ছোটবেলায় আমার দাদা আমাকে বলেছিলেন এমবিবিএস ডাক্তার হয়ে এ অঞ্চলের মানুষের চিকিৎসা করতে। দাদা মারা যাওয়ার প্রায় ১২ বছর পূরণ হয়েছে। সে-সময় মনে হতো দাদার স্বপ্ন কি আমি পূরণ করতে পারব?
আমি ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস ফোর পর্যন্ত বাড়ির বাইরে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছিলাম। পঞ্চম শ্রেণিতে আলীকদম আর্দশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়েছিলাম আলীকদম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে।
স্কুলটিতে সুযোগ-সুবিধা তেমন ছিল না। সম্পূর্ণ নিজ খরচে পড়তাম সেখানে। বাবা মাসে মাসে টাকা দিয়ে আসতেন।
বাবা গাছ কাটার মিলে কাজ করতেন। আয় হতো নামমাত্র। আমরা তিন ভাইবোন। আমি, আমার বড় বোন এবং ছোট ভাই। দেখা যেত দিন শেষে বাবার আয়ের চেয়ে খরচের পাল্লাই বেশি ভারি। এসব কারণে আমার কোয়ান্টামে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে আরো তীব্র হলো। বাবাও আমাকে কোয়ান্টামে ভর্তি করানোর অনেক চেষ্টা করলেন।
এলাকার বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম কোয়ান্টামে ভর্তি পরীক্ষা দিব। সবাই মিলে এলাম। মনে হয়েছিল বন্ধুরা মিলে বনভোজনে এসেছি। পরীক্ষা বলতে যা হলো তা কিছু খেলা। বাড়ি ফেরার পথে সবাই মিলে আলোচনা করছিলাম যে এটা কোন ধরনের পরীক্ষা! এগুলো যে ফিটনেস টেস্ট তা তখন বুঝি নি। চান্সও পেয়ে গেলাম। ভর্তি হলাম।
কোয়ান্টামে গিয়ে সর্বপ্রথম অবাক হলাম শিক্ষকদের দেখে। ছোটবেলায় বিভিন্ন মুভিতে দেখতাম স্কুলে অনেক নামি শিক্ষক, কোয়ান্টামে এসে দেখলাম শিক্ষকেরা সে ধরনের সম্মানধারী। স্যারদেরকে দেখে খুব ভালো লেগেছে আমার। এত আন্তরিকতা, এত মমতা! সহজে পড়ালেখায় মনোযোগ আসে। যে-কোনো বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে স্যারেরা প্রথমে পাশে এসে বসেন তারপর সুন্দর করে উত্তর বুঝিয়ে দেন। সবসময় লক্ষ্য ঠিক রাখতে বলেন। আরো বলেন, কখনো হাল ছেড়ে দেবে না।
কিন্তু নবম শ্রেণিতে উঠে আমি আমার লক্ষ্য থেকে আলাদা হয়ে যাই। আমার লেখাপড়া খারাপ হওয়া শুরু করে। এরপর আমি কোয়ান্টাম মেথড কোর্স করলাম। মেডিটেশন চর্চার মাধ্যমে মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতা বাড়ালাম। আমরা কয়েকজন বন্ধু একসাথে পড়া শুরু করলাম। নিজেরা নিজেদের সহযোগিতা করতাম। এভাবে এগোতে এগোতে একটা বিশ্বাস চলে এলো—আমিও পারব।
আমি এসএসসি পরীক্ষায় ৪.৯১ এবং এইচএসসি-তে ৪.৫২ পেলাম। অনেক ভয় লাগছিল। ভেবেছিলাম এই জিপিএ নিয়ে হাজারো ভালো শিক্ষার্থীর সাথে লড়াই করে আমার পেরে উঠতে অনেক কষ্ট হবে। কিন্তু লক্ষ্য ছিল দৃঢ়। যত বাধাই আসুক আমি তা চুরমার করে লক্ষ্যে পৌঁছাবই। এই প্রত্যয় নিয়ে আবারো মাঠে নামলাম।
এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথে কোয়ান্টাম থেকে আমাদের অ্যাডমিশনের প্রস্তুতির জন্যে সুযোগ দেয়া হলো। পড়ালেখা চলল স্রোতের বেগে। অন্য সকল চিন্তা বাদ দিয়ে শুধু পড়ালেখা। মাঝে মেডিটেশন, খাবার আর কিছু লেকচার ক্লাস। এসময় আমরা পেয়েছিলাম স্যারদের ভালবাসা আর শাসন। তারা দিনরাত এক করে আমাদের যত্ন নিয়েছেন। আমাদের সাথেই খাবার খেতেন। ঘুমাতেন আমাদের সাথে। ঢালের মতো আমাদের আগলে রেখেছিলেন। তিন মাস কেটে গেল, এবার সেই অন্তিম লগ্ন। আমরা পরীক্ষা দিলাম।
আমি নিয়েছি মেডিকেল ভর্তি প্রস্তুতি। ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। মনে শান্তি পেলাম না। কোথায় যেন একটু ভয় থেকে গেল। ডেন্টাল কলেজেও পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট বের হলো। সিলেট মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটে চান্স পেলাম। কিন্তু আমার মন পড়ে থাকল মেডিকেলে। কিছুদিন পর মেডিকেলের রেজাল্ট দিল। আমি থাকলাম ওয়েটিং লিস্টে। হতাশ হয়ে গেলাম। কোনোকিছু করেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। কলেজ থেকে আমাকে সিলেটে পাঠানো হলো ডেন্টালে ভর্তি হওয়ার জন্যে। তবু থেমে থেমে কান্না আসতে লাগল।
মন খারাপের সময় একটি সংবাদ শুনে চমকে উঠলাম। স্যার এসে জানালেন আমি মেডিকেলে চান্স পেয়েছি। দেহে যেন প্রাণ ফিরে এলো। কোনো কথাই বলতে পারলাম না কিছুক্ষণ। হঠাৎ এক বন্ধুর ধাক্কায় আমি স্বাভাবিক হই। সাথে সাথে বাড়িতে ফোন দিলাম। দাদার রেখে যাওয়া স্বপ্ন আজ সত্যি হতে চলেছে। দাদার প্রার্থনা এবং এই স্কুলের সহযোগিতা না থাকলে হয়তো আমি এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না।
আমাকে আমার পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। পাশাপাশি আমার এলাকার মানুষদের চিকিৎসার মাধ্যমে সেবা করতে চাই। কোয়ান্টামে থাকা অবস্থায় আমার একবার পা ভেঙে গিয়েছিল। আমি তিন মাস শাফিয়ানে ভর্তি ছিলাম। তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যেদিন ডাক্তার হতে পারব সেদিন এখানে এসে অন্তত একদিনের জন্যে হলেও সেবা দিব। স্রষ্টা যদি আমাকে ভালো ডাক্তার হওয়ার সুযোগ দেন, তাহলে আমি অবশ্যই মানবসেবায় নিজের মেধাকে কাজে লাগাতে চাই।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]