পুরো পরিবার বাবার আয়ের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বর্ষা এলেই বাবার কাজ বন্ধ। যখন ঝড় হতো, চালের টিন উড়ে যেত, ঘরের জিনিসগুলো স্তুপ করে পলিথিনে ঢেকে রাখতাম।
আর বর্ষা ছিল স্কুল ফাঁকি দেয়ার উপযুক্ত সময়। যেদিন স্কুলে যেতে মন চাইত না, সেদিন বাসা থেকে বের হয়ে কিছুদূর গিয়ে ইচ্ছে করে পা পিছলে পড়ে যেতাম। সবাই বিশ্বাসও করত। কারণ যেখানে বড়রাই পিছলে পড়ে গায়ে কাদা মেখে বাড়িতে আসে, আমরা তো ছোট। বেশি বৃষ্টির সময় মা নিজেই যেতে দিতেন না।
একসময় মা রেশম চাষ শুরু করলেন। রেশম পোকা যে গাছের পাতা খায় সে পাতার নাম তুঁত পাতা। পোকার জন্যে পাতা খুঁজতে খুঁজতে অনেক কম সময়ে লামার একটা অংশ আমার পরিচিত হয়ে যায়। আমাদের পাহাড়ের উপরে যে তুঁত গাছ ছিল তা দিয়ে পোকা পালন করা কঠিন। আরো পাতার খোঁজে আমরা বিভিন্ন স্থানে যেতাম। অনেক সময় গাছের মালিকরা গরুকে খাওয়াবে বলে পাতা দিতে চাইত না। কাজ না থাকলে বাবাও আমাদের সাথে যেতেন পাতা খুঁজতে। অনেক সময় দুপুরে বের হতাম, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হতো। তখন আর পড়াশোনা হতো না। ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে যেতাম। জনমানবহীন এমন লোকালয়ে রাত ৮টা-৯টা মানে গভীর রাত। বিদ্যুৎ না থাকায় আলোর একমাত্র উৎস কেরোসিন তেলের কুপি বাতি।
আমার বড় ভাই যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে তখন এক দুর্ঘটনায় সে মাথায় আঘাত পায়। কিছুদিন ওষুধ খেয়ে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু আঘাতের প্রভাবটা প্রকাশ পায় ছয় মাস পর। একদিন গভীর রাতে প্রচণ্ড খিঁচুনি হতে থাকে। আমরা কেউ এমন পরিস্থিতির সাথে পরিচিত না। সবাই ভৌতিক কিছু ভেবে ঝাড়-ফুঁক দেয়ার জন্যে হুজুরের কাছে নিয়ে যেতে বলল। তাতেও কাজ না হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার বলেন এটা মৃগী রোগ। টাকাপয়সা জোগাড় করে শুরু হয় এক ডাক্তার থেকে অন্য ডাক্তারের সাথে সাক্ষাৎ।
এই পরিস্থিতিতে আমার ছোট ভাই মনসুরকে কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে শিশুশ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। এরপর আমি একটু দূরে নানা বাড়িতে চলে যাই। সেখানে মামার কাছে বড় হতে থাকি। বছর তিনেক নানা বাড়িতে পড়াশোনা করি। আমার প্রাইমারি স্কুল যেখানে ছিল সেটা অনেক দূরে। প্রতিদিন সকালে স্কুলে যেতাম আর দুপুরে টিফিনের পর চলে আসতাম। মজার বিষয় হলো যেদিন আমি আমার প্রাইমারি স্কুলের সার্টিফিকেট নিতে গেলাম, সেদিন দেখি স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক আমাকে চিনতে পারছেন না। কারণ আমি কখনো তার ক্লাস করি নি। যেহেতু টিফিনের সময় আমি বাড়ি চলে আসতাম, আর টিফিনের পরেই ছিল স্যারের ক্লাস।
২০১৪ সালে জানুয়ারি মাসে আমার ছোট ভাইকে কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে দেখতে গেলাম। সেখানে খবর পাই ষষ্ঠ শ্রেণিতে নতুন ছাত্র ভর্তি নেয়া হবে। বুঝতে পারলাম আমারও এখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ আছে। তখনই একটা ফরম পূরণ করে ফেলি। কিছুদিন পর আমি এক নবীন শিক্ষার্থী হিসেবে সেখানে ভর্তি হই। আমি এখনো মনে করি, আমার জীবনে সঠিক সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে একটি হলো স্বেচ্ছায় এই স্কুলে ভর্তি হওয়া।
আমি এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে আমার ছোট ভাই এখানে আসে। মাঝে মাঝে ছোট ভাইকে দেখার জন্যে কোয়ান্টামে আসতাম। কিন্তু ভাবতেও পারি নি আমি একসময় এখানে পড়াশোনা করব। আমার নামের সামনে কোয়ান্টা শব্দটা থাকবে। আটটি বছর কেটে যাবে এই স্কুলে।
এখানকার নিয়মকানুন আমার একদম ভালো লাগত না। সকালে ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হতো। সকালে যে ঘুম থেকে ডাকতে আসত, তাকে মনে হতো জগতের সবচেয়ে খারাপ মানুষ। পরিবারের কথা খুবই মনে পড়ত। প্রথমে খারাপ লাগলেও পরে বুঝতে পেরেছি কোয়ান্টাম আমার আরেকটা পরিবার। শিক্ষকেরা ছিলেন মা-বাবার মতো। আর সবচেয়ে ভালোলাগার বিষয় হলো গুরুজী দাদুর কথাগুলো।
গুরুজী দাদু ২০১৬ সালে জেএসসি পরীক্ষার আগে মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন—‘ইনশাআল্লাহ ভালো হবে’। আল্লাহর রহমতে জেএসসি পরীক্ষাসহ সব বোর্ড পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয়েছে। কোয়ান্টামে এসে অনেক নতুন শব্দ জেনেছি—মেডিটেশন, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, বুয়েট আরো কত কী? পরে বুঝলাম যদি ডাক্তার হতে চাই তাহলে মেডিকেল কলেজে পড়তে হবে। ইঞ্জিনিয়ার হতে হলে বুয়েটে পড়তে হবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় তো আছেই। কলেজের পড়াশোনা শেষে এগুলোতে ভর্তি হতে হয়। যদিও তখন ভালো প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার সুযোগ স্বপ্নের মতো ছিল।
এখানে এসে আমি কিছু সৃজনশীল কাজের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাই। ব্যান্ড দলের সদস্য হিসেবে আমি ড্রাম বাজাতাম। ড্রাম বাজিয়ে ২০১৫-২০১৯ সাল পর্যন্ত পর পর টানা পাঁচ বার ঢাকায় জাতীয় শিশু-কিশোর সমাবেশে অংশ নিয়েছি। পাঁচ বারেই সকলকে পেছনে ফেলে প্রথম হয় কোয়ান্টাম কসমো স্কুল। এছাড়া ভলিবল খেলাও আমার খুবই ভালো লাগত।
ছোটবেলায় যে স্বপ্ন দেখেছি, ২০২২ সালে এসে তা পূরণের সুযোগ আসে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল হলো। গণিত বিভাগে ভর্তি হলাম। এখন পড়াশোনার পাশাপাশি কোয়ান্টামের বিভিন্ন সেবামূলক কাজে নিয়মিত কাজ করছি।
কোয়ান্টামে ‘মনছবি’ নামে একটা শব্দের সন্ধান পাই। নিজের বিবেকের কাছে সৎ থাকতে পেরে আমি শান্তি পাই। আমার কাছে আমার পরিবারের চাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কোনো আবদার পূরণ করতে পারলে আমার অনেক ভালো লাগে। খুব ইচ্ছা বাংলাদেশ যখন সেরা দশ জাতির একটি জাতি হবে, তখন যেন আমি এই সাফল্যের একটি অংশ হতে পারি।
জীবন বদলের চাবিকাঠি অটোসাজেশন বই আমার প্রিয় বই। সর্বশেষ অটোসাজেশনটি হলো—
‘জীবনে আমি হবো লাখো মানুষের ভরসাস্থল।
মরণেও তারা হৃদয়ের অশ্রম্নতে শেষ বিদায় জানাবে আমাকে।
তারপরও প্রজন্মের পর প্রজন্মের হৃদয়ে বেঁচে থাকব আমি
তাদের আনন্দ বেদনায় সংকটে সম্ভাবনায়
প্রেরণার উৎসরূপে।’
আল্লাহর কাছে এই জীবনে আমি তো এটাই চাই!
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]