আসলে কোয়ান্টামমের মাটি আমার নিজের মাটি। এটাই আমার শিকড়। এখানকার প্রকৃতি আমার খুবই আপন। এখান থেকেই আমার পড়ালেখাসহ জীবন শিক্ষার হাতেখড়ি। ২০০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আমি বাবার সাথে আসি। সূচনা শ্রেণিতে কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে ভর্তি হই। তারপর ১৫ বছর এখানেই অতিবাহিত করি। এখানকার আলো বাতাসের মাঝেই আমি একটু একটু করে বড় হয়েছি।
মা-বাবা সন্তানকে যেমন হাঁটতে শেখায়, কথা বলতে শেখায় এবং সকল প্রতিকূল অবস্থায় নিজের কথা না ভেবে সন্তানের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করেন, তেমনি আমার কাছে কোয়ান্টাম মা-বাবার মতোই উৎসর্গকারী এক অভিভাবক। কোয়ান্টামের স্বেচ্ছাসেবকদের নিঃস্বার্থ শ্রমের ফসল আমি। এভাবে আমি এইচএসসি পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছি। আর এখন আমি চুয়েটে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে পড়ছি।
প্রাইমারির গণ্ডি শেষ করে হাই স্কুলে পা দিয়েছি। আগে সহজেই অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে যেতাম। হীনম্মন্যতা যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। হতাশা সহজেই আচ্ছন্ন করে ফেলত। পড়ালেখায় ভালো হলেও দুশ্চিন্তা ছাড়া খুব কম দিনই অতিবাহিত হতো।
এছাড়া সৃজনশীল যে-কোনো কিছুতে আমি সবসময় আকৃষ্ট হয়েছি। সপ্তম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় মাসিক বিজ্ঞান চিন্তায় প্রকাশিত ম্যাথ অলিম্পিয়াডের কিছু মজার প্রশ্ন সময় পেলেই সল্ভ করতাম। ম্যাথ অলিম্পিয়াডের প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবতে মজা পেতাম। তারপরে ২০১৮ সালে অষ্টম শ্রেণিতে বর্তমান ফিকরান ক্যাম্পাসে কোয়ান্টাদের নিয়ে নতুন করে সাদাকায়ন শুরু হয়। আমি তৎকালীন আবাসিক লিডার শোভন স্যারের কথা শুনে সাদাকায়নে আসি। সাদাকায়নের বিষয়গুলো আমাকে ভাবিয়ে তুলল। কেননা বিষয়গুলো আমার জন্যে নতুন ছিল। কথাগুলো আমাকে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করে ফেলে।
আমি ইনট্রোভার্ট টাইপের ছিলাম। নিজের কষ্ট এবং আনন্দগুলোকে প্রকাশ করতে পারতাম না। সাদাকায়ন করাতেন শিহাব স্যার। ভাবলাম স্যারের সাথে কথা বলি। সাদাকায়ন শেষ হয়ে যায় শুক্রবার সকাল ১০টায়। কিন্তু সাদাকায়নের পরেও আমি স্যারের সাথে হাঁটতে হাঁটতে তার কথাগুলো শুনতাম। এভাবে অনেক সময় বিকেলও হয়ে যেত। বুঝতে পারলাম, জীবনে বড় হতে হলে শুধু মেধাবী হলেই হবে না, আরো অনেক গুণের সংমিশ্রণ দরকার। হতাশা আমাকে যেন আটকে না দেয়, পথ চলায় হোঁচট খেলে যেন উঠে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা পাই সেজন্যে প্রয়োজন একজন প্রাজ্ঞ পথপ্রদর্শক।
লক্ষ্যের বিপরীত কাজগুলো আমাকে সে-সময় অনেক আনন্দ দিত। কিন্তু বুঝলাম আর নয়। আমাকে নিজের প্রবৃত্তি থেকে মুক্তি পেতে হবে। ২০১৯ সালে ক্যাম্পাস পরিবর্তন করে আমরা হিকমান ক্যাম্পাসে আসি। নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা অব্যাহত রাখলাম।
এভাবে আমি যেমন বড় হতে লাগলাম, আমার স্বপ্নও বড় হতে লাগল। ম্যাথ অলিম্পিয়াডে আগ্রহী কিছু কোয়ান্টাকে নিয়ে আমরা ২০২০ সালে প্রথম ম্যাথ অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সে-সময় আমিসহ সাত জন কোয়ান্টা সেন্টারের জাহিদান হলের ৮/৮ ফুটের ছোট্ট একটা রুমে কিছু বই নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমরা টিমের নাম দিলাম Mission Impossible. কিন্তু শ্রদ্ধেয় গুরুজী দাদু এটি কারেকশন করে দিয়ে বললেন, Mission Impossible: we will make it possible.
তারপরে গণিত চর্চা আরো বেড়ে গেল। গণিত এবং বিজ্ঞানকে জীবন হিসেবে দেখলাম। যেহেতু আমরা যোগ এবং ধ্যানচর্চা করি, গণিতকে যোগের অংশ বানিয়ে ফেললাম। যোগ/ ইয়োগার আসনগুলো কল্পনা করতাম জ্যামিতির বিভিন্ন ফিগার হিসেবে। শুরু হলো ইয়োগা চর্চার মাধ্যমে জ্যামিতিক ফিগারগুলোকে আরো সুস্পষ্টভাবে অবলোকন করার প্রচেষ্টা। সেইসাথে ভোরবেলা আরোগ্যশালায় গিয়ে ধ্যানচর্চা যেন মনোযোগকে আরো সূচাগ্র করতে পারি। সেখানে মেডিটেশন করে ‘ইনশাআল্লাহ সব সম্ভব’ প্রত্যয়ন দিয়েই আমাদের কয়েকজনের দিন শুরু হতো। গুরুজী দাদুকে খুব অনুভব করতাম। বারবার মনে হতো জীবনে আসলেই পথপ্রদর্শক দরকার।
প্রতিদিন অল্প অল্প করে নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলাম। কোয়ান্টামে বলা হয়—একা হলে ব্যক্তি আর সঙ্ঘে এলে শক্তি। তখন ম্যাথ অলিম্পিয়াডের পদক জয়ের উদ্দেশ্যে হোক আর যে-কোনো কারণেই হোক বন্ধু শাহনেওয়াজ এবং বাদশার সাথে থাকার ফলে ধীরে ধীরে ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’ হয়ে উঠলাম। সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার কারণে আমাদের দক্ষতা বেড়ে গেল কয়েক গুণ।
হঠাৎ শুরু হলো করোনা মহামারি। দেশে এবং বিশ্বে বিরূপ অবস্থার জন্যে স্কুল-কলেজ বন্ধ হলে সবাই বাড়ি চলে গেলাম। কিন্তু আমরা একমাস পরেই ফিরে আসি কোয়ান্টামমে। মূলত বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে এই ফিরে আসা। এসময় কম্পিউটারে নিজেকে দক্ষ করে তোলার চেষ্টা করি।
করোনায় ছয় মাস স্কুল-কলেজ বন্ধের পরে নতুন উদ্যমে সবকিছু শুরু হয় ক্যাম্পাসে। আমরা ১৮ জুন ২০২১ প্রথমবারের মতো বড় পরিসরে কোয়ান্টা সাদাকায়নের আয়োজন করি। ‘কোয়ান্টা সাদাকায়ন : জীবনে প্রথম হওয়ার প্ল্যাটফর্ম’—এই প্রত্যয়ন ধ্বনিত হলো সেদিন প্রথম। কলেজের ১০০ ফিট হলে সাদাকায়ন শুরু হলেও আমার মনে হয় সঙ্ঘের শক্তির কারণে এবং শতাধিক কোয়ান্টা আগ্রহী হয়ে উঠলে নেয়ামাতান হলে বড় পরিসরে সাদাকায়ন শুরু হয়।
ভাবনা আর বিশ্বাসের বলেই কিছুদিনের মধ্যে সাদাকায়নের পরিধি আমাদের ক্যাম্পাস থেকে অন্যান্য ক্যাম্পাসেও ছড়িয়ে পড়ল। আমরা সাদাকায়নকে আমাদের সংস্কৃতির অংশ করতে চাই—এমন কথাই শুনেছিলাম গুরুজী দাদুর কাছে। তখন মনে হতো সেই স্বপ্নই যেন বাস্তবায়নের পথে।
২০২১ সালে এসএসসি-তে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে কলেজে উঠলাম। কলেজে ওঠার পর আমাদের নিয়ে তৈরি হলো একটিভ কোয়ান্টিয়ার পুল। ১২ জন ছিলাম আমরা। কাজগুলো গুছিয়ে করার জন্যে নিয়মিত বৈঠক করতাম। আর সাদাকায়ন আয়োজনের ফলে বৃদ্ধি পেতে থাকল আমার সামাজিক ফিটনেস। নিজের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে শুদ্ধ ও সত্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগ্রহ বাড়তে থাকল।
কোয়ান্টাম মানবিক মহাসমাজ নির্মাণ করতে চায়। কিন্তু প্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়লে হবে না। বিন্দু বিন্দু পানি মিলেই অতল সাগর হয়। তাই আমাদের গণিতের পাশাপাশি ক্যাম্পাসে শুরু হলো সায়েন্স ক্লাব, নাম দেয়া হলো—আমরা পারি বিজ্ঞান। এই ক্লাবে রয়েছে গণিত, প্রোগ্রামিং, এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্স, গ্রাফিক ডিজাইন এবং লাইফ সায়েন্সের মতো মজার মজার বিষয়। তাই তো এখন হাই স্কুলের শুরু থেকেই একজন কোয়ান্টা বিজ্ঞানে সহজেই দক্ষ হয়ে উঠছে।
বিজ্ঞান, জুনিয়র সায়েন্স, বায়োলজি ও ফিজিক্স অলিম্পিয়াড, সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ, জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ-সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ কোয়ান্টাদের আরো প্রতিভাবান করে তুলছে। আমিও এগুলোতে অংশ নিতাম এবং প্রতিটিতেই আমার কোনো না কোনো পুরস্কার আছে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত গিয়েছিলাম। পুরস্কারের এই ক্রেস্টগুলো আমাদের বিজ্ঞান ভবনে রাখা আছে।
ক্যাম্পাসে বসেই আমরা ভাবতাম, আমাদের এখান থেকেই বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও প্রযুক্তিবিদের আবির্ভাব হবে। এখান থেকেই সৃষ্টি হবে দক্ষ নেতৃত্ব যারা আগামী বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে।
আমি বিশ্বাস করি, কোয়ান্টাম যে মানবিক মহাসমাজের স্বপ্ন দেখে, সেটার সূতিকাগার হলো আমাদের এই কোয়ান্টামম। আর আমরা কোয়ান্টারাই এখানে কসমো ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করব একসময়। স্বর্গভূমি বাংলাদেশ আমরা কোয়ান্টারাই নির্মাণ করব। এগুলো যখন লিখছি কেউ আমাকে পাগল ভাবতে পারে, কিন্তু এগুলো আমাদের প্রত্যয়ী কোয়ান্টাদের বিশ্বাসের কথা।
আর আমাদের হৃদয়ে এই বিশ্বাসকে বুনে দিয়েছেন গুরুজী দাদু।
Quantum Computing এবং Artificial Intelligence আমার পছন্দের বিষয় এবং এসব বিষয়ে আমি দক্ষ হতে চাই। নিজের কাজ আমি ভালোমতো করার চেষ্টা করেছি সবসময়। যখন ছুটিতে সবাই বাড়ি যেত, তখন আমি ক্যাম্পাসে থেকেই পড়ালেখায় দুর্বলতাগুলোকে কাটিয়ে নিতাম। আর সবসময় রুটিন মেনে চলতাম। রুটিন অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন করতে আলসেমি এলে নিজেকে শাস্তি দিতাম।
আসলে কোয়ান্টামম এবং কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজ হলো আমাদের ঘর। ‘আমাদের ঘর আমরাই গোছাব’—এই থিম নিয়ে আমাদের ব্যাচ এবছর (২০২৩) বের হয়েছে।
নিজেকে সবসময় ভাগ্যবান মনে হয়। সবকিছুর জন্যে আমি কৃতজ্ঞ। ফলবান বৃক্ষ যেমন নুয়ে থাকে, তেমনি আমি বিনয়কে জীবনের অংশ বানাতে চাই। গুরুজী দাদুর আলোয় আলোকিত হয়ে জগতে আলো ছড়াতে চাই। কারণ সারা পৃথিবী আমার। ইনশাআল্লাহ সব সম্ভব!
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]