কিন্তু আমি কোয়ান্টামমে আসার পর দেখি আব্বুও আমার সাথে থাকেন না। আমাকে কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে আবাসিক ছাত্রদের সাথে ভর্তি করে দেয়া হয়। আমার এখনো মনে পড়ে আমার ক্লাসের মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি কাঁদতাম। যদিও কিছুদিনের মধ্যে ঠিক মানিয়ে নিয়েছিলাম।
ছোটবেলার সময়টা ছিল আনন্দ, ভয় ও নতুন কিছু শেখার সময়। পড়ালেখায় আমি প্রথম থেকেই ভালো করার চেষ্টা করেছি। স্মৃতি বলতে মনে পড়ে কুংফু শেখা, মাটি দিয়ে গাড়িসহ নানান জিনিস তৈরি, ছবি আঁকা, গান গাওয়া ও নাচের ক্লাসগুলো। ঐসময় তেমন না বুঝলেও এখন সে-সময়গুলো খুব মিস করি।
যখন ক্লাস ফাইভে উঠলাম হঠাৎ করে পড়াশোনার যে আনন্দ পেলাম তার একটা বড় কারণ প্রতিযোগিতা। স্যারেরা আমাদের খুবই কৌশলের সাথে পুরস্কার দিয়ে মাতিয়ে রাখতেন। আর আমার রেজাল্ট বরাবরই ভালো হতো। তারপর সিক্স, সেভেনে তেমন একটা পড়াশোনা হয় নি। ক্লাসে গল্প করা, স্যারের চোখ ফাঁকি দিয়ে গল্পের বই পড়া, দাবা খেলার মজাই ছিল অন্যরকম। বিকেলে টেবিল টেনিস খেলতাম। হঠাৎ একদিন আমাকে বলা হলো যে আমাকে বিজ্ঞান ক্লাবে চলে যেতে হবে। সেদিনের পর থেকে টেবিল টেনিস তেমন আর খেলা হলো না। সত্যি বলতে কখনো ভাবি নাই বিজ্ঞান এত মজার হতে পারে। ক্লাবে ঢোকার পর অনুভব করলাম পড়াশোনা আসলেই মজার হতে পারে। ক্লাস সেভেন, এইট, নাইনের বিজ্ঞান ক্লাবে খুব সক্রিয় ছিলাম। এছাড়াও আমি মনে করি ঐসময়ে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি—কিছু ভালো বন্ধু। আসলে একই রকম চিন্তাভাবনা করতে পারতাম আমরা।
বিজ্ঞান ক্লাবে থাকার সুবাদে আমি বিজ্ঞানমনস্ক হতে শিখলাম। একদিন স্কুলে ঘোষণা দেয়া হলো যে, আমাদের স্কুলে বাংলাদেশ জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড হবে। যারা চান্স পাবে তাদেরকে ঢাকায় প্রতিযোগিতায় নিয়ে যাওয়া হবে। সেদিন প্রথম অলিম্পিয়াডের সাথে পরিচয়। তারপর থেকেই বিজ্ঞানের যে-কোনো সমস্যার প্রতি ভালবাসা শুরু। বন্ধুরা মিলে স্যারদের কাছ থেকে গণিত অলিম্পিয়াডের বিগত বছরের প্রশ্নগুলো সংগ্রহ করলাম।
আমাদের নতুন ইভেন্ট তখন ব্যান্ড। খুব মনে পড়ে, আমি আর আমার বন্ধু ড্রাম বাজাতাম। আমাদের পকেটে থাকত ছোট্ট একটা পেন্সিল আর সাথে ভাঁজ করা থাকত গণিত অলিম্পিয়াডের একটা প্রশ্ন। যখনই সুযোগ পেতাম, ড্রামের উপরে কাগজ রেখে জ্যামিতিক ডায়াগ্রামগুলো এঁকে এঁকে সমস্যার সমাধান করতাম। একটা সময় এলো স্কুলের শিহাব শুভ স্যার আমাদের স্বপ্নের সীমা বাড়াতে আমাদের নিয়ে ছোট্ট একটা গণিত ক্লাব খুললেন। সেইবার প্রথম গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছিলাম। এই অলিম্পিয়াডকে কেন্দ্র করে আমার জীবনে একটা বিশাল পরিবর্তন আসে। সারাদিন একটা সমস্যার পেছনে লেগে থাকার এই প্রয়াস আমাকে এইচএসসি-তেও খুব সাহায্য করেছে। আমি মনে করি—এই পর্যন্ত জীবনের সবচেয়ে ভালো কিছু সময় পার করেছি এই অলিম্পিয়াডকে কেন্দ্র করে। তাই আমি মনে করি Mathematics is a Lifestyle.
তারপর এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে কলেজে উঠলাম। আর কলেজ লাইফ যে কত ব্যস্ততায় কেটে গেছে তা তো বলার বাইরে। মনে হতো কবে ভাইয়াদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাব।
আজ স্বপ্নের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করার সময় মনে হয় জীবনের সেই ১৫টি বছর বাবা-মাকে ছেড়ে থাকাটা সার্থক হলো। এই আনন্দটা যেন স্বাধীনতার। যেই স্বাধীনতার স্বাদ মনে জাগায় একরাশ কৃতজ্ঞতা।
মেডিটেশন আমার ভালো লাগত। জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় বলতেই হয় এই মেডিটেশনকে নিয়ে পার করেছি। কারণ কোয়ান্টাদের প্রতিদিন দুটি বা একটি মেডিটেশন করতেই হয়। কোয়ান্টা সাদাকায়ন ছিল এই মেডিটেশন এবং জীবনের নৈতিক চর্চাগুলোর প্রাণকেন্দ্র। সপ্তাহ শেষে কিছু বন্ধু ও কিছু ছোট ভাই মিলে এর আয়োজন করতাম। সত্যি বলতে আয়োজন করার মজাটা, অংশ নেয়ার তুলনায় বেশি ভালো লাগত আমার। অনেক কিছু শিখেছি জীবনে প্রথম হওয়ার এই প্ল্যাটফর্ম থেকে।
আমার ছোট্ট এই জীবনে কোয়ান্টাম থেকে অনেক কিছু পেয়েছি। যখন আমি ক্লাস সেভেনে, তখনই আমার কোয়ান্টাম মেথড কোর্সে অংশ নেয়ার সুযোগ হয়। সাথে কোয়ান্টায়ন, অন্বেষায়ন, খতমে কোরআন, লাইফ স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের মতো আত্ম উন্নয়নমূলক অনেক প্রোগ্রাম করার সুযোগ পেয়েছি। আর এগুলোর বেশ কিছু প্রোগ্রাম পেয়েছি গুরুজী দাদুর সাথে। দাদুর সাথে কাটানো এই স্মৃতিগুলো আমার কাছে একেকটি অমূল্য রত্ন। বোর্ড পরীক্ষার আগে ক্লাসের সব বন্ধুরা লাইনে দাঁড়িয়ে গুরুজী দাদুর দোয়া নিতাম। কোনো সাফল্যে দাদুর বাহবা যেন কখনোই মিস হতো না। এই স্মৃতি বিজরিত শৈশবটি অনেক মিস করব।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]