1. [email protected] : আরএমজি বিডি নিউজ ডেস্ক :
  2. [email protected] : adminbackup :
বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৭:৫১ অপরাহ্ন

সত্যের জন্যে যারা কাজ করেন, ইতিহাস তাদের মাথা নুইয়ে স্বীকৃতি দেয়

  • সময় মঙ্গলবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২১
  • ৯২২ বার দেখা হয়েছে
আজকে যে ওয়াইফাই, যা নিয়ে আমরা এত হুড়াহুড়ি করছি তিনি এই ওয়াইফাইয়ের জনক ছিলেন। যদিও জনক হিসেবে তিনি স্বীকৃতি পান তার মৃত্যুর ৮০ বছর পরে। এবং একজন মানুষ যে কত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করতে পারেন প্রো-একটিভ থাকতে পারেন, তিনি তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
তিনি হচ্ছেন আমাদের দেশের কৃতি সন্তান বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। আসলে বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম বিজ্ঞান এবং সায়েন্স ফিকশন লেখেন। তার পিতৃভূমি ছিল বিক্রমপুর। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ময়মনসিংহে।
তিনি চাইলেন ছেলে বাংলা শিখুক
তার বাবা ভগবানচন্দ্র বসু ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ইংরেজ সরকারের আমলে। এখন যে-রকম আমরা ইংলিশ মিডিয়ামটাকে মনে করি যে কী? এটা হচ্ছে জাতে ওঠার প্রতীক। সে-সময়ও যারা ইংরেজ সরকারের চাকরি করতেন, তাদের সন্তানকে ইংরেজি স্কুলে পড়ানোটা ছিল আভিজাত্যের প্রতীক।
কিন্তু ভগবানচন্দ্র বসু খুব আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। এবং তিনি চাইলেন যে, ইংরেজি শিক্ষার আগে তার সন্তান বাংলা শিখুক। মাতৃভাষা শিখুক। তারপর না হয় বিদেশি ভাষা শিখবে। তিনি স্বদেশী স্কুলে ভর্তি করে দিলেন তাকে। এবং ১৯১৫ সালে বিক্রমপুরে জগদীশচন্দ্র বসু এক বক্তৃতায় সেসময়কার অবস্থা বলেন-
এমন মা পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার!
‘আমাদের সময় সন্তানদের ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করানো ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। যে স্বদেশী স্কুলে আমাকে ভর্তি করে দেয়া হয়েছিল সে স্কুলে আমার ডান পাশে বসত আমার পিতার মুসলিম পরিচারকের ছেলে। ‘পরিচারক’ মানে হচ্ছে বাবুর্চি। এবং আমার বাম পাশে বসত একজন জেলের ছেলে। তারাই ছিল আমার খেলার সাথি।
যখন আমরা ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে আসতাম, আমার মা আমাদের একসাথেই খাবার খেতে দিতেন। আমার মা স্বধর্মপরায়ণ এবং প্রথাসম্মত গৃহিণী ছিলেন। কিন্তু ধর্ম নিয়ে গোঁড়ামি করা তার স্বভাব ছিল না। তাই তিনি তার ছেলের সঙ্গী অস্পৃশ্য বালকদের প্রতি ছিলেন যথেষ্ট মমতাশীল।’
আসলে সে জামানায় এরকম মা পাওয়াও খুব কঠিন ব্যাপার ছিল। কারণ সাধারণত ধর্মীয় ব্যাপারে পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের গোঁড়ামিটা একটু বেশি। এর কারণ হচ্ছে ধর্ম যা সংরক্ষণ করে আসছে এই পর্যন্ত পালন করার ক্ষেত্রে মহিলারাই সবসময় অগ্রগামী। এবং মহিলারা যদি কোনোকিছুকে ‘ধর্ম’ মনে করেন সেখান থেকে তাদেরকে বের করা খুব কঠিন। কারণ তারা যা বিশ্বাস করেন পরিপূর্ণভাবেই বিশ্বাস করতে চান।
বাঙালি ছিল সব সময় অসাম্প্রদায়িক
তো ঐ সময় আসলে এই যে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টি! এটা কেন? আমরা বলি যে, বাঙালি আসলে সবসময় অসাম্প্রদায়িক ছিল। সবসময়! যে কারণে ১৮৫৭ সালে যখন সিপাহী বিপ্লব হলো সেখানে বাঙালি মুসলমান-হিন্দু সব সিপাহী একসাথে লড়াই করেছে ইংরেজের বিরুদ্ধে।
এবং বিপ্লবের পরে তারা দেখল যে, আরে! এ তো দুই ধর্মের লোক একসাথে আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। তাহলে এদের মধ্যে বিভাজনটাকে প্রবল করো।
‘ডিভাইড এন্ড রুল’ ভাগ করে দাও। দুই সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে দাও এবং পরস্পর সংঘর্ষমান করে দাও। যাতে এরা বড় কিছু করতে না পারে।
কিন্তু আসলে বাঙালি সবসময় অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। তা না হলে সেই সময় একপাশে তার বাড়ির পরিচারকের ছেলে, একপাশে একজন জেলের ছেলে। এটা প্রমাণ করে আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, যা হাজার বছর ধরে লালিত হয়ে আসছে এই বাংলায়।
পড়াশোনা ও পেশাগত জীবন জগদীশ চন্দ্র বসু কেমব্রিজে ন্যাচারাল সায়েন্সে বি.এ. করলেন। তারপরে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি। এরপর ফিরে এলেন দেশে। এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন।
এবং তখনকার সময় ইংরেজ শিক্ষকদের বেতন ছিল বাঙালি শিক্ষকদের দ্বিগুণ। একই ক্লাস, একই শিক্ষক। বাঙালি হলে বেতন অর্ধেক। ইংরেজ হলে বেতন ডাবল। অহিংস নীতির প্রয়োগ যে কীভাবে করা যায়, প্রো-একটিভ কীভাবে থাকা যায় জগদীশচন্দ্র বসু হচ্ছেন তার প্রমাণ!
বেতন ছাড়াই তিন বছর
তিনি চাকরি শুরু করলেন স্বাভাবিকভাবে অভাব ছিল অনটন ছিল। কিন্তু বেতন নিলেন না। বলে যে না, বেতন নেব না। কিন্তু নিজের কাজ ঠিকভাবে করে যাচ্ছেন। কাজে কোনো গাফিলতি নেই।
তিন বছর বেতন ছাড়া কাজ করলেন। এবং তিন বছর পরে ইংরেজরা বাধ্য হলো যে, ইংরেজ অধ্যাপকের সমান বেতন তাকে দিতে। এবং শুধু দিল না, তিন বছরের যে বকেয়া বেতন এটাও একসাথে দিল।
প্রো-এ্যাকটিভ হলে কি হয়
আসলে প্রো-একটিভ থাকলে কী হয়! আমরা মনে করি যে চিৎকার দিতে পারলে কী হলো! চিৎকার দিয়ে কোনো লাভ হয় না, কাজ করতে হয়। এবং কাজ করতে হয় আনন্দিতচিত্তে। প্রো-একটিভ!
একজন মানুষ তিন বছর বেতন ছাড়া চাকরি করছে। প্রেসিডেন্সি কলেজ কর্তৃপক্ষের জন্যে তো এটা একটা জুতা মারা। যার ফলে ইংরেজরা বাধ্য হলো তাকে একজন ইংরেজের সমান বেতন দিতে এবং তিন বছরের বকেয়া বেতন একসাথে পরিশোধ করতে।
জীবনে এটা হচ্ছে প্রো-একটিভিটি। প্রো-একটিভিটি মানে চিৎকার না। প্রো-একটিভিটি মানে হচ্ছে প্রতিকার। প্রতিকার কীভাবে করা যায়। উনি রিজাইন করতে পারতেন। কিন্তু এটা কোনো প্রতিকার হতো না। বলে যে না, কাজ করব কিন্তু পয়সা নেব না। যাও! যেদিন আমার ন্যায্য পয়সা তুমি দেবে সেদিন আমি পয়সা নেব।
তো একজন নেটিভের এই অবস্থান নেয়া, এর চেয়ে বড় দুঃসাহস আর কিছু হয় না। এবং বাঙালি বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
ঢুকতে দেয়া হতো না ল্যাবরেটরিতে
এবং জগদীশচন্দ্র বসুকে প্রায়ই ল্যাবরেটরিতে ঢুকতে দেয়া হতো না। বাথরুমের পাশে ২৪ বর্গফুটের একটা পরিত্যক্ত ঘর ছিল। সেটাকে পরিষ্কার করে জগদীশচন্দ্র ওটার মধ্যে ল্যাবরেটরি স্থাপন করলেন। ২৪ বর্গফুট। সেখানে ল্যাবরেটরি করলেন।
এবং গবেষণার জন্যে কলেজ থেকে এক টাকাও না! এমনকি আলাদা কোনো সময়ও না। ক্লাস করে যে অবসর সময় সেই সময়ে তিনি গবেষণা করতেন।
এবং নিজের বেতন থেকে বেতন দিয়ে দেশি মিস্ত্রি একজন নিয়োগ করলেন। যন্ত্রপাতি তৈরি করার কাজে সে সাহায্য করত। বিদেশ থেকে আমদানি করা যন্ত্রপাতি দিয়ে নয়, দেশীয় কাঁচামাল দিয়ে নিজের হাতে তৈরি করেন প্রায় ২০০ যন্ত্রপাতি। ১০০ বছর পরেও এই যন্ত্রপাতিগুলোর অনেকগুলোই যেটা বসু মানমন্দিরে রয়েছে, এটা ইউজেবল। এটা ব্যবহার করা যায়।
নিজের গবেষণার প্রাথমিক পর্বের প্রতিকূল পরিবেশ সম্পর্কে তিনি পরবর্তীতে যা বলেছেন “ভারতবাসীরা কেবলই ভাবপ্রবণ ও স্বপ্নাবিষ্ট, অনুসন্ধান কার্য কোনোদিনই তাহাদের নহে- এই এককথাই চিরদিন শুনিয়া আসিতাম। বিলাতের ন্যায় এদেশে পরীক্ষাগার নাই, সূক্ষ যন্ত্র নির্মাণও এদেশে কোনোদিন হইতে পারে না। তাহাও কতবার শুনিয়াছি।
তখন মনে হইল যে, ব্যক্তি পৌরুষ হারাইয়াছে কেবল সে-ই বৃথা পরিতাপ করে। অবসাদ দূর করিতে হইবে। দুর্বলতা ত্যাগ করিতে হইবে। ভারতই আমাদের কর্মভূমি। সহজ পন্থা আমাদের জন্যে নহে, এই সকল কথা স্মরণ করিয়া একজন তাহার সমগ্র মন সমগ্র প্রাণ ও সাধনা ভবিষ্যতের জন্যে নিবেদন করিয়াছিল।”
পরিশ্রম করতে হবে, ঘাম ঝরাতে হবে
আমরা যে বলি যে রক্ত যখন ঘাম হয়ে ঝরে, তখনই সম্ভব হয় আপাত অসম্ভব। মেহনত করতে হবে। রক্ত ঘাম হয়ে ঝরতে হবে। আপনি ঘামবেন না, ঘামের গন্ধ বেরুবে না গা থেকে, আর আপনি বড় কিছু করবেন, হবে না!
তিনি যথার্থ অর্থেই বাঙালি ছিলেন
দেশীয় কাঁচামাল দিয়ে দেশীয় মিস্ত্রি দিয়ে তিনি যে যন্ত্র তৈরি করলেন সেই যন্ত্র দিয়ে তিনি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভের ওপরে গবেষণা করলেন।
পাশ্চাত্যের বড় বিজ্ঞানীরা যেখানে ৬০ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের রেডিও নিয়ে কাজ করতে পারছিলেন না, সেখানে জগদীশচন্দ্র প্রথম পাঁচ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের রেডিও তরঙ্গ সংকেত বিনিময়ের প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন।
এবং গবেষণালব্ধ ফলাফল পাঠিয়ে দিলেন, আন্তর্জাতিক জার্নালে। এবং এরপরে আমন্ত্রণ এলো ইউরোপ থেকে। ১৮৯৬ থেকে ওনার বক্তৃতা শুরু হলো ব্রিটিশ এসোসিয়েশনে বৈজ্ঞানিক সম্মেলন রয়েল ইনস্টিটিউট ইম্পেরিয়াল ইনস্টিটিউট পুরো ইউরোপে জার্মানি ফ্রান্স সব জায়গায়।
এটা আসলে একটা দৃশ্য! স্বামী বিবেকানন্দের পরে আমেরিকা এবং ইউরোপ ভ্রমণে কোনো বাঙালি বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং ইউরোপিয়ান বিজ্ঞানীরা গবেষকরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছেন! এখনকার অবস্থায় এটা কিন্তু চিন্তা করতে পারবেন না। যে এখন থেকে একশ বছর আগে ইউরোপে কী অবস্থা ছিল?
কেন? কারণ তিনি যা আবিষ্কার করেছিলেন সে আবিষ্কারের বাস্তব প্রয়োগ করতে হয়েছে আরো ৭০ বছর পরে। অর্থাৎ তিনি তার সময়ের ১০০ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
এবং তিনি যথার্থ অর্থেই বাঙালি ছিলেন। ‘বাঙালি’ মানে হচ্ছে পরোপকারী সমমর্মী দরদী। বাঙালি মানে অর্থলিপ্সু নয়। বেতার তরঙ্গ যেটা তিনি আবিষ্কার করলেন তাকে বলা হয়েছিল যে, আপনি প্যাটেন্ট করেন।
অর্থের মোহ তার একেবারেই ছিলনা
পরবর্তী সময় উনি খুব পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে কেন প্যাটেন্ট করলাম না ১৯০১ সালে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠিতে যে আমি যদি একবার টাকার মোহে পড়ে যাই, তাহলে আর কোনোদিন এখান থেকে বের হতে পারব না।
তার আবিষ্কার, তিনি যে যন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন সে যন্ত্র ইটালিয়ান বৈজ্ঞানিক মার্কনি প্যাটেন্ট করে হয়ে গেলেন বেতার যন্ত্রের আবিষ্কারক।
কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসু রেডিও সিগনাল শনাক্তকরণের সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার বিষয়ক তার যে গবেষণা সে গবেষণা উন্মুক্ত করে দেন সকল বিজ্ঞানীর জন্যে যাতে তারা আরো ফারদার গবেষণা করতে পারে।
এবং জগদীশচন্দ্র বসুর সময়েই বায়োফিজিক্স বা জীব পদার্থবিজ্ঞান শুরু হয়।
এখন তো বায়োফিজিক্স খুব ক্রমবর্ধমান একটা বিজ্ঞান। কিন্তু যখন জগদীশচন্দ্র বসু এ নিয়ে গবেষণা করেন তখন এই বিষয়ে আসলে কারোও তেমন ধারণা ছিল না। অর্থাৎ একজন বিজ্ঞানী ও জ্ঞান অনুসন্ধানী যখন অর্থের মোহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন তিনি যুগ সৃষ্টি করেন।
এই যে গাছের প্রাণ আছে এটা আবিষ্কার করলেন কে? জগদীশচন্দ্র বসু। বলা যেতে পারে, গাছের প্রাণ আছে এখান থেকেই বায়োফিজিক্সের শুরু। এবং ‘বায়োফিজিক্সের জনক’ বলা যেতে পারে তাকে।
গাছেরও প্রাণ আছে তিনিই প্রথম আবিস্কার করেন
এবং উদ্ভিদও যে আনন্দ-ব্যথা অনুভব করে এমনকি আদর অনুভব করতে পারে, মমতা অনুভব করতে পারে এটা বসু প্রথম আবিষ্কার করেন।
তিনি প্রমাণ করেন যে, গাছেরও শীত লাগে, গরমে সে-ও কাবু হয়। আলো, শব্দ যে-কোনো দূষণ দ্বারা সে.. আলো থেকে তো আমরা জানি যে সংশ্লেষণ পদ্ধতিতে সে খাবার তৈরি করে। কিন্তু শব্দ দ্বারাও যে তার দূষণ হয়, মানে হচ্ছে খারাপ শব্দে দূষণ হবে এবং সংগীত তাকে আনন্দ দেবে। এই সমস্ত বাহ্যিক উদ্দীপনায় গাছও সাড়া দিতে পারে, বসু এটাকে আবিষ্কার করেন।
ফিরিয়ে দিলেন ইউরোপে যাবার প্রস্তাব
জগদীশচন্দ্র বসু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে লেখা আরেকটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমি যে কাজ আরম্ভ করিয়াছি, তাহার জন্যে অসীম পরিশ্রম ও বহু অনুকূল অবস্থার প্রয়োজন। অন্যদিকে আমার সমস্ত মনপ্রাণ দুঃখিনী মাতৃভূমির আকর্ষণ ছেদন করিতে পারে না। আমার সমস্ত ইন্সপিরেশনের মূলে আমার স্বদেশীয় লোকের স্নেহ। সেই স্নেহবন্ধন ছিন্ন হইলে আমার আর কী রহিল! আমার হৃদয়ের মূল ভারতবর্ষে। যদি সেখানে থাকিয়া কিছু করিতে পারি, তাহা হইলেই জীবন ধন্য হইবে।’
কারণ তিনি যখন এত সব আবিষ্কার করছেন, তখন ইউরোপের গবেষণাগারগুলো তাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্যে উঠে-পড়ে লাগল। অনেক সুযোগসুবিধা এই সেই। কিন্তু বসু সেটাকে প্রত্যাখ্যান করলেন।
১৯৭৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানী স্যার নেভিল ফ্যান্সিস মট সলিড-স্টেট ইলেক্ট্রনিক্সে অবদানের জন্যে নোবেল পুরস্কার পান। তার গবেষণার পেছনে জগদীশচন্দ্র বসুর যে গবেষণা এটার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। যে কারণে নেভিল মট ১৯৭৭ সালে বলেন, আসলে জেসি বোস তার নিজের সময় থেকে এগিয়ে ছিলেন ৬০ বছরের বেশি।
তিনি বলেন যে, দ্য মিলিমিটার ওয়েভ দ্যাট জেসি বোস ওয়ার্কড অন ইজ দ্য ব্যাকবোন অব ডেভেলপিং ফাইভ জি। ইন ফ্যাক্ট হিজ ওয়ার্ক অন রেডিও এন্ড ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন এফেক্টিভলি মেক হিম ‘দি ফাদার অব মডার্ন ওয়াইফাই’।
তো এখনকার বিশ্বে যে রাডার থেকে শুরু করে টেলিভিশন মহাকাশ যোগাযোগ এই ক্ষেত্রে বসু যে ক্ষুদ্রতরঙ্গ যেটা ওয়াইফাইতে ব্যবহার হয়, এটা মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।
আসলে তার ইনট্যুশন
আসলে একজন ভালো মানুষ যদি হন কেউ, দেশপ্রেমিক মানুষ যদি হন, মানুষপ্রেমিক মানুষ যদি হন, তার ভেতরে প্রজ্ঞা এবং ইনটুইশন খুব চমৎকার কাজ করে।
এবং সূর্য থেকে যে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন হয় এটা তিনি প্রথম বলেন। এবং যেটা ১৯৪৪ সালে পরবর্তী গবেষণায় বিজ্ঞানীরা কনফার্ম করেন যে, সূর্য থেকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন হয়।
‘ফাদার অব রেডিও সায়েন্স’
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে ১৯১৪ সালে। এক্স-রে প্রয়োগ করে পদার্থবিজ্ঞানে মেরিকুরি স্বীকৃতি পেলেন আহত সৈনিকদের চিকিৎসা করে।
আর কলকাতায় জগদীশচন্দ্র বসু এক্স-রে দিয়ে রোগীর শরীরের ছবি তুলতে শুরু করেছিলেন ১৮৯৯ সালে। মেরিকুরির ১৫ বছর আগে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার বন্ধু ছিলেন। তাকে লেখা সেই ১৮৯৯ সালের চিঠিতে তিনি এই কথাগুলো লেখেন
জগদীশচন্দ্র বসু তার গবেষণার কোনো প্যাটেন্ট গ্রহণ করেন নাই এজন্যে যে, টাকার পেছনে মন চলে গেলে আর গবেষণা করতে পারবেন না, বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করতে পারবেন না, সাধনা করতে পারবেন না।
কিন্তু ২০১২ সালে ইনস্টিটিউট অব ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার্স, যেটা টেকনিক্যাল প্রফেশনালদের বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। তারা ১৮৯৫ সালে জগদীশচন্দ্র বসু শর্টওয়েভ কমিউনিকেশন এই যে ওয়াইফাই কমিউনিকেশন নিয়ে যে গবেষণা করেছেন সেই গবেষণাকে বলেছেন যে, এটা একটা মাইলস্টোন আবিষ্কার। যা পরবর্তী ১২০ বছর পর্যন্ত এর প্রভাব অব্যাহত থেকেছে। এই ইনস্টিটিউট তার এসেসমেন্টে বলেন, হি জেনারেটেড ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ বিফোর ইন্সট্রুমেন্টস ইভেন ইভলভড টু মেজার দ্য ফ্রিকোয়েন্সিস দ্যাট লো।
ইনস্টিটিউট অব ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার্স জগদীশচন্দ্র বসুকে ২০১২ সালে ‘ফাদার অব রেডিও সায়েন্স’ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এবং এই স্বীকৃতির কারণ হিসেবে তারা বলেন মার্কনির আবিষ্কৃত রেডিওতে তারহীন সংকেত পাঠানোর মূল যন্ত্রের আবিষ্কারক ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। জগদীশচন্দ্র বসু একমাত্র বাঙালি, যার নামকরণে চাঁদের একটি আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের নামকরণ করা হয়েছে।
আসলে তিনি প্যাটেন্টের পেছনে যান নাই। কারণ তিনি অর্থের পেছনে ছোটাটাকে কখনো বিজ্ঞানীসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি মনে করেন নাই।
অহিংসা ভালোবাসতেন তিনি
তিনি ৭৮ বছর বেঁচে ছিলেন। ১৯৩৭ সালে ২৩ নভেম্বর তিনি মারা যান। এবং তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর ময়মনসিংহে। তখন সিপাহী বিপ্লব তখন চলছিল।
আমরা ওয়াইফাইয়ের জনক বেতার বিজ্ঞানের জনক জগদীশচন্দ্র বসুর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। এবং তার এই যে অহিংস আন্দোলন, অন্যায়ের যে প্রতিবাদ। আসলে গীতার শিক্ষা থেকে বোঝা যায় যে, অন্যায়কারীরা যদি দক্ষ মানুষ ভালো মানুষের নেপথ্য সমর্থন না পায় নীরব সমর্থন না পায়, সে অন্যায় টিকে থাকতে পারে না।
তো তিনি নীরব প্রতিবাদ করেছেন, অহিংস প্রতিবাদ করেছেন, যে অহিংসার শিক্ষা রসুলুল্লাহ (স) দিয়ে গেছেন সেই অহিংসার শিক্ষা তিনি তার জীবনে সবসময় প্রয়োগ করেছেন। সেই অহিংস নীতি, সেই প্রো-একটিভ এবং নিজের কাজ করে যাওয়া।
আমরা হলে কী করতাম? রি-এ্যাকটিভ হতাম। বেতন অর্ধেক দিচ্ছে? কাজই করব না অথবা অর্ধেক কাজ করব।
কিন্তু না, পুরো কাজ করেছেন তিনি। বেতন নেব না যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি আমার আসল বেতন ঠিক না করছ, না দিচ্ছ। কাজও ছাড়ব না, নেবও না।
এই হল অহিংসা এটাই প্রো-একটিভ। এজন্য নিজের কাজে সবসময় অন্যে কে কী বলল তাতে প্রলুব্ধ হবেন না কখনো। যে প্রলুব্ধ হয় নাই সে-ই ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকে। তখন ইউরোপিয়ানরা ছিল প্রভু। তারা মার্কনিকে প্রচার করেছেন। কিন্তু ইতিহাস খুব নির্মম।
ইতিহাস তাকে মাথা নুইয়ে স্বীকৃতি দেয়
ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসি স্বাধীনতা সংগ্রামী, জোয়ান অব আর্ককে চার্চের নির্দেশে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। কী বলে? ডাইনি বলে। কারণ তখন মেয়েদেরকে অপবাদ দিয়ে মারার সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল ডাইনি।
সেই চার্চ ৬০০ বছর পরে তাকে সেইন্ট হিসেবে বরণ করল। কারণ সত্যের কখনো মৃত্যু হয় না। যাকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল সেই রোমান চার্চই আবার ৬০০ বছর পরে তাকে ‘সেইন্ট’ হিসেবে বরণ করল।
তো আসলে কেউ যদি সত্যের জন্যে কাজ করেন, তার সময় তাকে স্বীকৃতি না দিলেও ইতিহাস তাকে মাথা নুইয়ে স্বীকৃতি দেয়। কারণ সত্যের শক্তি হচ্ছে এত বড় এত প্রবল এত সর্বপ্লাবী।

শেয়ার করুন

এই শাখার আরো সংবাদ পড়ুন
All Rights Reserved © rmgbdnews24.com