দূরদৃষ্টি কী? ধরুন একজন একটা প্রস্তাব দিল। এই প্রস্তাবের ফলে আপনি যদি ‘হ্যাঁ’ বলেন তাহলে এটার রেজাল্ট কী হবে? এখন, পাঁচ বছর পরে, ১০ বছর পরে, ৫০ বছর পরে। আর যদি ‘না’ বলেন, যদি এটা ডিস্কার্ড করে দেন, তাহলে এটার রেজাল্ট কী হবে? এটা বুঝতে পারার নাম দূরদৃষ্টি।
অন্তর্দৃষ্টি হচ্ছে ঘটনার অন্তর্নিহিত সত্যটাকে উপলব্ধি করা। আর দূরদৃষ্টি হচ্ছে ঘটনার প্রেক্ষাপটে আপনার সিদ্ধান্তের ফলাফল স্বল্পমেয়াদে এবং দীর্ঘমেয়াদে কী হবে এটা বুঝতে পারা।
আসলে যে প্রজ্ঞাহীন, সে অজ্ঞ। তার সূত্র হচ্ছে—নগদ যা পাও হাত পেতে নাও বাকির খাতা শূন্য থাক। দূরের বাদ্য লাভ কী শুনে, মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক। এদের জীবনটা টোটালি ফাঁকে পড়ে যায়। এরা শুধু দূরের বাদ্য না আসল ফাঁকে পড়ে যায়।
প্রাজ্ঞ সবসময় দূরের চিন্তা করে আর অজ্ঞ সবসময় নগদটা চিন্তা করে।
ধরুন এই যে মোঘল সাম্রাজ্য। মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর প্রাজ্ঞ ছিলেন।
বাবর যখন ফারগানার রাজকুমার ছিলেন (এখনকার উজবেকিস্তান তখন ছিল ফারগানা)। তখন তিন তিনবার তিনি ফারগানার আরেক রাজকুমারের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন। তিন তিনবার ফারগানা উদ্ধার করার জন্যে তিনি যুদ্ধ করেন এবং পরাজিত হন। তখন তার মনে প্রশ্ন জাগল তাহলে আমার সাফল্যের ‘বীজ’ কোথায়?
তিনি সৈন্যবাহিনী নিয়ে রওনা হলেন- কাবুল কান্দাহার লাহোর পানিপথের দিকে। তার ডিসিশন কত কারেক্ট ছিল!
পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদির লক্ষাধিক সৈন্য এবং বিশাল হস্তিবাহিনী। বাবরের কোনো হস্তিবাহিনী নাই।
বাবর কী করলেন? হাতি সবচেয়ে বেশি ভয় পায় আগুন। আগুন দেখলে হাতি আর ঐদিকে যায় না।
তো বাবর নতুন সমরকৌশল প্রয়োগ করলেন। উটের পেছনে কাঠের চাকার ট্রলি এবং পাটাতন বানিয়ে ওটার ওপরে শুকনো গম গাছ (খের) স্তূপ করে আগুন ধরিয়ে দিলেন।
এখন উট দেখছে পেছনে আগুন। সে জানের ভয়ে দৌড়াচ্ছে সামনের দিকে। আর সামনে হাতি দেখছে যে আগুন আসছে।
হস্তিবাহিনী বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
ধরুন একশ দুইশ হাতি। এই হাতি সবসময় থাকত সেনাবাহিনীর সামনে। হাতি আগে যেত, পেছনে সৈন্যরা যেত।
তো হাতি তখন উলটপালট হয়ে গেল। লক্ষাধিক সৈন্যসহ ইব্রাহিম লোদি পরাজিত হলেন, নিহত হলেন।
বাবর সম্রাট হলেন।
বাবরের পরে হুমায়ুন। হুমায়ুনের পরে আকবর। আকবরের পরে জাহাঙ্গীর।
সাধারণত চতুর্থ প্রজন্ম থেকে আহাম্মক শুরু হয়।
জাহাঙ্গীরের কন্যা অসুস্থ। কোনো হেকিম কবিরাজ তাকে সুস্থ করতে পারছে না। ইংরেজরা তখন বাণিজ্য করতে এসেছে। ফরাসিরা বাণিজ্য করতে এসেছে। ওলন্দাজরা বাণিজ্য করতে এসেছে।
তখন টমাস রো নামের এক ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে ডাক্তার সেজে গেল জাহাঙ্গীরের দরবারে। বললো যে সে সম্রাটের কন্যার চিকিৎসা করতে চায়।
যেহেতু হেকিম কবিরাজরা কিছু করতে পারছে না, জাহাঙ্গীর তাকে চিকিৎসা করার অনুমতি দিল।
যে-কোনোভাবে হোক টমাস রো-র চিকিৎসায় সম্রাটের কন্যা সুস্থ হয়ে উঠলেন।
তখন তো স্বাভাবিকভাবেই সম্রাট মহাখুশি। ‘দিল্লিশ্বরও জগদীশ্বর’ বন্দনা গাইতে গাইতে টমাস রো দরবারে হাজির।
সম্রাট বললেন যে, কী পুরস্কার চাও তুমি?
টমাস রো কিন্তু সোনা চায় নি, দানা চায় নি। টমাস রো বলল যে, আমরা ইংরেজ জাতি বাণিজ্য করি (বাংলাতে তো বলে নাই, ফার্সিতেই বলার চেষ্টা করেছে অথবা ভাঙা ফার্সি-ইংরেজি মিশিয়ে বলেছে) “হামার কিছু চায় না, চায় বিনাশুল্কে বাণিজ্য করতে। ছোট্ট কোম্পানি সম্রাট, ছোট্ট কোম্পানি। বিনাশুল্কে বাণিজ্য করতে চাই।”
সম্রাট চিন্তা করলেন- এটা একটা চাওয়া হলো! এই একটা কোম্পানি, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, বিনাশুল্কে বাণিজ্য করতে চায়। একটা কোম্পানির কাছ থেকে আর কত শুল্ক হয়। যাও, হো গিয়া।
একটা ‘যাও’। এরপরে কী হলো? জাহাঙ্গীরের পরে শাহজাহান। শাহজাহানের পরে আওরঙ্গজেব। আওরঙ্গজেবের পরে… শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর।
উনি কবিতা লিখতেন। কবিতা লিখবেন না তো কী করবেন? সম্রাট যখন কবিতা লেখে, তখন বুঝতে হবে যে এই সাম্রাজ্যের আর কোনো ভবিষ্যৎ নাই।
কবিতা লিখবেন কবি। সম্রাট একটু কবিতা শুনবেন তারপর বলবেন যে, মারহাবা মারহাবা, বহুত খুব, বহুত খুব।
তো কী হলো? জাহাঙ্গীরের ভুলের ফসল শুধু তার উত্তরসুরিরা দেয় নাই। সমগ্র ভারতবাসীকে দিতে হয়েছে। ২০০ বছরের গোলামি।
টমাস রো-তো এটা না চেয়ে বলতে পারত যে ‘আমাকে দুই লরি সোনা দাও।’ আরে সম্রাট দুই লরি কী দুই জাহাজ সোনা দিয়ে দিত। কিন্তু তাতো চায় নি। একটা ছোট্ট চাওয়া একটা ছোট্ট ভুল। দুশ বছরের গোলামি পুরো জাতির জন্যে।
এবং গোলামি আমাদের শেষ হয় নাই! কারণ সেই ১৭৫৭ সাল থেকে যে ঋণ সেই ঋণের বোঝা ভারতকে এখনো টানতে হচ্ছে। পাকিস্তানকে টানতে হচ্ছে।
পাকিস্তান থেকে তো আমরা আলাদা হয়ে গেছি। ঋণের সেই বোঝা আমরাও টানছি কিনা- আমি জানি না।
একটা ছোট্ট ভুল। এটা হচ্ছে প্রজ্ঞা এবং প্রজ্ঞাহীনতা। হতভাগ্য বাহাদুর শাহ। রেঙ্গুনে তার কবর। তার কবরে লেখা, তার কবির কবিতা। “বাহাদুর তুমি এত হতভাগা যে তোমার দেশে কবরের জন্যে মাটি পর্যন্ত পেলে না!
মাটি পাবে কীভাবে? তার পূর্বপুরুষ যে মাটি বিক্রি করে দিয়ে গেছে একটা ভুলের কারণে। এটা হচ্ছে প্রজ্ঞাহীনতা। জাহাঙ্গীরের জন্যে এটা ছিল ছোট্ট সিদ্ধান্ত। কিন্তু তার টোটাল মূল্য দিতে হলো ভারতবাসীকে, পুরো জাতিকে।
আপনার একটা ছোট্ট ভুলও আপনার সন্তানের সর্বনাশ করতে পারে!
কিছু না, একটা স্মার্টফোন তুলে দেবেন। আজকাল তো আমরা তুলে দেই খুব আনন্দ করে। বাচ্চা ‘ম্যাও’ বলতে পারে না, ম্যা স্মার্টফোন নিয়ে তার সামনে ধরি। বল ম্যা, ঐ যে তোর বাবা ঐখান থেকে দেখবে।
একটা ছোট্ট ভুল আপনার সন্তানের সর্বনাশ করে দিতে পারে।
এরপরে যত দুঃখ করেন কোনো লাভ নেই। এই একটা স্মার্টফোনই আপনার সন্তানকে অটিস্টিক বানিয়ে দিতে পারে। এখন তো যত অটিস্টিক শিশু, এর একটা বড় কারণই হচ্ছে স্ক্রিন। ছয় মাসের বাচ্চা সেও স্ক্রিন বুঝে, চ্যানেল বুঝে। এত স্মার্ট বানিয়েছেন। মা আবার গর্ব করে বলে, দেখেন ছয় মাসের বাচ্চা সেও স্ক্রিন বোঝে।
আমি বলি যে ইয়া আল্লাহ এ কী মা। ছয় মাসের বাচ্চাকে স্ক্রিন শিখিয়ে দিয়েছে!
আসলে যদি জাহাঙ্গীরের প্রজ্ঞা থাকত। কী বলতেন?
জাহাঙ্গীর হেসে বলতেন, আমি ভারতেরশ্বর! আমার কাছে এরকম একটা ছোট্ট জিনিস চাচ্ছ! এত ছোট জিনিস আমি তোমাকে দেই কীভাবে? এ্যাই, দুই লরি সোনা দিয়ে দাও। এ-তো চাইতেও জানে না দেখছি!
শেষ। এটাই হচ্ছে প্রজ্ঞা এবং প্রজ্ঞাহীনতা।
[প্রজ্ঞা জালালি, ০৩ জুলাই, ২০১৯]
Leave a Reply