা অবস্থা তাতে দু-চার কোদাল মাটি কাটলে হাত ছিলে যাবে। তার চেয়ে খাল খননে আমার যে অংশগ্রহণ সেখানে একজন লোক দিয়ে দেই যে মাটি কাটে। তাকে পুরোদিনের পারিশ্রমিক দিয়ে দেবো।
অর্থাৎ যে কাজে আপনার মেধা আছে সেখানে আপনার মেধাকে বিকশিত করতে হবে। তাহলেই আপনি সৃষ্টির সেবা করতে পারবেন এবং আপনার প্রাচুর্য আসবে। ধরুন আমি স্ট্যাম্প সংগ্রহ করতে ভালোবাসি। যখন শুধু নিজে সংগ্রহ করছি তখন এটা আমার শখ থাকছে। কিন্তু ধরুন একই ধরনের স্ট্যাম্প আমার দশটা আছে। সেগুলোকে আমি অন্যদের মাঝে বিতরণ করার ব্যবস্থা করলাম এবং বিনিময়ে আমি কিছু পয়সা পেলাম। এটা আমি সেবা দিলাম এবং সে সেবার প্রতিদান দিলো।
যেমন আমাদের যশোরের এক গ্রাজুয়েট। পড়াশোনা বেশি করতে পারে নি, এসএসসি পর্যন্ত পড়েছে। এরপর আর পড়াশোনা হয় নি। গরু, ছাগল, মুরগি এগুলোর প্রতি তার একটা দুর্বলতা ছিলো। কোনো ট্রেনিং ছাড়াই, শুনে শুনে। এর মধ্যে সে গরু মোটাতাজাকরণের যে ট্রেনিং হয় যুব উন্নযন অধিদপ্তরে, সেটি করে নিলো। এই ট্রেনিংটুকু তার সম্বল। তার যেহেতু গরু-ছাগলের প্রতি দুর্বলতা, সে এ ব্যাপারেই গ্রামের মানুষকে পরামর্শ ও সেবা দিতে লাগলো।
পাশের বাড়ির গরুর ডায়রিয়া হয়েছে, বলে দিল যে এই ওষুধ দিলে ভালো হবে। ক্ষুরারোগ হয়েছে, এই ওষুধ দিতে হবে, দিয়ে দিলো। তাদের বুদ্ধি দিলো যে, এই খাওয়ালে আপনার গরু মোটা হবে, চর্বিদার হবে, বেশি দামে বিক্রি করতে পারবেন। তাদেরকে বুঝালো যে, আপনার গরুটাকে ক্রস করান। আপনার এই গরু দেয় ২ সের দুধ। অস্ট্রেলিয়ান গরু দেয় ২০ সের দুধ। এটাকে অস্ট্রেলিয়ানের সাথে ক্রস করালে দুধ দেবে ১১ সের।
কত লাভবান হবেন আপনি। সে গরু নিয়ে ক্রস করিয়ে আনতো। হয়তো সে গিয়ে একটা গরু দেখে এসেছে, ওষুধ দিয়ে এসেছে। তার তো ওখানেই কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। সে কিন্তু কাজটা ওখানে শেষ করে নি। সে আবার যখন ওখান দিয়ে যাচ্ছে জিজ্ঞেস করছে ‘চাচা, আপনার গরুটা কেমন আছে।’
অর্থাৎ খোঁজ খবর নিচ্ছে। ভেটেরিনারি সার্জন আছেন, কিন্তু তারা তো একবারের বেশি দুবার যান না। তার বাবা তাকে একদম পছন্দ করতো না। ছেলে লেখাপড়া বাদ দিয়ে গরু-ছাগল-মুরগির পেছনে ঘুরছে। কিন্তু সে বাবাকে বলতো ‘বাবা তুমি দোয়া কর আমার জন্যে যাতে আমি তোমাকে প্রত্যেকদিন তোমার হাতখরচের টাকা দিতে পারি।
প্রথমে সে শুরু করেছিলো এমনি এমনি সেবা দেয়া। এরপর লোকজন তাকে ডাকতে শুরু করলো। একসময় পুরো গ্রামের লোকজন সবাই তার ওপরে নির্ভরশীল হয়ে গেল। তার বুদ্ধিতে চলতে লাগলো। পরবর্তীতে কীটনাশক ওষুধ, সার কোম্পানি যারাই তাদের পণ্য বিক্রির উদ্দেশ্যে গ্রামে যেত তাকে ডাকত যে, দেখেন এই সারে এই উপকার হয়। তারা আবার তাকে বিভিন্ন ট্রেনিংয়েও পাঠাতো।
কারণ তারা জানতো সে বলে দিলে তাহলেই গ্রামের লোক শুনবে, অন্য কেউ বললে হবে না। কারণ তার বিশ্বাস ছিলো, সে মেধাকে সেবায় রূপান্তরিত করেছিল। যশোরের একটি গ্রামে বসে সে সৎপথে, সেবার বিনিময়ে স্বচ্ছলভাবে জীবনযাপন শুরু করলো।
অর্থাৎ এটাই হচ্ছে মেধাকে সেবায় রূপান্তরিত করা যা প্রাচুর্য আনে। সে শুধু নিজের জন্যে চিন্তা করে নি। গ্রামের অনেক মানুষকে সে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করেছে। অতএব সবসময় খুঁজতে হবে যে, আমার মেধাটা কোথায়, কোন কাজটা আমি ভালো করতে পারি। সেই কাজেই আপনার প্রাচুর্য আসবে।
এখন পৃথিবীতে সবাই যদি এমবিএ হয়ে যায়, সবাই যদি ডাক্তার হয়ে যায় তো রোগী কোথায় পাওয়া যাবে? সবাই কোনোদিন ডাক্তার হবে না, সবাই কোনোদিন এমবিএ হবে না। সবাই কোনোদিন ইঞ্জিনিয়ার হবে না। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সবার প্রয়োজনও নাই। কিন্তু সবারই নিজস্ব কিছু মেধা আছে যে মেধাটাকে একজন মানুষ অনায়াসে সেবায় রূপান্তরিত করতে পারে।