হযরত মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ (রহ.) ছিলেন আপাদমস্তক একজন খাঁটি আল্লাহর অলি। বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী এক আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট।
নিষ্কলুষ, নির্ভেজাল, পরোপকারী এবং একজন পরিপূর্ণ আশেকে রাসুল (স.)। ছিলেন জামানার শ্রেষ্ঠ আওলিয়া। শতাব্দীর মোজাদ্দেদ। একজন কামেলে মোকাম্মেল পীর ও মোর্শেদ। পীর-আওলিয়া সম্পর্কে যারা নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতো, আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর সান্নিধ্যে গেলে তাদের ধারণা পাল্টে যেতো এবং তাঁর নিকট বাইআত হওয়ার জন্য অনেকে ব্যাকুল হয়ে পড়তো।
রসুলুল্লাহ হযরত মোহাম্মদ (স.) এর পরিপূর্ণ সুন্নত ফুটে উঠতো তাঁর কথা-বার্তা, চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে সমস্ত কার্যকলাপে। তাঁর ভক্তদের কাছে তিনি ছিলেন স্পর্শমনিতুল্য। তাঁর প্রেমের স্পর্শেই সকলের অন্তরে জ্বলে ওঠে আল্লাহর প্রেমের নুরানি প্রদীপ।
হযরত মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ (রহ:)। জন্ম ১৯৫০ সালের ৭ই মার্চ মাতামহালয় নিশশা পলাশবাড়ি গ্রামে। দিনাজপুর জেলার বিরামপুরের কাছাকাছি শিমুলতলী গ্রামে—পিত্রালয়ে বেড়ে ওঠেছেন তিনি। স্কুল, কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে। মহান মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর ছিলো সক্রিয় অংশগ্রহণ। ছিলেন একজন সম্মুখ সারির বীর মুক্তিযোদ্ধা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে হযরত হাকিম আব্দুল হাকিম (রহ.) নামে একজন রহস্যময় আধ্যাত্মিক পুরুষের সন্ধান পান তিনি। তাঁর সান্নিধ্যে সেই থেকে যাত্রা শুরু হয় অনন্তের পথে, যেই পথ প্রেমের। অবিশ্বাস আর অপ্রেমের শৃঙ্খলে বন্দি মানবতার মুক্তির নিশানবাহী প্রাণপুরুষ যারা যুগে যুগে আলো জ্বালিয়ে গিয়েছেন মানুষের অন্তরে, তাঁদেরই অধস্তন রুহানি পুরুষ তিনি।
হযরত হাকিম আব্দুল হাকিম (রহ.) এর নিকট থেকে খেলাফত লাভ করেন বর্তমান জামানার সবচেয়ে সহজ, শ্রেষ্ঠ এবং যুগোপযোগী তরিকা “তরিকায়ে খাস মোজাদ্দেদিয়া” এর প্রবাহপুরুষ হিসেবে। যেই সিলসিলার নেসবত শুরু হয়েছে ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) থেকে শুরু করে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মোজাদ্দেদ হযরত মোজাদ্দেদে আলফেসানি শায়েখ আহমদ ফারুকি সেরহিন্দি (রহ.) এর মাধ্যমে।
হযরত মোহাম্মদ মামুনর রশীদ (রহ.) পরবর্তীতে ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের ভূঁইগড়ে প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর খানকা শরিফ ‘হাকিমাবাদ খানকায়ে মোজাদ্দেদিয়া’। পেশায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অডিট কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু মানুষের অন্তরে শুদ্ধতার আলো জ্বালাবার কাজটিই ছিলো তাঁর প্রধানতম দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি ছুটে চলেছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। পথহারা আত্মভোলা মানুষদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন সঠিক পথের ঠিকানা।
একজন জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি হয়েও তিনি ইসলামের শরীয়ত এবং তাসাউফের বিভিন্ন বিষয়ে যে পাণ্ডিত্য ও গভীর জ্ঞানের স্বাক্ষর রেখেছেন, তা দেখে মাদ্রাসায় পড়ুয়া অনেক বড়ো আলেম ওলামাগণ অবাক হয়ে যেতেন। ওনার জ্ঞানের কাছে তাদের অর্জিত বিদ্যা, বুদ্ধি এবং জ্ঞানের বিশাল পার্থক্য সহজেই ধরা পড়তো। তাঁর সাথে যত আলেম ওলামার সাক্ষাৎ ঘটতো, এক বাক্যে সকলে তাঁর বিদ্যা, বুদ্ধি ও জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিতেন। কোরআন, হাদিস, ফিকাহ, তাফসিরসহ ইসলামের যাবতীয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে তিনি গভীর জ্ঞান রাখতেন। এটা আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত তাঁর এক বিশাল কারামত।
নিভৃতচারী এই মহাপুরুষ একাধারে ছিলেন একজন কবি, সাহিত্যিক, ইসলামের পথপ্রদর্শক, পীর ও মোর্শেদ। প্রথাগত কবিদের মতো রাশি রাশি কবিতা লিখেননি তিনি। লিখেছেন ছয়টি কাব্যগ্রন্থ। আধ্যাত্মিকতাও যে আধুনিক কবিতার বিষয়বস্তু হতে পারে, সেটাই তিনি অপরূপ শব্দশৈলী আর চমৎকার উপমার আড়ালে নান্দনিকতার অসাধারণ নৈপুণ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন।
ইসলাম এবং আধ্যাত্মিকতার বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ষাটের অধিক। কাজী ছানাউল্লাহ পানিপথী (র.) রচিত বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ ‘তাফসীরে মাযহারী’র বঙ্গানুবাদ রচিত হয় তাঁরই সম্পাদনায়। এছাড়াও শায়েখ আব্দুল হক মোহাদ্দেসে দেহলভী (র.) রচিত সর্বজনবিদিত হযরত মোহাম্মদ (স.) এর অমর জীবনীগ্রন্থ ‘মাদারেজুন নবুওয়াত’-এরও বঙ্গানুবাদ সম্পাদনা করেন তিনি।
তিনি বলেন, জিকির মানে স্মরণ করা। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করাই হল আল্লাহর জিকির। এর জন্য শব্দ করে উচ্চারণের প্রয়োজন নেই। জিকিরের সুষ্ঠু এবং সঠিক দিকনির্দেশনায় রচনা করেন ‘আল্লাহর জিকির’ নামক অতি অমূল্য গ্রন্থ।
বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে ভণ্ড পীরদের দরবার। চিৎকার চেঁচামেচি করে জিকির করা, নাচ, গান, লম্ফঝম্প থেকে শুরু করে সমস্ত অনৈসলামিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে আছে বাংলাদেশের অধিকাংশ পীর নামধারী ভণ্ড সূফিগণ। এ সকল ভণ্ড পীরদের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা উচ্চকণ্ঠী ছিলেন। এছাড়া বর্তমান জামানায় ইসলামের নামে সবচেয়ে বড়ো ফেৎনা সৃষ্টিকারী দল মওদুদীবাদী জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে তিনিই সর্বপ্রথম আওয়াজ তোলেন এবং বক্তৃতা-বিবৃতি ও লেখনির মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সতর্ক করেন।
বাংলাদেশে একমাত্র পরিপূর্ণ সুন্নতের অনুসরণ হয় তাঁর প্রতিষ্ঠিত দরবার শরিফে। কোনো ধরনের বিদাআতকে তিনি কখনোই প্রশ্রয় দেননি। তাঁর দরবারে উচ্চৈঃস্বরে জিকির নিষিদ্ধ। তাঁর অনুসারীদের তিনি কলবী জিকির (মনে মনে জিকির) এর শিক্ষা দেন। রসুলুল্লাহ হযরত মোহাম্মদ (স.) এর পরিপূর্ণ সুন্নতের অনুসরণ তার খানকা শরিফে এখনো বিদ্যমান। হাকিমাবাদ খানকা শরিফে কেউ একবার গেলে সেটা স্বচক্ষেই প্রমাণ মেলে সহজে।
তিনি বলেন, ভালোবাসা-ই একমাত্র অস্ত্র, যে অস্ত্রের আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া যায় সকল প্রতিকূল পরাশক্তি। তাঁর মতে, ইসলাম হচ্ছে ভালোবাসার ধর্ম। ভালোবেসেই মানুষকে কাছে টানতে হবে, জোরজবরদস্তি ইসলামে নিষিদ্ধ। ভালোবাসতে হবে মানুষকে, মানুষের স্রষ্টাকে। সেই ভালোবাসাও হতে হবে পূর্ণ, পঙ্কিলতা-বিবর্জিত। আমৃত্যু তিনি তাঁর অনুসারীদের পবিত্র, পরিশুদ্ধ এবং পরিপূর্ণ ভালোবাসার শিক্ষা-ই দিয়ে গেছেন।
অমুসলমানদের প্রতিও তিনি ভালোবাসা পোষণ করে ইসলামের দাওয়াত দিতেন, যেমনভাবে আমাদের রসুলুল্লাহ হযরত মোহাম্মদ (স.) বিধর্মীদের প্রতি ভালোবাসা দেখাতেন। তাঁর কথায়, কাজে, চিন্তায় ছিলো কেবল রসুলুল্লাহ হযরত মোহাম্মদ (স.) এর পুরোপুরি অনুসরণ। বিশ্বের সমস্ত অমুসলিমদের প্রতি ছিলো তাঁর অশেষ মায়া-মমতা এবং দরদ। তারা সত্য পথ চিনে না বলেই বিভ্রান্তিতে পড়ে আছে। এ জন্য তাদের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ পোষণ করার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। তারাও তো আল্লাহর বান্দা এবং রসুল হযরত মোহাম্মদ (স.) এর উম্মত। তারা কীভাবে সত্য পথের সন্ধান পাবে এবং ইসলামের সুশীতল ছায়ায় এসে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে শান্তিময় জান্নাতে প্রবেশ করবে, এ চিন্তায় তিনি সর্বদা ব্যস্ত ছিলেন। এ জন্য তিনি কম্বোডিয়া, ইংল্যান্ড, স্পেনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন অমুসলিমদের সত্য পথে ফিরে আসার আহ্বান জানানোর জন্য।
ভালোবাসার দ্বারাই তিনি মানুষকে কাছে টেনেছেন। তাঁর ভালোবাসার টানে মোহিত হয়েছেন কবি সৈয়দ আলী আহসান, আহমদ ছফা, আসাদ চৌধুরী এবং জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদসহ আরও বিখ্যাত কবিসাহিত্যিকগণ। তাঁদের কাছে তিনি ছিলেন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। কবি সৈয়দ আলী আহসান বলেন, “আমি হযরত মামুনুর রশীদের হস্তস্পর্শ করে নিজেকে নির্ভাবনাময় ও নিশ্চিন্ত করবার চেষ্টা করছি।”
সেই আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ হযরত মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ (র.) জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ভারতের কলকাতায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩শে মে, ২০১৬ তারিখে অগণিত ভক্ত ও অনুসারীদের এতিম করে ইহলোক ত্যাগ করেন।
আজ ৭ই মার্চ। মহান মোর্শেদ হযরত মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ (রহ.) এর ৭৩তম মোবারক জন্মবার্ষিক। আল্লাহ তায়ালা জামানার শ্রেষ্ঠ এই মহামানবকে জান্নাতের অতি উচ্চতর মাকামে অধিষ্ঠিত করুন এবং তাঁর অসিলায় আমাদের মতো পাপীদের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে তাঁর শেখানো প্রেমের পথে আমৃত্যু চলার তওফিক দান করুন। আমিন।
হযরত মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ (রহ.) সম্পর্কে আরও জানতে এবং তাঁর লিখিত সমস্ত কিতাবের পিডিএফ ও ওয়াজ মাহফিলের অডিও পেতে ভিজিট করুন
www.hakimabad.com এই লিংকে।
– আলি হাসান বাবু