পদ্মাসেতু শুধু একটি সেতু নয়! জাতির আত্মবিশ্বাসের প্রতীক!
পুরো জাতির আনন্দের সাথে আমরাও একইভাবে আনন্দিত। আসলে পদ্মাসেতু শুধু একটি সেতু নয়! পদ্মাসেতু হচ্ছে জাতির আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।
পদ্মাসেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে আমরা বিনয় ও প্রত্যয়ের সাথে বলতে পারি আমরা চাইলে বিশ্বাস নিয়ে লেগে থাকতে পারি। আমরা চাইলে যে-কোনো কারিগরি চ্যালেঞ্জকে সফলভাবে জয় করতে পারি। কারণ আমাদের মস্তিষ্ক জেনেটিক্যালিই সেরা মস্তিষ্ক!
জাতির এই অর্জনের আনন্দক্ষণে পদ্মাসেতুর নির্মাণে সাহসী ও অনঢ় ভূমিকা রাখার জন্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সেতু নির্মাণের সাথে জড়িত সবাইকে আমরা আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।
আসলে পদ্মাসেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে জাতির মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে আপাতদৃষ্টিতে যে-কোনো অসম্ভবকে সম্ভব করার বিশ্বাস! এখন আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ইনশাল্লাহ সবই সম্ভব!
প্রিয় সুহৃদ! আমাদের এই অর্জনের পাশাপাশি আরেক দূর্যোগ সফলভাবে মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিতে হবে।
দেশের এক বিশাল অঞ্চল এখন বন্যায় প্লাবিত। সিলেটের যে উঁচু অঞ্চলে কখনো বন্যার পানি ওঠে নি সে অঞ্চলও পাহাড়ি ঢলও বর্ষণে ডুবে গেছে। রাতে ঘুমোনোর সময় সব ঠিক ছিল। অনেকের ঘুম ভেঙেছে বিছানায় পানি ওঠার পর।
অকস্মাৎ বন্যায় লক্ষ লক্ষ মানুষের মতো আমাদের শত শত সদস্যও বন্যা আক্রান্ত হয়েছেন। তারা পরিবারকে নিরাপদ সরিয়ে সাথে সাথে নেমে পড়েছেন বিপন্নদের নিরাপদ স্থানে সরতে, সহায়তা করার জন্যে।
শুধু আমাদের কর্মীরা নয়! বহু মানুষ বিপন্নদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আসলে বিপন্নদের পাশে দাঁড়ানো, এটাই আমাদের জাতিসত্তার সবচেয়ে বড় গুণ। আমাদের জাতিসত্তার সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে হৃদয় ভরা টান। হৃদয় ভরা মমতা পরিবারের জন্যে, প্রতিবেশীর জন্যে, পাড়াবাসীর জন্যে, গ্রামবাসীর জন্যে, দেশবাসীর জন্যে।
এবং এই হৃদয় ভরা টানের ফলে আমরা যে-কোনো দূর্যোগ মোকাবেলায় পৃথিবীর সবচেয়ে সফলজাতি।
প্রিয় সুহৃদ! অর্জনের এই আনন্দক্ষণে বন্যার্তদের কথা আমাদের বিশেষভাবে ভাবতে হবে।
এখন তো অনেকেই বন্যার্তদের সাহায্যে নেমেছেন। অনেক দান আসবে। কিন্তু আসল কাজ শুরু হবে যখন বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে যাবে। পুনর্বাসনের আসল কাজ শুরু হবে তখনই।
বরাবরের মতো আমরাও যাতে এই পুনর্বাসনকাজে ভালোভাবে অংশ নিতে পারি সেজন্যে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। তাই ঈদের খরচ কমিয়ে আমাদের প্রত্যেকেরই উচিৎ হবে বন্যার্তদের পুনর্বাসনের রিলিফফান্ডে সেই অর্থ দান করা।
বন্যার্তদের জন্যে দান করাও, দান সংগ্রহ করা নিঃসন্দেহে সমান সওয়াবের সমান পুণ্যের। এবং অন্যন্যবারের মতো আমরাও ইনশাল্লাহ এই পুনর্বাসন কাজে সাধ্যমতো অগ্রগামী থাকব।
প্রিয় সুহৃদ! শুধু বন্যা নয় যে-কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় আমরা সবচেয়ে সক্ষমজাতি। সাথে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, জ্বরাব্যাধি, সংক্রামক রোগ মোকাবেলা করে আমরা আমাদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে গড়ে তুলেছি হাজার বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে।
অতএব প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, জ্বরাব্যাধি, সংক্রামক রোগ, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এগুলো আমরা অনায়েসেই মোকাবেলা করতে পারব।
কিন্তু আমাদের সামনে যে মহামারি আসতে যাচ্ছে সেটার মোকাবেলায় এখন থেকেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ এই মহামারি মোকাবেলার কোনো অভিজ্ঞতা অতীতে আমাদের ছিল না। কারণ এই মহামারিতে আমরা কখনো আক্রান্ত হই নি।
অতএব আমাদের সতর্কতাই এই মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে প্রধান কারক হিসেবে কাজ করবে। এই মহামারি হচ্ছে একাকিত্বের মহামারি, নিঃসঙ্গতার মহামারি।
সাম্প্রতিক একটি ঘটনা নিয়ে আমরা আমাদের আলোচনার সূত্রপাত করতে পারি।
গত মাসের ঘটনা। ঢাকায় একটি বহুতল ভবনের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে এক তরুণী। সে ঐ ভবনেই তার বাবা-মা ও ছোট ভাইয়ের সাথে থাকত। তরুণীটি ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তার বাবা একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা।
আত্মহত্যার দিন বিকেলে সে ছাদে ওঠে। বৃষ্টির মধ্যে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে। তারপর পলিথিনে মোবাইল ফোন ও একটি চিরকুট ঢুকিয়ে ১৬ তলার ওপর থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে। সেখানেই মারা যায়।
তার সুইসাইড নোটে লেখাছিল, “আমার জীবন একটা ব্যর্থ জীবন। না পারলাম বাবা-মাকে খুশি করতে। না পারলাম অন্য কাউকে খুশি করতে।
একটা ঘটনা জানার পরও যখন কেউ চুপ করে থাকে তখন সত্যিই সবকিছু অর্থহীন মনে হয়। আমি গেলে কিছু আসবে যাবে না, আমি জানি। Because every person is replaceable. আমরা কাদেরকে ভালোবাসি তারা সেটা জানে। কে বেশি কষ্ট পাবে সেটাও জানি। But nothing makes sense anymore. Now tell me how much a person can take.”
তার সহপাঠীরা বলছে, সে প্রায়ই একা থাকত ও হতাশাগ্রস্ত ছিল। এই একাকিত্ব থেকে তৈরি মানসিকচাপ সইতে না পেরে তরুণীটি আত্মহননের পথ বেছে নেয়। সম্ভাবনাময় একটি জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত সমাপ্তি ঘটে।
এটি দেশের একটি ঘটনা। এই ঘটনাটির এক সপ্তাহ আগে পৃথিবীর অপর প্রান্তে টেক্সাসে হৃদয় বিদারক আরেকটি ঘটনা ঘটে।
অটোম্যাটিক রাইফেল হাতে স্কুলে ঢুকে এক বন্দুকধারী ১৯ জন শিশুও একজন শিক্ষিকাকে গুলি করে হত্যা করে। নিহত শিশুদের সবাই দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। হত্যাকারী রামোসের বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর।
পরে জানা যায়, এই হত্যাকান্ডের আগে তার নামে অপরাধের কোনো রেকর্ড পুলিশের কাছে ছিল না।
বয়স ১৮ হওয়ার পর প্রথম যে কাজটি সে করেছিল তাহলো, বৈধভাবে অস্ত্র ও প্রচুর বুলেট কিনেছিল। আমাদের দেশে দোকান থেকে বিস্কিটকে কেনা যেমন সহজ আমেরিকায় বন্দুক গুলি কেনাও ততটাই সহজ। যে-কারণে ২০২০ সালে আমেরিকায় ৪৫,২২২ জন মানুষ বন্দুকের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে।
আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, ১৮ বছরের তরুণ রামোস কেন নির্বিচারভাবে শিশুদের হত্যা করলো? এই প্রতিহিংসার উৎস কোথায়? জন্মগতভাবে তো কেউ খুনি হয় না অপরাধী হয় না। তাহলে এমন কেন ঘটল?
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন বলছে, শৈশব থেকে রামোস পোটলা ছিল। স্কুলে তার সহপাঠীরা তাকে এটা নিয়ে ক্ষ্যাপাত। রামোসের এক সহপাঠী জানায়, সে ছিল খুব লাজুক প্রকৃতির ছেলে।
যখন সহপাঠীদের হাতে চরম বুলিংয়ের শিকার হলো সে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করল। স্কুলে যেতে চাইত না। কারো সাথে মিশত না।
এক পর্যায়ে সে সোশাল মিডিয়ায় আশ্রয় নিল। অনলাইনে বন্ধু খুঁজতে থাকল। অনলাইনেও সে বুলিংয়ের শিকার হলো। এবং তখন নিজেও অনলাইনে অন্যদের বুলিং করত। হুমকি দিত। তার বাবা-মা’র সম্পর্ক ভালো ছিল না। তার মা ছিল মাদকাসক্ত। এটা নিয়েও সে ডিপ্রেসড থাকত।
পারিবারিক সমস্যা ও বুলিং তাকে নিঃসঙ্গ বেপরোয়া ও প্রতিহিংসা পরায়ণ করে তোলে। আর এর খেসারত দিল কোমলমতি ১৯টি শিশু ও একজন শিক্ষিকা এবং তাদের পরিবার।
দুটি ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন মনে হতে পারে, কিন্তু যদি ঘটনার গভীরে ডুবে যান, দেখবেন যোগসূত্রটা খুব স্পষ্ট। একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা ঢাকার তরুণীটিকে ঠেলে দিয়েছে বিষণ্ণতা ও আত্মহননের দিকে।
এই একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতাই মার্কিন তরুণটিকে প্রতিশোধ পরায়ণ অমানুষ করে তুলেছে।
এক সময় ধারণা করা হতো, নিঃসঙ্গতা বৃদ্ধ বয়সের সমস্যা। পেশাগত বা গৃহস্থলি কাজ থেকে অবসর নেয়ার পর বৃদ্ধ বয়সে মানুষ নিঃসঙ্গতায় ভোগে।
এবং অনেক সমাজে একটা বয়সের পরে বয়স্করা নিজের পরিবার থেকে দূরে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতেন। তারা ধ্যান মোরাকাবা বা ধর্মকর্ম বা ধর্মীয় আচার এর মধ্যে ডুবে যেতেন। এবং এর মধ্যেই তারা জীবনের একটা অন্য অর্থ, একটা আনন্দ খুঁজে পেতেন।
কারণ নির্জন বাস করলেও তারা আপনজনের মায়া মমতা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। আসলে সেই অর্থে একা থাকলেও তারা নিঃসঙ্গ ছিলেন না।
কিন্তু এখন পরিবারের মাঝে থেকেও কিশোর-কিশোরী, যুবা, মাঝ বয়সী এরা নিঃসঙ্গতায় ভোগেন। একাকিত্বে ভোগেন। হতাশায় ভোগেন। কারণ কী?
কারণ গত কয়েক দশকে পৃথিবীজুড়ে সমাজ ও অর্থনীতির এক আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। সমাজ ও পরিবারের বুননটাও বদলে গেছে। বিলাসী পণ্য এখন অনেক তরুণ-তরুণীর কাছে প্রেমের চেয়েও বেশি কাঙ্ক্ষিত।
আর সোশাল মিডিয়া স্মার্টফোন ইন্টারনেট এগুলো দিয়ে একে অপরের সাথে কানেক্টেড থাকার যে প্রয়াসের কথা বেনিয়ারা বলছেন! আসলে তা মানুষকে অন্তরের কানেকশন দিতে পারছে না।
কারণ আগের যে-কোনো কালের চেয়ে এখন মানুষ নিঃসঙ্গ বোধ করে সবচেয়ে বেশি। এবং এরও কারণ হচ্ছে বায়বীয় যে সংযোগ এই বায়োবীয় সংযোগ কখনো মমতার স্পর্শ দিতে পারে না।
প্রিয়জনের একটু স্পর্শ, হাতের একটু স্পর্শ, আঙুলের একটু স্পর্শ, মায়ের আদরের একটু স্পর্শ, বাবার আদরের একটু স্পর্শ যা মুহূর্তে একটা কানেকশন সৃষ্টি করে, একটা সংযোগ সৃষ্টি করে, একটা তরঙ্গের সৃষ্টি করে। তা বায়োবীয় মাধ্যম কখনোই পারে না। যে কারণে একাকিত্বকে নিঃসঙ্গতাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, আধুনিক মহামারি।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা সার্জন জেনারেল ডক্টর বিবেক মূর্তি হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ পত্রিকায় বিষয়টি নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছেন।
তাতে তিনি বলছেন তাতে তিনি বলেছেন, loneliness is a growing health epidemic. একাকিত্ব ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যগত মহামারি।
৪০ শতাংশের বেশি মার্কিন প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিক একাকিত্বে ভুগছে। সুখ দুঃখের আলাপ করার জন্যে নিকটজন আছে এটা বলার মতো লোকের সংখ্যা দিন দিন কমছে। সার্জন জেনারেল হিসেবে কাছ থেকে দেখেছি, একাকিত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে কিশোর-কিশোরীরা কীভাবে সহিংসতা, ড্রাগ ও গ্যাংকালচারে ঝুঁকে পড়ছে।
ডক্টর বিবেক মূর্তি তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, হৃদরোগ বা ডায়াবেটিস রোগের মূল উৎস হলো একাকিত্ব। যত রোগ আমি দেখেছি একাকিত্ব প্রায়শই এই রোগগুলোর মূল কারণ। এটা যেরকম মানুষকে অসুস্থ করছে তেমনি রোগীর রোগ নিরাময়কেও কঠিন করে তুলছে।
লোনলিনেস একাকিত্ব “Loneliness and weak social connections are associated with a reduction in lifespan similar to that caused by smoking 15 cigarettes a day and even greater than that associated with obesity.”
তিনি গভীর দুঃখের সাথে বলেন যে, একাকিত্ব ও দুর্বল সামাজিক যোগাযোগ মানুষের আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে। দিনে ১৫টি সিগেরেট যে পরিমাণ আয়ু কমে একাকিত্ব এবং দুর্বল সামাজিক যোগাযোগ সেই পরিমাণ আয়ু কমায়। স্থূলতা যতটা আয়ু কমায় একাকিত্ব ও দুর্বল সামাজিক যোগাযোগ তার চেয়ে বেশি আয়ু কমিয়ে দেয়।
আসলে তামাক নিয়ন্ত্রণ বা স্থূলতা কমাতে আমরা যতটা সোচ্চার হই, মানুষে মানুষে সামাজিক বন্ধন জোরদার করতে আমরা তেমন মনোযোগ দেই না।
অথচ হৃদরোগ, ডিমেনশিয়া, ডিপ্রেশন ও অ্যাংজাইটির সাথে একাকিত্ব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর কর্মস্থলে একাকিত্ব কমিয়ে দেয় সৃজনশীলতা, সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা।
আসলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী দেশগুলোর প্রেক্ষিতে ডক্টর বিবেক মূর্তি যে কথাগুলো বলেছেন, আমাদের জন্যেও এটি এখন প্রাসঙ্গিক।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে। এবং দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, আমাদের সমাজের কিছু মানুষ পাশ্চাত্যের সামাজিক ব্যাধিগুলোও অসচেতনভাবে রপ্ত করছেন। এবং এই রপ্ত করার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে আমরাও নিঃসঙ্গতার মহামারিতে আক্রান্ত হবো। তাই এখনই সময় বিষয়টা নিয়ে সামাজিকভাবে পদক্ষেপ নেয়া।
আপনি প্রশ্ন করতে পারেন মানুষ এখন একা কেন? একটা সময় ছিল অধিকাংশ মানুষ গোটা জীবন কাটিয়ে দিত জন্মস্থান বা পৈতৃক ভিটার আশেপাশে।
কাজের প্রয়োজনে, বেশি উপার্জনের আশা, নগরায়নের জৌলুসে মোহিত হয়ে মানুষ পরিবার ছেড়ে অন্য শহরে বাস করতে শুরু করল। তাদের বাসস্থান বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে অনেক দূরে একই ভবনে থাকে, একই ফ্ল্যাটে থাকে, কেউ কাউকে চেনে না।
গ্রামে বা মফস্বল শহরে সবাই সবাইকে চেনে। খোঁজ খবর রাখে। কিন্তু বড় শহরে কেউ কারো খোঁজ নেয়ারই সময় পায় না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। এবং শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকাটাই ধীরে ধীরে তাকে নিঃসঙ্গ একা করে ফেলে।
একাকিত্বের আরেকটি কারণ হচ্ছে, দিনের বড় অংশ মানুষ কাটায় অফিসে। পরিবারের সদস্যদের চেয়ে বেশি সময় কাটে সহকর্মীদের সাথে। সেখানে কয়জনের সাথে মমতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে?
কর্মস্থলেও প্রতিযোগিতা, প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা। পাশাপাশি ডেস্ক, যে যার কাজে নিমগ্ন। ফ্রি সময় পেলেও স্মার্টফোনে বায়োবীয় সঙ্গীর সাথে আলাপ। অর্থাৎ সহকর্মী, প্রতিবেশী কারো দিকে মন নেই। শুধু নিজের স্বার্থ। এবং এই স্বার্থপর জীবনের মাশুল দিচ্ছে এখন সবাই।
আসলে মানুষ নিঃসঙ্গ জীব নয়। নিজেকে নিয়ে বাঁচা তার পক্ষে সম্ভব নয়। হাঁপিয়ে ওঠে। সে তার আনন্দের অংশীদার চায়।
আর দুঃসময়ে যখন কাউকে পাশে না পায়, কষ্টের কথা শোনার জন্যে, দুঃখের কথা শোনার জন্যে যদি নির্ভরযোগ্য কাউকে না পায়, আন্তরিক কাউকে না পায় তখন এই কষ্টটা আরো বেড়ে যায়। এবং কষ্ট যখন বেড়ে যায় তখন সে আরো একা হয়ে যায়। এবং যখন একা হয়ে যায় জীবনের প্রতি সে তার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
আসলে আমরা যদি আমাদের বিবর্তনের ইতিহাস দেখি তাহলে আমরা দেখব, আমাদের মমতা এবং অন্যের সাথে সম্পর্ক গড়ার ক্ষমতা, সহযোগিতা করার ক্ষমতাই আমাদের খাবারের সরবরাহ এবং অতিকায় প্রাণি দেখে আমাদের সুরক্ষা দিয়েছে।
এবং হাজার হাজার বছর ধরে এই সামাজিক যোগাযোগের যে গুরুত্ব মূল্য, এটা আমাদের নার্ভাস সিস্টেমে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।
তাই যখন এই সামাজিক যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়, তখন এই সামাজিক যোগাযোগের অনুপস্থিতি আমাদের দেহমনে একটা স্ট্রেস, চাপ সৃষ্টি করে। এবং এই স্ট্রেস, এই চাপ, আমাদের স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের প্রবাহ বাড়িয়ে দেয়। এবং শরীরে এক ধরনের প্রদাহ সৃষ্টি করে। এবং যা হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, গিটে গিটে ব্যথা, ডিপ্রেশন, স্থূলতা এবং অকাল মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
স্বাভাবিকভাবে আপনি প্রশ্ন করবেন তাহলে করণীয় কি?
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এক নম্বর করণীয় হচ্ছে, বাস্তব সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানো। ২০১৭ সালে আমেরিকান জার্নাল অব এপিডেমিওলজিতে প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়, ফেসবুকে যত সময় কাটাবে মানসিক প্রশান্তি তত কমবে।
বাস্তব সামাজিক যোগাযোগ শুধু মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে না, রোগ থেকে সেরে উঠতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্তন ক্যানসার থেকে সেরে ওঠা নারী যদি সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকে, তার আবার ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়া ও অন্যন্য অসুখে মারা যাওয়ার হার বেশি।
আসলে এই জন্যেই নবীজী (স) রোগীকে দেখতে যাওয়ার ওপর এত গুরুত্ব দিয়েছেন। যখনই একজন রোগী কাউকে দেখে যে তাকে কেউ দেখতে এসছে, তাকে কেউ মায়া করে, তার প্রতি কারো মমতা রয়েছে, তখন তার বেঁচে থাকার আকুতিটা বেড়ে যায়। যা তার সুস্থতার জন্যে অত্যন্ত সহায়ক হয়।
অতএব আপনি অসুস্থদের দেখতে যাবেন। রোগী উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি আপনি যে সুস্থ আছেন, আপনি যে তার চেয়ে ভালো আছেন, স্রষ্টা যে আপনাকে ভালো রেখেছেন এই সত্যটি আপনাকে আনন্দিত করবে।
আসলে হাঁটা বা দৌড়ানোর অভ্যাস যেরকম শারীরিক সুস্থতার জন্যে উপকারি, তেমনি সচেতনভাবে বাস্তব সামাজিক যোগাযোগ মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারি।
দু নাম্বার করণীয় হচ্ছে, পরিচিত ও অপরিচিত নির্বিশেষে সালাম দিন। একাকিত্বের প্রতিষেধক হিসেবে কথাটি শুনে আপনি মুচকি হাসতে পারেন।
কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, একাকিত্ব মহামারি থেকে নাগরিকদের বাঁচাতে ধনীদেশগুলো অভিনব সব পদক্ষেপ নিচ্ছে। কোটি কোটি ডলার খরচ করছে।
ইংল্যান্ড মিনিস্টার ফর লোনলিনেস নিয়োগ করেছে। মার্কিন সেনাবাহিনী ফিজিক্যাল ফিটনেসের পাশাপাশি সৈনিকদের সোশাল ফিটনেস বাড়াতে ওয়ার্কশপ করাচ্ছে।
আমেরিকায় একটি মিডিয়া ক্যাম্পেইন সম্প্রতি জনপ্রিয় হয়েছে। মিডিয়া ক্যাম্পেইনটি হচ্ছে জাস্ট সে হ্যালো। কী সেটা? বন্ধু-অপরিচিত যার সাথেই দেখা হয় তাকে হ্যালো বলো।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর কগনিটিভ এন্ড নিউরোসায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক জন কাসিওপ্পো ২০ বছর ধরে নিঃসঙ্গতা নিয়ে গবেষণা করছেন।
তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে হ্যালো বলার অভ্যাস তোমার সোশাল মাসল বাড়াবে। এই সামাজিক মাসল পেশি আমাদের সবচেয়ে বড় বিবর্তিত গুণ।
তিনি বলেন, হাজার বছর ধরে অন্যন্য প্রাণীর ওপরে আমাদের বিজয় তার কারণ হচ্ছে যে, আমরা যুক্তি দিতে পারি, যোগাযোগ করতে পারি, একসাথে কাজ করতে পারি এবং একে অপরের কাছ থেকে শিখতে পারি। একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা এর বিপরীত।
আসলে মানবীয় প্রকৃতির বিপরীত হচ্ছে একা থাকা, নিঃসঙ্গ থাকা। এবং আমরা সামাজিক প্রাণী। আমাদের সামাজিক পেশি রয়েছে। যত এই সামাজিক পেশির অনুশীলন করব তত আমরা সুস্থ থাকব।
আমেরিকান মনোবিজ্ঞানীর কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হলে হাজার হাজার ডলার কনসালটেন্সি দিতে হবে। এবং স্বাভাবিকভাবে তখন তার পরামর্শটা খুব বৈজ্ঞানিক মনে হবে। অবশ্যই বৈজ্ঞানিক।
অথচ এখন থেকে ১৪০০ বছর আগে নবীজী (স) বলে গেছেন, সর্বত্র সালামের প্রচলন করো। অর্থাৎ প্রথম সুযোগেই আগে সালাম দাও। তোমরা লাভ করবে শান্তি ও নিরাপত্তা। হাদীস শরীফ বাংলা মর্মবাণীর ১০৭ নাম্বার হাদীস।
হাদীস শরীফ বাংলা মর্মবাণীর ১৬৫ নাম্বার হাদীস হচ্ছে, ইসলামে সর্বোত্তম কাজ হচ্ছে, পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে সবাইকে আগে সালাম দেয়া, আসসালামু আলাইকুম বলা অর্থাৎ আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, এই কথাটি বলা। এবং অভুক্ত মানুষকে খাওয়ানো।
সালাম কেন সর্বোত্তম কাজ? কারণ সালামের চর্চা সমাজে শান্তি আনে।
তাই একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতার অনাগত মহামারি থেকে নিজেকে, নিজের পরিবারকে, নিজের প্রিয়জনকে বাঁচানোর জন্যে আজকে থেকেই সালামের চর্চা করুন। দেখা হওয়া মাত্র, যার সাথেই দেখা হোক আগে সালাম দিন। বলুন আসসালামু আলাইকুম। আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।
সন্তানকে আগে সালাম দিন। কন্যাকে আগে সালাম দিন। ছেলেকে আগে সালাম দিন। স্ত্রীকে আগে সালাম দিন। স্বামীকে আগে সালাম দিন। ভাইকে আগে সালাম দিন। প্রতিবেশীকে আগে সালাম দিন। বয়স্ককে আগে সালাম দিন। শিশুকে আগে সালাম দিন।
অর্থাৎ সালাম দেয়ার ক্ষেত্রে যত আপনি অগ্রগামী হবেন, যত আগে সালাম দেবেন, সামাজিক পেশি, সামাজিক শক্তি, সোশাল ফিটনেস তত আপনার বাড়বে।
আমরা জাস্ট সে হ্যালো শব্দটির মাঝে নবীজীর এ হাদীসের শিক্ষারই ধ্বনি এবং প্রতিধ্বনি শুনতে পাই।
অতএব আবারও বলছি, নিঃসঙ্গতা থেকে বাঁচার জন্যে, একাকিত্ব থেকে বাঁচার জন্যে যাকেই সামনে দেখবেন বলবেন, আসসালামু আলাইকুম। আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।
সামনে ঈদুল আজহা আসছে। আপনি প্রিয়জনের সাথে পরিবারের সাথে সময় কাটানোর চমৎকার সুযোগ পাবেন। এবং এই সময়ে সামাজিক যোগাযোগের মধ্য দিয়ে, যত বেশি সম্ভব মানুষের সাথে দেখা কর, খোঁজ খবর নিয়ে পরিচিত হয়ে আপনি আপনার সোশাল ফিটনেসটাকে আরো বাড়াবেন। আমরা এটাই প্রত্যাশা করছি।