আমার বাড়ি বান্দরবানে লামা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নে। আমার বাবা একজন প্রতিবন্ধী কৃষক। আমার পড়ালেখা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ তার ছিল না। এ নিয়ে কোনো ক্ষোভ নেই আমার। গ্রামের একটি স্কুলে আমার শিক্ষার হাতেখড়ি এবং সেখানেই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ি। সে-সময় আমি ইউনিয়নের মধ্যে অনেক ভালো রেজাল্ট করেছিলাম।
পরে ভর্তি হই লামা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। যা ছিল আমার বাড়ি থেকে প্রায় ছয় থেকে সাত কিলোমিটার দূরে। স্কুলে আমাকে পায়ে হেঁটে যেতে হতো। কারণ তখনো গাড়িতে যাওয়ার কোনো সিস্টেম ছিল না। আমার বাবা ভাবতেন পড়ালেখা করে কি কিছু করা যাবে? যেহেতু ছোট ছিলাম, এসব কিছু আমি বুঝতাম না।
এর মধ্যে দেখি আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে এবং পরিবারকে কাজে সাহায্য করা শুরু করেছে। কিন্তু আমি তখনো হাল ছেড়ে দেই নি। কারণ সামনে জেএসসি পরীক্ষা। এবার বাবা আমার লেখাপড়া নিয়ে একটু ভাবা শুরু করলেন। পরীক্ষার সময় যাতে আমার যাওয়া আসার সময় বেঁচে যায়, তাই বাবা পরীক্ষা কেন্দ্রের কাছে ঘর ভাড়া খুঁজছিলেন।
কিন্তু তিনি অনেক চেষ্টা চালিয়েও ভাড়া পান নি। তাই আমাকে নিজের বাড়ি থেকে পরীক্ষা দিতে হয় এবং আমি এই পরীক্ষায় পাশও করি। পরে নবম শ্রেণিতে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হই। সে-সময়ে ভালোভাবে পড়ালেখা চালিয়ে গিয়েছিলাম। দেখতে দেখতে একসময় এসএসসি পরীক্ষা চলে এলো। সেখানেও সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হলাম।
এরপর শুরু হয় এক সংগ্রামের অধ্যায়। যেখানে আমার কিছু বন্ধু কে কোন কলেজে ভর্তি হবে তা নিয়ে ব্যস্ত, সেখানে আমাকে খুঁজে নিতে হয়েছে একটি পার্ট টাইম জব। সেখান থেকে আমি মাস শেষে চার হাজার টাকা বেতন পেতাম। চাকরি করতে গিয়ে আমি লেখাপড়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই।
এরমধ্যে মা পরিকল্পনা করেছিলেন, কারো কাছ থেকে দুই/ আড়াই লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে আমাকে বিদেশে পাঠানো যায় কিনা। অবশেষে এই বিষয়ে বাবা আমার সাথে আলোচনা করেন। কিন্তু বাবাকে আমি বললাম, আমি দেশেই থাকব এবং পড়াশোনা করব। এই কথা শুনে বাবা বললেন, তা কীভাবে সম্ভব? আমাদের তো সে সামর্থ্য নেই। আমি বলেছিলাম, চিন্তা করবেন না, আল্লাহ ব্যবস্থা করে দেবেন।
এই আশা নিয়ে বিভিন্ন কলেজের খোঁজ নিতে লাগলাম—কোথায় কম খরচে আমি পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারব। অবশেষে খোঁজ পাই কোয়ান্টাম কসমো কলেজের। আমিও ভর্তির জন্যে আবেদন করলাম এবং ভর্তির সুযোগও পেয়ে গেলাম। কোয়ান্টামের সাথে যাত্রা শুরু হলো।
তখন আমি পড়ালেখা কী জন্যে করছি সেই কারণটি আমার কাছে স্পষ্ট ছিল না। কিছু করতে হবে বলতে, শুধু জানতাম ভালোভাবে পড়ালেখা করা। কারণ অধিকাংশ মানুষই ছাত্রাবস্থায় কিছু করা বলতে প্রধানত পড়ালেখাকে বোঝে। সেই ধারাবাহিকতায় আমি আমার পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এই কলেজে এসে আমি বুঝতে পারি স্বপ্ন পূরণে পড়ালেখার গুরুত্ব। শুধু পড়লেই হবে না, নিজের জীবনে সেগুলো প্রয়োগ করতে হবে। এখানে আরো খুঁজে পাই ভালো কাজ করার অনুপ্রেরণা।
কসমো কলেজে আমার নিয়মিত পড়ালেখা চলতে থাকে। প্রথম বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছিলাম। এরপর দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে তাতেও ভালো রেজাল্ট করি। সব স্যার আমাকে অনেক ভালবাসতেন। স্যারদের কাছে যে-কোনো বিষয় নিয়ে গেলে তারা আমাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না বুঝি ততক্ষণ পর্যন্ত বুঝিয়ে দিতেন। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা তাই সব সিলেবাস গোছানো শেষ। এখন শুধু বাকি পরীক্ষা দেয়া এবং ভার্সিটিতে ভর্তির জন্যে প্রস্তুতি।
কিন্তু এর মধ্যে শুরু হলো নতুন এক আতঙ্ক, করোনা মহামারি। শুরু থেকে গুরুজী দাদু এই আতঙ্ক নিয়ে ভয় না পাওয়ার জন্যে বলেছিলেন। সামাজিক দূরত্ব নয়, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলতেন এবং আমরা তা-ই করতাম। কিন্তু সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সকল পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়া হলো। স্কুল-কলেজ বন্ধ হওয়ায় আমিও বাসায় চলে যাই। এরই মধ্যে এলাকার অনেকে বলাবলি শুরু করল পড়ালেখা করে আর কিছুই করা সম্ভব না।
কিন্তু আমি তাতে বিশ্বাস করতাম না। আমি আমার স্বপ্নের প্রতি বিশ্বাস রাখলাম এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্যে কাজ চালিয়ে গেলাম। কিছুদিন যেতে না যেতেই সরকার ঘোষণা দিল ২০২০ সালে এইচএসসি পরীক্ষা হবে না। অটোপাশ করে দেয়া হবে। কিন্তু আমি তো ভালোমতো পড়ালেখা করেছিলাম কলেজে এসে। এখন এই পড়ালেখার কোনো মূল্যায়ন করা হবে না!
রেজাল্ট প্রকাশিত হলো। রেজাল্টে আমি এ মাইনাস পেলাম। এই রেজাল্ট দিয়ে ভালো কোনো ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করা যায় না। কিন্তু সে-বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় নতুন এক উদ্যোগ নিয়েছিল যার নাম গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা ২০২০। শুরুতে খুশি হলেও এতে তেমন উপকার হয় নি। কারণ আমি আবেদন করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারি নি। তারপরেও আমি হাল ধরে রেখেছিলাম। তখনো আমি বিশ্বাসী ছিলাম—আমি পড়ালেখা করব এবং তা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেডিটেশনে সবসময় মনছবি দেখতাম। আসলেই নিয়মিত মেডিটেশন করলে মনছবির বীজ অঙ্কুরিত হয়, মনোযোগ বাড়ে, যে-কোনো বিষয়কে ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়—এর প্রমাণ আমি নিজেই।
কিছুদিন পর জানতে পারলাম, গুচ্ছ ভর্তি কমিটি আবেদনের শর্ত কমিয়ে দেয়। আমি আবেদনের যোগ্যতা পেয়ে যাই। আবেদন করার পর আমার আশেপাশের বন্ধুরা কেউ ঢাকা, কেউ চট্টগ্রামের নামিদামি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হচ্ছে। শহরে থেকে পড়াশোনা করছে।
আমি এসব সুযোগ-সুবিধায় বিশ্বাসী ছিলাম না। আর চাইলেও আমার বাবা আমাকে সেই সুযোগ করে দিতে পারবেন না। কিছুদিন পর পরীক্ষার তারিখ হলো এবং পরীক্ষাও দিয়ে ফেললাম। আমি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিভাগে প্রথম হলাম এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলাম।
আমি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের সাবজেক্টে ভর্তি হয়ে গেলাম। আমার সাবজেক্টে আমার রোল এক। বর্তমানে আমি আমার বিভাগের শ্রেণি প্রতিনিধি, যা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দায়িত্ব। আমি ভবিষ্যতে (সিএ) চার্টার্ড একাউন্টেন্ট হতে চাই।
আমার এই অবস্থানে পৌঁছানোর পেছনে মূল অবদান হচ্ছে আমার শিক্ষকদের এবং কোয়ান্টামের। আমি কোয়ান্টা পরিচয়টি আজীবন খুব গর্বের সাথে ধারণ করতে চাই।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]