সাধারণ মানুষের অবস্থাটা কী? এটা নিয়ে চীনাদের একটা খুব চমৎকার প্রবাদ আছে। এই প্রবাদে মানুষকে চারটা স্তরে ভাগ করা হয়েছে।
১. এক হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
সাধারণ মানুষ কী করে? লোকজন নিয়ে কথা বলে।
আপনি দেখবেন যে, খুব সাধারণ মানুষ, অর্থাৎ যাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা খুব সাধারণ, তারা সবসময় অন্যের ব্যাপারে কথা বলে। অমুক তমুক ইন্ডিভিজুয়াল, ব্যক্তি নিয়ে কথা বলে তারা। ব্যক্তির নিন্দা, ব্যক্তির প্রশংসা।
২. একটু যারা পরিশীলিত হয়েছে, একটু শিক্ষিত হয়েছে, একটু পড়াশোনা জানেন, তারা ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেন।
ওখানে কী ঘটল, সেখানে কী ঘটল, অমুকে কী করল, সিরিয়ায় কী হলো, ভারতে কী হলো, আমেরিকাতে কী হলো, পাকিস্তানে কী হলো- এগুলো নিয়ে তারা আলোচনা করেন।
৩. যারা আরেকটু শিক্ষিত, আরেকটু পড়াশোনা করেছেন, তারা ধ্যানধারণা নিয়ে আলোচনা করেন। আইডিয়াজ নিয়ে আলোচনা করেন।
৪. আর যারা আলোকিত এনলাইটেন্ড। তারা হীরন্ময় মৌনতার মধ্যে ডুবে যান। তারা মৌনতায় ডুব দেন।
এখনকার সাধারণ মানুষের অবস্থা
আমরা যদি সাধারণ মানুষের অবস্থা আরো ডিটেলস দেখি, আসলে তারা সবসময় অর্থহীন সমালোচনায় মত্ত থাকেন। অন্যের ঘরে কী রান্না হলো? কে কী পোশাক পরল? কী খাওয়াল? আজকাল তো আবার নতুন ফ্যাশন চালু হয়েছে যে, কী স্ট্যাটাস দেয়া হলো?
স্ট্যাটাস কী? একজন ঠ্যাং উঁচু করে ছবি তুলল- এটা হচ্ছে স্ট্যাটাস।
কোথায় খেলাম সেটার ছবি তুলে স্ট্যাটাস। অনেক সময় না খেয়ে দোকানের সামনে ছবি তুলে স্ট্যাটাস!
কী কিনলাম এটা হচ্ছে স্ট্যাটাস। কিনে কত জিতলাম এটা হচ্ছে স্ট্যাটাস। এবং কে কত সস্তায় কিনেছে এটা বলতে পারাটা হচ্ছে স্ট্যাটাস। আবার কে কত দাম দিয়ে কিনেছে- এটা বলতে পারাটাও স্ট্যাটাস।
দুমাস আগেই ঈদের কেনাকাটা
এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে যেটা হয় যে, সব মহিলাই যখন শাড়ি কেনেন তারা মনে করেন তারা জিতেছেন। দোকানদার একেবারে কসম কেটে, দিব্যি কেটে বলে যে আপা, এক টাকাও লাভ করি নাই!
ভদ্রমহিলা ওটাই বিশ্বাস করছেন যে লাভ করে নাই। ব্যাপার হয়েছে যে, আমাদের দেশে শাড়ির দোকানে একমাসে ১১ মাসের লাভ করে তারা। তারা ব্যবসা করে একমাস, ঈদের আগে।
তো এইজন্যে কী করবেন? ঈদ আসার দুই মাস আগে কেনাকাটা করে ফেলবেন। আপনি জিতবেন।
বলবেন, ঈদের সময় যেটা বাজারে আসে সেটা তো ‘লেটেস্ট’, একদম বোগাস! অনেক সময় পুরনো জিনিসও এনে দোকানিরা বলে লেটেস্ট। আপা এই দুদিন আগে আসছে। ঠিকই তো সে যেখান থেকে এনেছে দুদিন আগেই এনেছে!
সবসময় ঈদের বাজার করবেন মিনিমাম শবে বরাতের আগে।
এবং সবচেয়ে ভালো হচ্ছে চৈত্র মাসের শেষ দিকে। দোকানদারদের আবার নিয়ম হচ্ছে যে, বৈশাখে পাইকার বা মহাজনের আগের পাওনা সব শোধ করতে হয়। ঐসময় তারা কী করে? কত কমে বেচে টাকাটা উঠানো যায়। কারণ টাকা দিতে না পারলে তার জন্যে খুব বিপদ। অতএব চৈত্র মাসের শেষ দুই সপ্তাহ হচ্ছে বাজার করার জন্যে সবচেয়ে ভালো সময়।
দোকানদারের কথা শুনে মোহিত হবেন না!
আর যেটা হচ্ছে যে, দোকানদারের কথা শুনে মোহিত হবেন না।
আমি দেখেছি তিন প্রজন্ম একসাথে। নাতি, মা, নানি। একই দোকানদার অবলীলায় তিনজনকেই ‘আপা’ বলছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, এই যে তিনজনকে আপা বললেন, আপনি তো জানেন যে এরা নাতি, মা এবং মেয়ে।
বলে যে দেখেন স্যার, যদি আপা না বলি ঐ নাতির নানিও আমার কাছ থেকে জিনিস কিনবে না। আমি বললাম যে কীভাবে? বলে যে, একবার একজন মহিলাকে দেখে খুব সম্মান করে খালাম্মা বলেছিলাম। কিন্তু কিনে নাই।
তো এরপরে যখন আবার এলেন, ‘আপা’ বলেছি। আমি খেয়াল করলাম আপা বলার পরে তিনি খুব খুশি। কারণ খালাম্মা বললে তো বয়স একটু বেশি মনে হয়। আমি জানি না আপনাদের এই অভিজ্ঞতা আছে কিনা।
এবং প্রত্যেকে যারা কেনাকাটা করতে যায়, কেনাকাটা শেষে তারা ধরেই নেয় তারা জিতেছে। তাহলে হারে কে? দোকানদার?
দোকানদার হারলে সে দোকান চালায় কীভাবে সারা বছরব্যাপী?
সবসময় মনে রাখবেন একজন কোন উদ্দেশ্যে কসম কাটছে এটা আপনাকে বুঝতে হবে। অযৌক্তিক কথায় কখনো বিশ্বাস করবেন না।
দোকানদার লাভ করবে না তো সে কী জন্যে বসে আছে দোকানে? সে-তো লাভ করার জন্যে বসে আছে। এবং সবসময় মনে রাখবেন যে, শাড়ি অথবা এই জাতীয় জিনিসে সে মিনিমাম হান্ড্রেড পার্সেন্ট লাভ করে! মিনিমাম লাভ।
যদি বলে যে, এক পয়সাও লাভ করি নাই আপা, আজকে ঠকবো, তবুও দেখবেন যে, একশ পার্সেন্ট লাভ।
মূল্য হ্রাস আসলে ফাটা বাঁশ!
আর মূল্য হ্রাস তো বলেছি যে, ফাটা বাঁশ। মূল্য হ্রাসে কখনো যাবেন না। কারণ আপনি কখনো কিনে জিততে পারবেন না। আপনার সবসময় ধরে রাখতে হবে যে, ইউ আর লুজিং। যখনই কিনবেন ভাববেন আপনি লস করছেন।
কারণ সে যা প্রফিট করছে সেটা তো এটার মূল্য না, সেটা তো তার প্রফিট, অতএব আপনি তো লুজ করছেন। দামের অতিরিক্ত দিচ্ছেন বলেই তো সে লাভ করছে। অতএব অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনবেন না।
যে-কোনো জিনিস কেনার আগে কয়টা পয়েন্ট জিজ্ঞেস করবেন নিজেকে?
তিনটা। যে এটা আমার প্রয়োজন কিনা, এখনই কেনা প্রয়োজন কিনা, এবং এটা ছাড়া আমার চলতে পারি কিনা।
মৌন থাকুন আলোকিত হবেন
আসলে সাধারণ মানুষ কেনাকাটা নিয়ে, মানুষজন নিয়ে, এটা নিয়ে সেটা নিয়ে আলোচনা করে। আর আরেকটু যারা শিক্ষিত তারা ঘটনা নিয়ে আলোচনা করে। আরেকটু যারা শিক্ষিত তারা ধ্যানধারণা নিয়ে আলোচনা করে। আর যারা আলোকিত তারা মৌন থাকেন।
তো আপনি যত মৌন থাকতে পারবেন তত বোঝা যাবে যে, আপনি আলোকিত হচ্ছেন।
[প্রজ্ঞা জালালি, ০৭ আগস্ট, ২০১৯]