1. [email protected] : আরএমজি বিডি নিউজ ডেস্ক :
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৫:৩৮ অপরাহ্ন

জি সি দেব : ২৫ মার্চের কাল রাতে যে মহান মানুষটিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল

  • সময় বৃহস্পতিবার, ২৫ মার্চ, ২০২১
  • ১২০৯ বার দেখা হয়েছে

জন্ম সিলেটে ১৯০৭ সালে। পুরো নাম গোবিন্দচন্দ্র দেব। কিন্তু পুরো নামে তিনি পরিচিত ছিলেন না। তিনি পরিচিত ছিলেন জি সি দেব নামে।

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

সংঘাতময় লালন মানুষকে সংগ্রামী ও মানবপ্রেমিক হতে সহায়তা করে…

আসলে ভালো লালন হলে ভালো। কিন্তু অধিকাংশ সময় ভালো লালনের চেয়ে সংঘাতময় যে লালন সেই লালন মানুষকে সংগ্রামী হতে, মানবপ্রেমিক হতে অনেক বেশি সহায়তা করে।

অধিকাংশ সময়ই ভালো লালন মানে হচ্ছে চব্য চোষ্য লেহ্য পেয়, সমস্ত ননি-মাখনের মধ্যে যারা বড় হন। এই লালনে যারা লালিত হয় তারা আসলে স্বার্থপর হন বেশি।

তো জিসি দেব তার বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসায়ে তার ভরাডুবি হয়। এবং সর্বস্বান্ত হয়ে ব্যবসা হারানোর দুঃখে তিনি মারা যান।

কারণ আসলে ব্যবসায়ীদের অসুবিধা হচ্ছে যে তারা তাদের সাফল্যের মানদণ্ডটা অর্থ দিয়ে বিচার করে। কোনো কারণে যদি ভরাডুবি হয় এখান থেকে উঠে দাঁড়ানো, রুখে দাঁড়ানো তাদের জন্যে খুব কঠিন। যদি না সে ব্যবসায়ীর মধ্যে মানবতাবোধ থাকে এবং আত্মিক শক্তি থাকে।

লেখাপড়া করার সবটুকুই তাকে করতে হয়েছে নিজের চেষ্টায়…

তো গোবিন্দ দেব আট বছর বয়সে গৃহহারা, নিরাশ্রয়। রামকৃষ্ণ মিশন এবং খ্রিষ্টান মিশনারিদের তত্ত্বাবধানে থেকে লেখাপড়া করেন। তারপরে কলকাতা সংস্কৃত কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। সবটুকু নিজের চেষ্টায়ই তাকে করতে হয়েছে।

পড়াশোনা করতে গিয়ে ভারতীয় আধ্যাত্মতাবাদ, গ্রিক দর্শন, বৌদ্ধ দর্শন, ইসলাম ধর্ম এবং খ্রিষ্টধর্মের মূলবাণী জানার চেষ্টা করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতার রিপন কলেজে।

যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন রিপন কলেজটি দিনাজপুরে সরিয়ে নেয়া হয়। যুদ্ধ শেষ, কলেজ আবার কলকাতায় সরিয়ে নেয়া হলো।

প্রাকটিকেলি ভিক্ষার থলি নিয়ে শুরু করলেন কলেজ গড়ার যাত্রা…

কিন্তু জিসি দেব দিনাজপুরে রয়ে গেলেন। নতুন একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলেন।

আসলে এত মানবপ্রেমী মানুষ আমি আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্যে, গ্রামে-গঞ্জে প্রাকটিকেলি ভিক্ষার থলি নিয়ে, সভা সমিতি করলেন, এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করে দিনাজপুরের একমাত্র কলেজ সুরেন্দ্রনাথ কলেজ গড়ে তুললেন।

কলেজ গড়া শেষ হলো। দেশভাগ হলো। এবং ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যোগ দিলেন।

অনেকের তত্ত্ববিদ্যা অনেক বেশি; কিন্তু ‘মানুষ’ হিসেবে ভালো নন…

তিনি যে আসলে কত বড় দার্শনিক ছিলেন! এবং কত ভালো মানুষ ছিলেন!

আসলে অনেকের তত্ত্ববিদ্যা অনেক বেশি। কিন্তু ‘মানুষ’ হিসেবে ভালো নন। এই যে আইনস্টাইন, অনেক বড় দার্শনিক ছিলেন, বিজ্ঞানী ছিলেন। কিন্তু বউ পেটাতেন তিনি।

এটা আমার মনে হয় যে আমেরিকাতে যারা যায় তাদের একটা অভ্যাস হিসেবে সৃষ্টি হয়ে যায়। একেক জায়গার একেকটা ভাও আছে তো। কারণ ক্লিনটন যদি বলতে পারেন যে ‘আমার বাবা বউ পিটাতে ওস্তাদ ছিলেন’। তার বাবা তার মাকে যখন পিটিয়েছে তখন সে তার ‘মা’ ছিল না, তার ‘বাবার বউ’ ছিল!

আসলে দার্শনিক হলেই, তত্ত্বজ্ঞান থাকলেই, বিজ্ঞানী হলেই তার জীবনে বিজ্ঞানের প্রভাব পড়বে, দর্শনের প্রভাব পড়বে। নাও পড়তে পারে।

যে-রকম আসলে অনেক আলেম ছিলেন আগে। তাদের জীবনে তাদের ইলমের কোনো প্রভাব ছিল না। এবং তাদের জীবনে যেহেতু তাদের ইলমের কোনো প্রভাব ছিল না, তাদের ছেলেরা আমাদের দেশে বড় বড় কমিউনিস্ট হয়ে গেছেন।

এবং যত বড় কমিউনিস্ট ছিলেন ৫০-এর দশকে, ৬০ এর দশকে, ৭০-এর দশকে সবার বাবাই বড় আলেম ছিলেন।

কেন? তাদের জীবনে ইলমের কোনো প্রভাব ছিল না। ইলম অন্যদের জন্যে। ওয়াজ করতেন, কিন্তু ওয়াজের প্রভাব তাদের জীবনে ছিল না। এবং যে জন্যে তারা স্মরণীয় হতে পারেন নাই।

তাদের ছেলেরা বরং স্মরণীয় হয়ে গেছে বাবার চিন্তার বিরোধিতা করে।

অল পাকিস্তান ফিলোসফিকেল কংগ্রেসের সভাপতি হয়েও চলাফেরাটা ছিল খুবই সাধারণ…

তো জিসি দেব, মানে আগাগোড়া শুধু চিন্তায় চেতনায় মননে না, অবয়বে দেহে চেহারায় সবকিছুতে ছিলেন ভালো মানুষ।

তিনি যে তখন শুধু বাঙালি দার্শনিকদের মধ্যে সেরা তা না, ৬০-এর দশকে তো আমরা পাকিস্তানের অংশ ছিলাম। এবং পাঞ্জাবিরা আমাদেরকে আমরা যে মানুষ এটাই মনে করত না।

তারা মনে করত যে সমস্ত বিদ্যাবুদ্ধি, সমস্ত শরাফত, সমস্ত আভিজাত্য আর অর্থ তো ছিলই তাদের হাতে। সব তাদের।

এবং সেই সময় জিসি দেব অল পাকিস্তান ফিলোসফিকেল কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন।

কিন্তু চলাফেরাটা ছিল খুবই সাধারণ। হাঁটু পর্যন্ত তোলা ধুতি। খুব সাদামাটা পাঞ্জাবি, সুতির।

এবং যখন চুল একটু পাকতে শুরু করল। চুল ছিল সাদাপাকা, ঝাঁকড়া চুল। গোলগাল চেহারা। এবং একটু মোটাসোটা আর কি। মানে মোটা বলা ঠিক না। মানে দৈহিক গড়নটা একটু ওজনদার ছিল।

তিনি ফার্স্টক্লাস প্যাসেঞ্জার নন, ছিলেন ফার্স্টক্লাস মানুষ!

পাকিস্তানিদের সামনে এইরকম এই ধুতি পরা, এরকম সাদামাটা! দেখলে মনে হতো যে আচ্ছা মানে খুবই সাদামাটা!

এ নিয়ে মজার ঘটনাও হয়েছে। একবার হলো এটা রাজশাহী যাওয়ার পথে, রাজশাহীর ট্রেনে।

অল পাকিস্তান ফিলসফিকেল কংগ্রেসের কনফারেন্স হচ্ছে রাজশাহীতে। সভাপতি হিসেবে তিনি যাচ্ছেন। উঠেছেন ট্রেনের ফার্স্টক্লাসে।

তো হাঁটু পর্যন্ত তোলা ধুতি আর ঐ চেহারা। মানে যেটাকে অভিজাত মহিলারা এরকম ড্রেস ট্রেস দেখলে বলে যে, ‘গাইয়া গাইয়া’ লাগে।

তো যখন টিটি টিকেট চেক করতে বেরিয়েছে, তার দিকে তাকাচ্ছে বার বার, চেহারা দেখার চেষ্টা করছে। এবং উনি যে ফার্স্টক্লাসের যাত্রী হতে পারেন এটা টিটির মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না! আড়চোখে কয়েকবার তাকিয়ে ইশারা করলেন টিকেট দেখানোর জন্যে।

তো জি সি দেব তো মানে, উনি তো বোঝেন আরকি! উনি খুব একটা চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বললেন, My dear Friend, I may look like a third class passenger, but my ticket is first class. কারণ তখনকার টিটিরা অধিকাংশই উর্দুভাষী ছিল ৬০-এর দশকে ট্রেনের।

আসলে তিনি যে এত বড় মাপের মানুষ, উনি যে ফার্স্টক্লাস প্যাসেঞ্জার না, উনি যে ফার্স্টক্লাস মানুষ এটা তার অবয়ব এবং পোশাক-আশাক দেখে সাধারণ মানুষ কখনো বুঝতে পারত না।

পেরিয়ে গেল ঘণ্টা! কিন্তু চাদর ভেবে মশারি গায়ে দিয়েই হাঁটছেন…

আসলে কীরকম আত্মভোলা ছিলেন তিনি?

আমি আসলে আমি খুবই শ্রদ্ধা করতাম এবং শ্রদ্ধা পাওয়ার মতোই মানুষ।

একদিন হলো- উনি তখন প্রভোস্ট, জগন্নাথ হলের। তো আমার এক বন্ধুর সাথে গিয়ে নিজে উদ্যোগী হয়েই পরিচিত হওয়া।

একদিন গিয়েছি খুব ভোরবেলা। শীতের সকাল। একটু কুয়াশাও আছে।

আমি সালাম দিলাম, উনি কিছুই বললেন না। এরকম হাসি দিলেন। মানে হাসি তার মুখে লেগেই থাকত।

আমি ভাবলাম যে মুডটুড অফ হবে, কিছু হবে।

উনি লনে হাঁটছেন। তো এখন উনি হাঁটছেন, আমিও নাসিরুদ্দীন হোজার মতন, উনি যখন হাঁটছেন তো আমি ওনার পেছনে পেছনে হাঁটছি।

তো উনিও হাঁটছেন, আমিও হাঁটছি। উনিও চুপচাপ, আমিও চুপচাপ।

কারণ উনি যেহেতু সালামের জবাব দেন নি, এখন তো মানে কিছু আর কিছু জিজ্ঞেস করাও তো হচ্ছে বেয়াদবি, যতক্ষণ পর্যন্ত না উনি আবার কথা বলছেন।

তো এই হাঁটা চলছে। আমিও হাঁটছি, উনিও হাঁটছেন।

একঘণ্টা পরে তিনি আমার দিকে তাকালেন। একটা হাসি দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ?

আমার তো তখন বিস্ময় যে, এই কেমন আছ জিজ্ঞেস করতে, হাসি দিতে একঘণ্টা লাগল!

আমি বললাম যে, স্যার, আমি একঘণ্টা ধরে আপনার পেছনে। বললেন যে, আমি খেয়াল করেছি, কিন্তু আমি মৌনব্রত ছিলাম।

আমি বললাম, স্যার ‘মৌনব্রত’ এটা আবার কী জিনিস?

উনি বললেন, মৌন–একদম ঐসময়ে কোনো কথা নাই। আমি আমার ভাবনায় ছিলাম। আমার খেয়াল হলো- কেউ একজন এসছে।

আমি বললাম, ইয়া আল্লাহ! এরকম জলজ্যান্ত একটা মানুষ! ঠিকাছে মনে হলো।

এবং উনি যখন মৌনব্রত করছিলেন মশারি গায়ে দিয়ে। তো আমি আর কৌতূহল রাখতে পারলাম না!

আমি বললাম যে, স্যার! মৌনব্রত করলে কি মশারি গায়ে দিতে হয়? তো উনি বললেন যে, মশ, মশ, মশারি কোথায়? মশারি কোথায়? আমি তো চাদর গায়ে দিয়ে আছি।

আমি বলি যে, স্যার আপনি একটু যদি তাকাতেন নিজের দিকে।

তো উনি তাকিয়ে ওহ হো! আমি তো এটাকে চাদর ভেবেছিলুম!

এখন বোঝেন! শীতের সকালবেলা চাদর ভেবে মশারি গায়ে দিয়ে হাঁটছেন। তো একঘণ্টার মধ্যে টেরও পান নাই।

আসলে এই যে ভাবনার রাজ্যে, চিন্তার রাজ্যে কত নিমগ্ন কত নিমগ্নতা!

শীত কি লাগে নাই? ঠান্ডা কি লাগে নাই? চাদরের শীত কি মশারি দিয়ে আটকানো যায়?

কিন্তু নাথিং। কেন?

মন তখন ভাবনার রাজ্যে। একটা জলজ্যান্ত মানুষকে বললাম যে, আচ্ছা, একটা কেউ আসছে। কেউ একটা।

যে-রকম চোখ বন্ধ করলে যেরকম মনে হয় যে, আচ্ছা, একটা মানুষ! উনি মনে করছেন আমিও সে-রকম একটা ছায়া, আসল না। আসল হলে তো উনি ডিস্টার্বড হয়ে যেতেন।

তো এই যে নিমগ্নতা, এই নিমগ্নতা তাকে ঐ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল।

তিনি সবসময় মানুষকে ‘মানুষ’ হিসেবে দেখেছেন…

আসলে তিনি কত বড় মানুষ ছিলেন!

তিনি তার স্টুডেন্টসের জন্যে সবসময় father figure। সেই স্টুডেন্ট হিন্দু না মুসলমান, বাঙালি না পাঞ্জাবি- এসব খোঁজ তিনি কখনো করেন নাই। তিনি মানুষকে সবসময় ‘মানুষ’ হিসেবে দেখেছেন।

এবং সব ধরনের সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে ছিলেন এবং সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

তিনি চিরকুমার ছিলেন। এক হিন্দু ছেলেকে এবং এক মুসলিম মেয়েকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

এবং নিজের সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির অর্ধেক হিন্দু ছেলে এবং মুসলিম মেয়ে এই দুজনের মধ্যে সমান ভাগ করে দেন।

এবং বাকি অর্ধেক সম্পত্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন। এবং শর্ত ছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয় অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী দর্শন প্রচার করবে। এবং ১৯৮০ সালে এই অর্থ দিয়ে ‘গোবিন্দ দেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

প্রত্যেকদিন সকালবেলা উঠে তিনি গীতা বাইবেল কোরআন পড়তেন। তারপর ধ্যানে বসতেন এবং মৌনতা পালন করতেন।

জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন সুস্থ; কিন্তু শতায়ু হতে পারেন নি…

জি সি দেব বিশ্বাস করতেন- বার্ধক্য দৈহিক নয়, বার্ধক্যটা হচ্ছে মানসিক।

পরিমিত আহার, পরিমিত বিশ্রাম, পরিশ্রম এবং সৎকর্ম, এবং অন্যের কল্যাণ যদি কেউ কামনা করতে পারে তাহলে তার পক্ষে শতায়ু হওয়া খুব সহজ।

তিনি যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন তার আসলে সেইরকম কোনো রোগব্যাধি হয় নাই। সুস্থ ছিলেন, কিন্তু শতায়ু হতে পারেন নি।

শুধু পদানত করা না! হানাদারদের মূল লক্ষ্য ছিল আমাদেরকে মেধাশূন্য করে ফেলা…

২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা শহরে যখন অভিযান শুরু করল, নির্বিচারে হত্যা শুরু করল, তখন মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর সাথে পুলিশ লাইন, ইপিআর।

তারা শুধু আমাদেরকে হত্যা করতে চায় নি তারা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকেও খতম করে দিতে চেয়েছিল। ২৫শে মার্চ রাতে এবং ২৬শে মার্চ সকাল হওয়ার পরে তারা বেছে বেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যা করে।

এবং জি সি দেবকেও তারা অত্যন্ত নির্মমভাবে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়, হত্যা করে।

শুধু পদানত করা না! হানাদারদের মূল লক্ষ্য ছিল আমাদেরকে মেধাশূন্য করে ফেলা। শুধু সেইদিন তিনি না, আমাদের অনেক প্রিয় শিক্ষক, অনেক প্রিয় মানুষ একইসাথে নিহত হন।

অবশ্য তার উপযুক্ত জবাব তারা পেয়েছে। আমাদেরকে হেয় করত তারা। আজকে তাদের পার্লামেন্টে বলা হয়, বাংলাদেশের সমকক্ষতা অর্জন করতে পারলেই আমরা ‘উন্নত’ হলাম। এবং এটাই হচ্ছে প্রকৃতির শাস্তি।

তার সত্য কথন, সততা, মানবিকতা এবং দর্শনের জন্যে তাকে ব্রাশফায়ারে ছিন্নভিন্ন করা হয়…

দার্শনিক জি সি দেব। তিনি আসলে মুসলিম দর্শনের ওপরে এত বড় পণ্ডিত তার আগেও কেউ আসে নি আমাদের দেশে। এবং তারপরেও কোনো দার্শনিক মুসলিম দর্শনের ওপরে এই গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন নি।

এট লিস্ট সেটার প্রকাশ তারা করতে পারেন নাই, তিনি যেভাবে মুসলিম দর্শন সম্পর্কে জ্ঞান রাখতেন এবং যেভাবে মুসলিম দর্শনকে প্রকাশ করেছেন।

এবং তার এই নিমর্ম নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড আমাদেরকে ইতিহাসের আরো দুজন দার্শনিককে স্মরণ করিয়ে দেয়।

একজন হচ্ছেন সক্রেটিস। তাকেও হেমলক পানে মারা যেতে বাধ্য করা হয়।

আরেকজন হচ্ছেন ইমাম আবু হানিফা। যার গলায় জোর করে বিষ ঢেলে দেয়া হয়। কারণ উনি বুঝতে পেরেছিলেন, যে পানির পাত্র তাকে দেয়া হচ্ছে এই পানির পাত্রে বিষ আছে।

এবং উনি বলেছিলেন যে, আমি জেনে বিষ পান করব না। আমি যেহেতু বুঝতে পারছি এটা বিষ, পান করব না।

তখন তাকে ধরে তার গলায় ঢেলে দেয়া হয় এবং ইমাম আবু হানিফা শহিদ হন।

এবং জিসি দেবকে ব্রাশফায়ারে ছিন্নভিন্ন করা হয় তার সত্য কথনের জন্যে, তার সততার জন্যে, তার মানবিকতার জন্যে, তার দর্শনের জন্যে।

সত্যচারীর কখনো মৃত্যু নাই, ধার্মিকের মৃত্যু নাই…

আসলে সক্রেটিস যেভাবে অমর, ইমাম আবু হানিফা যেভাবে অমর, জিসি দেবও অমর হয়ে থাকবেন আমাদের মাঝে। আসলে সত্যের কখনো মৃত্যু হয় না, মানবিকতার কখনো মৃত্যু হয় না, ধর্মের কখনো মৃত্যু হয় না।

তাই সত্যচারীর মৃত্যু নাই, ধার্মিকের মৃত্যু নাই।

মুসলিম দার্শনিকদের অবদান বিশ্লেষণে জি সি দেবের সমকক্ষ কোনো দার্শনিক আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে জন্মগ্রহণ করেন নাই।

নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর যে মুসলিম দর্শন, বাগদাদ এবং কর্ডোভাতে যে দর্শন বিকশিত হয়েছিল, পরবর্তী সময় পাশ্চাত্যের দার্শনিকরা বলেছেন যে, ওটা কিছু না, ওটা এরিস্টটল এবং প্লেটোর দর্শনের জাস্ট অনুবাদ।

যুক্তি বিশ্বাস সদাচার ও ধর্মাচারের মধ্যে কোনো সংঘাত নাই- জিসি দেব

কিন্তু জি সি দেব। তার বই আছে মুসলিম দর্শনের ওপরে।

তিনি আল কিন্দি, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, ইবনে তোফায়েল–এদের দার্শনিক রচনাবলি পর্যালোচনা করে দৃঢ়ভাবে বলেন যে,

“ইউরোপীয় পণ্ডিতদের এই ধারণা যথার্থ নয়। মানুষের ইতিহাসে যখন স্বাধীন চিন্তার ঢাকঢোল বিশেষ বাজে নি বরং যখন স্বাধীন চিন্তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতো, সেই যুগে মুসলিম দার্শনিকরা স্বাধীন চিন্তার পথে অগ্রসর হতে চেষ্টা করেছেন। তারা যে স্বাধীনতা ও স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছেন, তাদের আগের কিংবা পরের ইতিহাসেও তার খুব একটা নজির নাই।”

এটা জি সি দেবের কথা। প্রতিভার পরশকাঠির স্পর্শে মুসলিম দার্শনিকেরা প্লেটো এরিস্টটলের বিস্মৃতপ্রায় মতবাদকে সজীব করে তুলে ছিলেন। দর্শনের নিষ্প্রাণ মমির পুনরুজ্জীবনে তাদের দান প্রচুর। স্বকীয়তা ও মৌলিকতা না থাকলে প্রাণহীন পুরাতনকে তারা সতেজ ও নবীন করতে পারতেন না।

আর মুসলিম দার্শনিকগণ গড্ডলিকা প্রবাহের ন্যায় চলেন নি। ‘গড্ডলিকা’ মানে হচ্ছে ভেড়ার পাল। ভেড়ার পালের স্বভাব এমন যে তাদের একটি যে জায়গায় লাফ দেবে অন্য সবাই সেখানে লাফ দেবেই দেবে। যারা গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসায়, তাদের স্বকীয়তা বলে কিছু থাকে না। তারা তাদের নিজস্ব বুদ্ধি বিবেচনা অন্যের কাছে বিকিয়ে দেন।

কিন্তু মুসলিম দার্শনিকেরা প্রচলিত রীতিনীতি অন্ধভাবে গ্রহণ করেন নি। এমনকি প্লেটো এরিস্টটলের দর্শনও তারা বিনা বিচারে গলাধঃকরণ করেন নি। প্লেটো এরিস্টটলের মতো বড় বড় দার্শনিকরা বিশ্বাস করতেন- আকাশে গ্রহ নক্ষত্র সব জ্যোতির্ময় দেবতা। মুসলিম দার্শনিকরা এসব অযৌক্তিক ঐতিহ্যের দ্বারা প্রভাবিত হন নি। এটা তাদের স্বাধীন চিন্তার পক্ষে এক বড় যুক্তি।

মুসলিম দার্শনিকগণ নিজের মতো করেই গ্রিক দর্শন ব্যাখ্যা করেছেন।

তিনি বলছেন, “শুধু যুক্তিবাদী মুসলিম দার্শনিকরা কেন? সুফিবাদীরাও একটা স্বকীয়তা দেখা যায়। কোরআনের অর্থ ব্যাখ্যায় তারা যথেষ্ট মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তাদেরই একজন বলেছেন, কোরআনের প্রত্যেক কথার অর্থ সাত, ৭০ বা সাতশ রকম হতে পারে। ঐশীবাণীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখে শাস্ত্র ব্যাখ্যায় স্বকীয়তার স্থান দেয়ার এ এক বিস্ময়কর চেষ্টা।”

জি সি দেব বলেন যে, নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত মুসলিম দার্শনিকগণ যে সার্বজনীন উদার দৃষ্টি, জ্ঞানের প্রতি গভীর অনুরাগ ও মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন, বিশ্বের দর্শনের ইতিহাসে তা এক গৌরবময় অধ্যায় বলে আমরা মনে করি।

আসলে উনি যে সময়কালের দার্শনিক ছিলেন, যে সময় জ্যঁ পল সাঁত্রে, বার্ট্রান্ড রাসেল এদের যুগ।

এবং জ্যঁ পল সাঁত্রের মজা হচ্ছে, জ্যঁ পল সাঁত্রের একটা বই আছে- বিয়িং এন্ড নাথিংনেস। ওটা পড়ার জন্যে আমি আরো ৭০টা বই পড়েছিলাম। কিন্তু তারপরও কিছুই বুঝি নাই!

এবং এরপরে দর্শনের ওপরে আমার আগ্রহ কমে গেল যে, যা বোঝা যায় না, যার ৭০ রকম ব্যাখ্যা হতে পারে, যা দুর্বোধ্য, যা সংশয়াচ্ছন্ন, এটা পড়ার মধ্যে কোনো কল্যাণ নাই।

যা মানুষকে সংশায়িত করে। অর্থাৎ মানুষের সংশয়টাকে বাড়িয়ে দেয়, যা মানুষকে বিভ্রান্ত করে, সেটা আসলে কোনো দর্শন হতে পারে না। কিন্তু সেইসময় দার্শনিক হিসেবে তারা খুব বড়মাপের ছিলেন।

তো তিনি খুব সুন্দরভাবে বলেছেন যে, যুক্তিবর্জিত বিশ্বাস আজকের দিনের মানুষের কাছে নেহায়েত পানসে। তো যুক্তির নামে যে সংশয়বাদ আজকের দিনের বাজারে চালু সে ভদ্রবেশী অতিকায় দানবও মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে সামগ্রিক ধ্বংসের পথে।

যুক্তিবর্জিত বিশ্বাস যে-রকম, একইভাবে যুক্তির নামে সংশয়বাদ।

তো সংশয় দানবের পূজারি হয়ে খেয়াল রাখবেন সংশয় দানবের পূজারি হয়ে আচারবর্জিত জীবনযাপনেও তাই বিপদ প্রচুর। বিজ্ঞান আমাদের আপেক্ষিক সত্যেরই জ্ঞান দেয়। সে জ্ঞান অবস্থাভেদে বদলে যায়। নিরপেক্ষ সত্যে পৌঁছতে না পারলে সত্যের চরম রূপের সাথে পরিচয় হয় না।

তাই যুক্তিবাদের সাথে গাজ্জালীর সুফিবাদের সমন্বয় আজ অতি প্রয়োজন। ইসলামি চিন্তাধারায় শরিয়ত ও মারেফতের সংযোগ ঘটানো ইমাম গাজ্জালী এক বড় দান। যুক্তি, বিশ্বাস, সদাচার ও ধর্মাচারের মধ্যে কোনো সংঘাত নাই।

খেয়াল করবেন, যুক্তি বিশ্বাস সদাচার ও ধর্মাচারের মধ্যে কোনো সংঘাত নাই। কোরআনে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। কোরআন একসঙ্গে যুক্তি সদাচার ও অনুভূতিকে সমর্থন করে।

এটা জি সি দেবের কথা।

বস্তুবাদের শিক্ষা মানুষকে শান্তির দিশা দেয় না…

আসলে ৬০-এর দশক ছিল বস্তুবাদের দশক।

এবং আমি একদিক থেকে খুব লাকি! আমি চরম বস্তুবাদীদের সাথে যে-রকম পরিচিত ছিলাম, ঘনিষ্ঠ ছিলাম।

এবং চরম আধ্যাত্ম্যবাদীদের সাথেও আমার কারো সাথেই বিরোধ হতো না। কারণ আমি কারো সাথেই বিতর্কে যেতাম না, আমি শুধু বোঝার চেষ্টা করতাম। একজন বোঝার জন্যে জানতে চাচ্ছে, না তর্ক করার জন্যে জানতে চাচ্ছে, এটা কিন্তু তার প্রশ্নের ধরন থেকেই বোঝা যায় যে সে তর্ক করতে চাচ্ছে, না বুঝতে চাচ্ছে।

এবং যার ফলে সত্যকে আমি খুব নিরপেক্ষভাবে বুঝতে পেরেছি যে সবার কথাই আমি শুনেছি, মনোযোগ দিয়ে শুনেছি, ব্যাখ্যা করেছি, বিশ্লেষণ করেছি। তারপরে যেটা সত্য বলে মনে হয়েছে, সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে, শুধু মনে হওয়া না, সেটাকে গ্রহণ করেছি।

এবং মানে বস্তুবাদের শিক্ষা মানুষকে শান্তির দিশা দিচ্ছে না, সুখের দিশা দিচ্ছে না।

যেমন, আপনি দেখেন এই যে আমেরিকাতে এখন সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে কার বই? জালালুদ্দিন রুমির বই। যারা শান্তির খোঁজ করছে এবং মেডিটেশনের সবচেয়ে জনপ্রিয় সুর হচ্ছে জালালুদ্দিন রুমি আমেরিকাতে!

কেন? বস্তু তাদেরকে শান্তি দিতে পারছে না!

এবং এখন কী হয়েছে? বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেডিটেশন কোর্স শুরু করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ বস্তু তাদেরকে শান্তি দিতে পারছে না। পণ্য তাদেরকে শান্তি দিতে পারছে না।

যে জ্ঞান জগতের পেছনের তত্ত্বের দিকে নিয়ে যায় না, সেই জ্ঞান দ্বারা মানুষের সমস্যার পূর্ণ-সমাধান সম্ভব নয়!- জিসি দেব

এবং আমরা আমরা যে বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছি, যে বাস্তবতার কথা বলছি, জিসি দেব এখন থেকে ৬০ বছর আগে এই কথাগুলো বলেছেন। কারণ তিনি একজন ক্ষণজন্মা দার্শনিক ছিলেন। দর্শন এবং জীবনের সত্যের খুব গভীরে তিনি প্রবেশ করেছিলেন। সেইজন্যেই তিনি বলতে পেরেছেন। এবং খুব তীব্র ভাষায় বলেছেন। কঠিন ভাষায় বলতে পেরেছেন।

তিনি বলেছেন যে, যে জ্ঞান মানুষকে শুধু বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচিত করে, তার অন্তরের কোনো বিশেষ খোঁজ দেয়া না। অথবা জগতের পেছনে যে এক তত্ত্ব আছে তার দিকে নিয়ে যায় না, সেই জ্ঞানের দ্বারা মানুষের জীবন সমস্যার পূর্ণ-সমাধান সম্ভব নয়।

আসলে বস্তুবাদী দর্শনের যে ভ্রান্তি এটা জিসি দেব সেই সময়, সেই সময় বস্তুবাদের বিরুদ্ধে বলার মতো মানুষ খুব কম ছিল। সেই সময় বস্তুবাদী হওয়াটা এবং ‘বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ’–এটা ছিল তখনকার সময়ের তরুণদের ফ্যাশন।

এবং আমরা সেই ফ্যাশনের বাইরে চলে গিয়েছিলাম। এবং চলে যেতে পারার কারণ হয়তো ড. জিসি দেব স্যার বলছেন, বিজ্ঞান প্রভাবিত বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থা অপূর্ণ। এই শিক্ষাব্যবস্থা আত্মকেন্দ্রিক করে তুলছে, ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের পরিপন্থী (আমরা যে কথাগুলো এখন বলছি) তাই আজ বিশ্বময় এক নৈরাশ্যকর সংঘাত-দ্বন্দ্বময় ধ্বংসমুখী অবস্থা বিদ্যমান।

ব্যক্তিকে এমন শিক্ষা দিতে হবে যেন সে তার বৃহত্তম জীবনের সাথে সমঝোতা করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। ধর্মের ঐক্যবোধ ও প্রেমের সঙ্গে বিজ্ঞানের জ্ঞানপিপাসা ও কর্ম তৎপরতার সমন্বয় প্রয়োজন। এতেই মিটবে মানুষের দেহের ক্ষুধা এবং আত্মিক ক্ষুধা।

এবং আমরা কোয়ান্টাম ৮০-র দশক থেকে সেই চেষ্টাটাই করে আসছি।

টেকনোলজির দেয়া সম্পদ ও প্রাচুর্যের ভেতর মানুষের অবস্থা আজ অনেকটা ইকারাসের মতো…

আসলে তাকে না দেখলে হয়তো মনে হতো যে না এগুলো বোধহয় গল্পই।

এবং জিসি দেব একটা উপমা ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন, গ্রিক পুরাণে পড়েছিলাম, ইটালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে গ্রিক কারিগর ডিডেলাস ও তার পুত্র ইকারাস পিঠে দুখানা পাখির পাখা গালা দিয়ে জুড়ে উড়তে শুরু করেছিলেন।

ডিডেলাস সফল হলেও, তার পুত্র ইকারাস সূর্যের খুব কাছ দিয়ে উড়তে শুরু করায় সূর্যরশ্মির তাপে গালা গলে ডানা পড়ে যায়। এবং সমুদ্রের জলে সে তলিয়ে যায়, ডুবে মারা যায়।

বিজ্ঞান এবং তার দোসর টেকনোলজির দেয়া সম্পদ ও প্রাচুর্যের ভেতর মানুষের অবস্থা আজ অনেকটা ইকারাসের মতো। বিজ্ঞানের গলা দিয়ে জুড়ে দেয়া পাখার সাহায্যে আজ মহাকাশে তার অবাধ গতি।

পৃথিবী তো তার হাতের মুঠোয় তবে বড়ই আশঙ্কার কথা, বিশ্বাস ও কর্মপ্রেরণার যে ডানা দুটো দিয়ে জীবনের প্রসারিত ক্ষেত্রে মানুষ এতকাল উড়ে বেড়াচ্ছিল, বিজ্ঞানের তাপে তা খসে পড়তে শুরু করেছে। এরই নাম সভ্য মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা।

অর্থাৎ অনেকে মনে করেন বৈজ্ঞানিক সভ্যতার প্রসারে যে সব সমস্যার সৃষ্টি, বৈজ্ঞানিক উপায় তা সমাধান সম্ভব। ছোটবেলায় পুঁথিতে পড়েছিলাম। প্লেগে আক্রান্ত একটি শহরের লোকেরা মহামারির প্রতিকার খুঁজে না পেয়ে মদের নেশায় মত্ত থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল।

বৈজ্ঞানিক সভ্যতার ব্যাপক ধ্বংসমুখী গতিকে যারা হেসে উড়িয়ে দিতে চান তারাও হয়তো এই নেশাখোরদের দলে। বিজ্ঞানের দেয়া জ্ঞান খুবই ভালো, এমন সুখের সম্ভাবনা বিজ্ঞান আমাদের সামনে ধরেছে যা অতীত যুগে মানুষ কল্পনাও করতে পারত না।

কিন্তু আমাদের এমনই কপাল বিজ্ঞান আমাদের শুধু শিখিয়েছে আমরা একজন আরেকজনের থেকে আলাদা। একজনের স্বার্থ আরেকজনের স্বার্থ থেকে আলাদা। সকলে আমরা পরের তরে, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। এই নীতির পেছনে যে আত্মিক যোগ বিজ্ঞান তা আমাদের দেখাতে পারে নি।

বস্তুবাদ এক বস্তুকে আরেক বস্তু থেকে আলাদা ভাবতে শেখায়। তার মূলে যে কোনো ঐক্য আছে একথা স্বীকার করে না। এখানেই বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের অপূর্ণতা। এখানেই বিজ্ঞানের পরাভব।

আসলে ‘বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ’ এখন নাইও। বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ এই একটি কারণে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সেটা হচ্ছে তার এই আত্মিক শূন্যতা।

জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পালন করছেন অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণের কথা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা…

জিসি দেব বলছেন, এজন্যে চাই বিজ্ঞানের সাথে ধর্মবোধের মিলন। যার মূলকথা বিশ্বের ঐক্য, মানুষের ঐক্য। এই একত্ববোধে উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে শুধু বৈজ্ঞানিক জ্ঞান মানুষকে ব্যাপক ধ্বংসের পথেই নিয়ে যাবে।

ম্যাক্সিম গোর্কি তার এক গল্পে বলেছেন, বিজ্ঞান আমাদের পাখার ন্যায় অবাধ গতিতে মহাকাশে উড়তে শিখিয়েছে, মাছের মতো জলে সাঁতার কাটতে শিখিয়েছে। কিন্তু পৃথিবীতে শান্তিতে বাঁচতে শেখায় নি। বিজ্ঞান অন্যের মুখের ভাষা বুঝবার ক্ষমতা মানুষকে দিয়েছে সত্যি। প্রাণের ভাষা বোঝার ক্ষমতা দেয় নি। এটা বিজ্ঞানের দোষ নয়।

সত্যিকার ধর্মীয়বোধ থেকে সৃষ্ট সঠিক প্রেমের অভাবে দেশে দেশে জাতে জাতে মানবগোষ্ঠীতে আজ যে এত রেষারেষি, এত আত্মঘাতী কলহ সংঘর্ষ, ধর্ম ও বিজ্ঞানের মিলনের ভেতরেই জগতের জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের বাঁচার ও সার্থক জীবনযাত্রার অব্যর্থ সংকেত।

বিজ্ঞানের মাহাত্ম্য যদিও অপরিসীম, তথাপি বিজ্ঞান মানুষকে সার্থক ও সফল জীবনদর্শনের ইঙ্গিত দিতে পারে নি। জীবনের সামগ্রিক প্রয়োজন মেটানোর জন্যেই বৈজ্ঞানিক জড়বাদ ও প্রাচীন আধ্যাত্মবাদের সমন্বয় প্রয়োজন।

এবং ধর্মের সার্থকতা বোঝাতে গিয়ে জিসি দেব লিখছেন, সব ধর্মই আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে মানুষের ঐহ্যিক ও পারলৌকিক কল্যাণ। ধর্মের এই উদারভাব ভুলে গিয়ে প্রচারকরা যখন ছোট ছোট দল বাঁধার চেষ্টা শুরু করলেন তখন থেকেই ধর্মের আসল রূপ বিকৃত হয়ে পড়ল।

ধর্ম হয়ে গেল কুসংস্কারের এক পুটলি ও শোষণের এক বড় হাতিয়ার। তার ফলে হলো ধর্মের নামে কত নির্যাতন, কত যুদ্ধবিগ্রহ, কত নরহত্যা। আর পরকালের প্রলোভন দেখিয়ে কত মানুষকে ইহজীবনের সুখ-সুবিধা থেকে করা হলো বঞ্চিত। ধর্মের সার্থকতা জীবনযাত্রায়, চরিত্রের মাধুর্যে। ধর্মের আসল কথা বিশ্বের বিশেষত মানুষের ঐক্য।

এই মানুষের ঐক্যের কথা, এই অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণের কথা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা জিসি দেব নিজে পালন করেছেন এবং এই কথা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বলেছেন।

তো আমরা জিসি দেবের প্রতি এবং সেই সাথে হানাদার বাহিনীর হাতে শহিদ হওয়া সকল বুদ্ধিজীবী, সকল মানুষ তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

[সজ্ঞা জালালি, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০]

শেয়ার করুন

এই শাখার আরো সংবাদ পড়ুন
All rights reserved © RMGBDNEWS24.COM
Translate »