ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। আর এবারের ডিসেম্বর বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তির মাস।
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে পরম করুণাময়ের কাছে আমরা আমাদের গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সবটাই তাঁর দয়া তাঁর করুণা।
পৃথিবীর ইতিহাসে এত অল্পসময়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে কোনো জাতি স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে নি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে পুরো জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এবং পরম করুণাময়ের অনুগ্রহে ন’মাসের মধ্যেই স্বাধীনতার বিজয়চেতন তারা ওড়াতে সক্ষম হয়েছিল।
স্বাধীনতা সংগ্রামে সকল শহিদ ও বীরদের প্রতি আমরা আমাদের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সংগ্রামে তরুণদের ভূমিকা তরুণদের সাহসিকতা আমাদের বীরত্বের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে সবসময় জ্বলজ্বল করবে।
মাকে না জানিয়ে স্বাধীনতার জন্যে একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্যে তারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। দেশ ও মাতৃকার জন্যে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিলেন।
তারা প্রাণ দিয়েছিলেন বলেই আজকে স্বাধীন জাতি হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে আমরা আমাদের অবস্থানকে সগৌরবে সংহত করতে পেরেছিলাম।
তাদের জীবনে লক্ষ্য একটিই ছিল- দেশকে দেশের মানুষকে দেশের সংস্কৃতিকে মানবতাকে সমুন্নত রাখতে হবে।
এই যুবকদের মধ্যে তরুণদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক কিশোর অংশ নিয়েছিলেন।
আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিকালে পূর্তিলগ্নে সেই তরুণদের উত্তরসূরিদের একটি অংশই যখন মহৎ লক্ষ্যের জন্যে প্রাণদান নয় এবং তুচ্ছ বিষয়ের জন্যে বা অকারণ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তখন প্রতিটি সচেতন হৃদয় ব্যথা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
তরুণরা সত্যের জন্যে কল্যাণের জন্যে শান্তির জন্যে সম্প্রীতির জন্যে প্রাণদান করলে মন যেরকম কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে তেমনি তাদের আত্মহত্যার কথা শুনলে বা তাদের সহিংসতায় অংশগ্রহণের কথা শুনলে মন স্বাভাবিকভাবেই ব্যথায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
এর মধ্যে সংবাদপত্রে দেখলাম একটি খবর সখিপুর টাঙ্গাইলের।
সকাল পৌনে ন’টায় এসএসসি পরীক্ষার্থী মেয়েকে নিয়ে টাঙ্গাইলের সখিপুর পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ে কেন্দ্রে যান সালমা বেগম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে খবর পেয়ে সালমা বেগম বাড়িতে ফিরে এসে দেখেন তার একমাত্র ছেলের লাশ ঝুলছে।
ছেলের নাম আশিক আহমেদ। বয়স ১৩। সে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
সালমা বেগমের স্বামী মালয়েশিয়া প্রবাসী। সালমা বেগম দুই সন্তানকে নিয়ে গ্রামে থাকেন।
সালমা বেগম জানান, আশিক বেশিরভাগ সময় তার মুঠোফোন নিয়ে গেমস খেলত। আজ সকালে মেয়েকে পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার সময় আশিক মায়ের মুঠোফোনটি বাসায় রেখে যাওয়ার জন্য বায়না ধরে।
কিন্তু তিনি ফোন নিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে চলে আসেন। তিনি বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আশিককে কান্না করতে দেখেছিলেন।
কিছুক্ষণ পর আশিকের দাদি ঘরে দেখেন গলায় ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় আশিকের লাশ ঝুলে আছে।
পরে স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে।
আশিকের স্বজনেরা ধারণা করছেন, মায়ের কাছে মুঠোফোন না পেয়ে আশিক ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে!
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য মুঠোফোন ও গেমস এক ধরনের নেশা।
মুঠোফোনের নেশায় আসক্ত হয়ে অনেক কিশোর–কিশোরীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।
আসলে তুচ্ছ কারণে গত ছয়মাসে ৭৩৯১ জন আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যাকারীদের ২৫ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের কম।
মোবাইল কিনে না দেওয়া বা মা-বাবা বকাঝকা করলেও আত্মহত্যা করছে কিশোর বয়সীরা।
১৮ বছর বয়সী জয়চন্দ্র দাস নামে এক কিশোর বাবার কাছে মোবাইল ফোন চায়। কিনে না দেয়ায় আত্মহত্যা করে জয়চন্দ্র।
একইভাবে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়িতে মোবাইল ফোন কিনে না দেয়ায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে অটোভ্যান চালকের ছেলে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র আপন মিয়া। বয়স ১০ বছর।
মা বকা দেয়ায় রাজধানী যাত্রাবাড়িতে আত্মহত্যা করে মাদ্রাসা ছাত্র তরিকুল। বয়স ১৬।
মোবাইল ফোন কিনে না দেয়ায় আত্মহত্যা করে কলেজ ছাত্রী ছাবেকুন নাহার জেবিন। বয়স ১৭।
মেয়ের অতিরিক্ত মোবাইল আসক্তির কারণে মা বকা দেয়ায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে এসএসসি পরীক্ষার্থী ফাতেমা আক্তার।
মোবাইল কিনে না দেওয়া, সামান্য বকাঝকা এসব তুচ্ছ কারণে কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে।
শুধু কিশোর-কিশোরী নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে।
গত আড়াই মাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
প্রিয় সুহৃদ! কিশোর-তরুণদের আত্মহত্যা ও সহিংসতা দুটোর পেছনেই যেসব কারণ আছে তার মধ্যে মিল আছে।
প্রথমত, পরিবার বিচ্ছিন্নতা।
একটি শিশু এখন পরিবারের অংশ হিসেবে বেড়ে উঠছে না।
পরিবারের বাবা বা মা কারো কাছ থেকেই সে প্রয়োজনীয় মনোযোগ পাচ্ছে না। সে দামি খেলনা পাচ্ছে মোবাইল পাচ্ছে। বিলাসী পণ্য যা চাচ্ছে অনেক সময় সবই পাচ্ছে। যা পাচ্ছে না তা হলো মা-বাবার প্রয়োজনীয় মনোযোগ। সন্তান কার সাথে মিশছে অনেক মা-বাবাই সে খবর রাখেন না।
দ্বিতীয়ত, সমাজে করোনাকালে কিছু বড়সড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। অনেক কিছু প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে গেছে।
ফেসবুক টিকটক ইনস্টাগ্রামজাতীয় প্লাটফর্মে আপত্তিকর হয়রানিমূলক কমেন্ট কিশোর-কিশোরীদের বিষণ্ন কিংবা সহিংস করে তুলছে।
তৃতীয়ত, সমাজে ভোগ-বিলাসিতা ও পণ্যাসক্তি বেড়ে গেছে।
মা-বাবা অর্থ উপার্জনে যেরকম ব্যস্ত, বিলাসীপণ্য সংগ্রহে ব্যস্ত। তেমনি সন্তানকেও ভালো মানুষ নয়, বিত্তশালী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে তারা বেশি আগ্রহী। এবং তারই চড়া খেসারত এখন সমাজ দিচ্ছে।
চতুর্থত, স্কুল-কলেজে বিনয় শিষ্টাচার নৈতিক শিক্ষার ওপর এখন গুরুত্ব দেয়া হয় না। গ্রেড কিংবা নাম্বারই শিক্ষার শেষ কথা।
পঞ্চমত, কিশোর তরুণদের সামনে এমন কোনো রোল মডেল নেই যাকে সে অনুসরণ করবে। এমন কোনো মানুষ তার সামনে নেই যার জীবনে একটি আদর্শ আছে। যে শুধু নিজের জন্যে কাজ করে না। অর্থ গ্ল্যামার ক্ষমতার জন্যে দিশেহারা হয় না। বরং মানুষের কল্যাণের জন্যে সমাজের কল্যাণের জন্যে দেশের মঙ্গলের জন্যে কাজ করে।
সর্বোপরি করোনার প্রভাবে দীর্ঘসময় ঘরবন্দি থাকায় নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে কিশোর ও তরুণরা।
যারা স্কুল কলেজে পড়ছে তারা আগ্রহ পাচ্ছে না। অবসন্ন। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করবে তারা হতাশ শঙ্কিত। বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক চাপ সইতে না পেরে অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সত্যিকারভাবে মূল্যায়িত হতে না পারার জন্যে হতাশ হয়ে জীবন থেকে চলে যাচ্ছে চিরতরে।
এমনি এক তরুণ মাসুদ আল মাহাদী অপু।
তার শিক্ষক লিখেছেন- সত্যিকার মেধাবী ছাত্র ছিল সে। ফলাফলও ভালো করত। তবে গতানুগতিক ভালো ফলাফল করাদের মতো সে ক্লাসে খুব নিয়মিত ছিল না। সে প্রশ্ন করত প্রতিবাদ করত।
অনার্সে সে থার্ড হয়েছিল। অনার্সের রেজাল্টের পর একদিন অপুকে বললাম, মাস্টার্সের এক বছর বাড়তি একটু মনোযোগ দিলেই তুমি প্রথম হতে পারবে।
সে বলল, আমি তো প্রথমই হতাম অনার্সে। হিসাব করে দেখেছি একজন মাত্র শিক্ষক সেই প্রথম বর্ষ থেকে যে পরিমাণ কম নম্বর দিয়ে আসছেন ওনার কোর্সে এভারেজ নম্বর পেলেই প্রথম হতাম।
অপুর আত্মহত্যার পেছনে সিস্টেমের দায় নিয়ে তিনি আরো লিখেছেন, অপু আত্মহত্যা করেছে শুনছি। সিস্টেম কীভাবে প্রখর এক তরুণকে এদিকে ঠেলে দিতে পারে তার একটি মাত্র উদাহরণ দিলাম।
যেসব শিক্ষার্থী নিজে চিন্তা করত, প্রশ্ন করত ঐ শিক্ষক সাধারণত তাদের অপছন্দ করেন এবং বেছে বেছে ভিক্টিমাইজ করেন।
তিনি আবার সব ধরনের ভিসির প্রিয়পাত্র থাকেন। ফলে তিনি এসব করে পারও পেয়ে যান।
স্নাতকোত্তর শেষে অপু সরকারি চাকরির পরীক্ষায় প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন। বছরখানেকের অক্লান্ত প্রস্তুতির পর সফলতা না পেয়ে হতাশার কাছে হার স্বীকার করে নেন।
২৭শে সেপ্টেম্বর মাসুদ আল মাহাদী অপু ২৬ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিস এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পরীক্ষা ছিল তার জীবনের শেষ চাকরি পরীক্ষা।
১৮ই নভেম্বর বিএসইসির ভাইবা বোর্ডে উপস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক খেয়াল করলেন, যে ছেলেটি এমসিকিউ ও রিটেন পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে সে ভাইবা দিতে আসে নি।
তিনি সংশ্লিষ্টদের বললেন, ঐ নিয়োগপ্রার্থীকে ফোন দিতে। তারা জানায়, ছেলেটা গত মাসে মারা গেছে। তিনি তালিকার নামটা ভালোভাবে পড়ে দেখলেন। ছেলেটার নাম মাসুদ আল মাহদী অপু তার প্রিয় ছাত্রদের একজন।
তার এক বন্ধু বলে, অনেকগুলো চাকরির পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে উত্তীর্ণ হলেও সেগুলো দীর্ঘসূত্রিতার কবলে পড়ে।
পরিবারের অবস্থা দেশের অবস্থা নিয়েও চিন্তিত থাকত অপু। এসব হতাশা আত্মহত্যায় ভূমিকা রাখতে পারে।