ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। প্রথমেই আমরা সেই বীরদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি যাদের আত্মত্যাগে আমরা স্বাধীন জাতির সম্মান লাভ করেছি, সবচেয়ে আশাবাদী জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে স্থান করে নিয়েছি।
এবারের ডিসেম্বর আমাদের কাছে আরো একটি দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। পরম করুণাময়ের অনুগ্রহে কোয়ান্টামের ৩০ বছর পূর্তি হবে এ মাসে। জানুয়ারিতে শুরু হবে ৩১ বছরের যাত্রা এক নতুন উচ্চতায়।
৩০ বছর পূর্তির এই আনন্দক্ষণে আমরা আমাদের নিবেদিতপ্রাণ সদস্য ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আসলে তারা নিঃস্বার্থভাবে মানুষের কল্যাণে সময় শ্রম মেধা ও অর্থ ব্যয় করেছেন বলেই আমাদের দেশে ‘কোয়ান্টাম’ শব্দটি মেডিটেশন বা ধ্যানের প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে।
সকল বয়সের লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ অনায়াসে ধ্যানের গভীরে, ধ্যানের শান্তির ভুবনে হারিয়ে যেতে পারছেন। পাচ্ছেন ধ্যানের আনন্দ। শারীরিক মানসিক সামাজিক ও আত্মিক ফিটনেস অর্জনের প্রয়াস চালাতে পারছেন।
এই নিবেদিতপ্রাণ সদস্য ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রয়াসে মেডিটেশন যেমন জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, তেমনি তাদের আন্তরিক প্রয়াস, দোয়া, শ্রম ও অর্থেই পরিচালিত হয়ে আসছে সৃষ্টির সেবায় কোয়ান্টামের সকল কাজ।
সৃষ্টির সেবায় কোয়ান্টাম অবশ্য কাজ করছে ২৫ বছর ধরে। সদস্যদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানকে একত্র করে। আর এই ক্ষুদ্র দান একত্র করার মাধ্যম ছিল মাটির ব্যাংক।
২৫ বছর ধরে ৩৬ ধরনের সেবা নিয়ে মানুষের পাশে আছে কোয়ান্টাম। সাড়ে ১৪ লক্ষ ইউনিট রক্ত সরবরাহ, অর্ধ লক্ষাধিক আজীবন রক্তদাতার ডোনার পুল, থ্যালাসেমিয়া রোগীদের প্রাণরক্ষায় আড়াই লক্ষাধিক ব্যাগ রক্ত সরবরাহ বর্তমানে বছরে লক্ষাধিক ইউনিট রক্ত সরবরাহ করে কোয়ান্টাম স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম রক্তগ্রহীতাদের ভরসার প্রথম স্থানে পরিণত হয়েছে।
সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়েছে সোয়া পাঁচ লক্ষ মানুষকে।
চোখের ছানি অপারেশন করে দৃষ্টিক্ষমতা পেয়ে আনন্দে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন দেড় হাজার মানুষ।
সুন্নতে খৎনা করা হয়েছে সোয়া দুই লক্ষ মানুষের।
রোপণ করা হয়েছে নয় লক্ষাধিক গাছের চারা।
স্বনির্ভর হতে সাহায্য করা হয়েছে ৩০ হাজারেরও বেশি পরিবারকে।
বান্দরবান লামার কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের বেড়ে ওঠা বঞ্চিত শিশুদের অর্জন তো এখন সবারই জানা। যা একসময় গণ্য করা হতো গ্রাম্য পাঠশালা হিসেবে, সেই স্কুলই গত চার বছর ধরে ক্রীড়াক্ষেত্রে দেশসেরা স্কুলের সম্মানে ভূষিত।
পাঁচ বছর ধরে ঢাকা স্টেডিয়ামে স্বাধীনতা দিবসের আয়োজনে ব্যান্ড-বাজনা পরিবেশন করে মুগ্ধ করেছে হাজার হাজার দর্শককে। অর্জন করেছে প্যারেডে পরপর পাঁচবার প্রথম পুরষ্কার।
স্কুলের দেড় শতাধিক ছাত্র এখন পড়ছে মেডিকেল বুয়েট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশ ছাড়াও ফুল স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্যে বিদেশেও যাওয়া শুরু করেছে একদা অবহেলিত এই শিশুরা।
আসলে আপনারা যাদের অভিভাবক তারা তো আর অবহেলিত বা বঞ্চিত থাকতে পারে না। আপনাদের দোয়ায় তারা এখন সব জায়গায় পাচ্ছে বিশেষ আদর ও সম্মান।
আসলে মেয়ে শিশুদের নিয়ে প্রায় ৩০০০ শিশুর ভরণপোষণ চিকিৎসা আবাস ও শিক্ষার সকল ব্যয় ভার বহন করছেন আপনারাই।
একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়া ও পরিচালনা করা নিঃসন্দেহে সদকায়ে জারিয়া বা বহমান সৎকর্ম। এর পুণ্য বা নেকি আপনি মৃত্যুর পরও পেতে থাকবেন।
তবে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে সুস্থ একটি শিশুর পৃথিবীতে আসতে সাহায্য করা। কারণ শারীরিক মানসিকভাবে সুস্থ একটি শিশু শুধু সেই পরিবারেই নয়, দেশের সম্পদ। মাতৃমঙ্গল কার্যক্রমের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত প্রসূতিদের গর্ভধারণ থেকে সন্তান প্রসবের পর ৪০ দিন পর্যন্ত পুষ্টি ওষুধপত্র ও চিকিৎসার খরচ বহন করছে এই কার্যক্রম।
আপনাদের দোয়ায় এই পর্যন্ত ৩৩,০০০ সুস্থ ও ফুটফুটে শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে। এদের অনেকের বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যোজ্জ্বল চেহারা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। এদের অনেকেই বড় মাপের মানুষ হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
সাধারণ ডেলিভারির ক্ষেত্রে যে খরচ হয় সে তুলনায় মাতৃমঙ্গলে আমাদের স্বেচ্ছাকর্মীদের তৎপরতার ফলে খরচ অনেক কম। গড়ে ৩০/৩৫ হাজার টাকার মতো।
৩৩,০০০ সুস্থ শিশুর পেছনে ৩০,০০০ করে টাকা লাগলে, টাকাটা কত হয় তা আপনি নিজেই হিসেব করে বের করতে পারেন। অবশ্য এ অর্থ আপনারাই দিয়েছেন। সুবিধাবঞ্চিত প্রসূতিদের তরফ থেকে সুস্থ ফুটফুটে শিশুদের তরফ থেকে আমরা আপনাদের কাছে এজন্যে আবারো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
ছোট হোক বা বড় হোক, সৃষ্টির কল্যাণে প্রতিটি কাজই অত্যন্ত পুণ্যের। রাস্তা থেকে একটি কাঁটা, একটি ভাঙা কাচের টুকরো একটা পরিত্যক্ত ইট বা যে-কোনো প্রতিবন্ধকতা সরানোও পুণ্যের। হাসিমুখে সালাম ও সালামের জবাব দেয়া পুণ্যের। একটা ভালো পরামর্শ দেয়া পুণ্যের।
তবে আমার কাছে সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী ঘটনা ছিল, চলাফেরা করতে অক্ষম প্রবীণ সুরুজ মিয়া।
আমাদের একজন সহকর্মী বললেন, কোয়ান্টামমে ঢোকার পথে লম্বাখোলায় একটা টিনের দোকানঘরের পাশের বেড়া ঘেঁষে শায়িত অবস্থায় এক বৃদ্ধ পড়ে আছেন। স্ত্রী, পুত্র, পরিজন, আত্মীয়-স্বজন তাকে দেখার কেউ নেই। কেউ যদি খাবার খাইয়ে দেয় তো খান। নাহলে এমনিতেই পড়ে থাকেন।
ভেতরে একটা ব্যথা অনুভব করলাম। আসলে যিনি নিজে উঠতে পারেন না, চলাফেরা করতে পারেন না, তার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অবস্থা তো আমরা বুঝতেই পারি।
রাজবিলায় আশ্রয়মমে নিয়ে যাওয়ার কথা বললাম। কিন্তু সুরুজ মিয়া এই জায়গা ছেড়ে যেতে নারাজ। আমাদের কর্মীরা ওখানেই একটা অর্ধনির্মিত দোকানঘরে একটা লোহার খাটে তাকে শোয়ানোর ব্যবস্থা করলেন।
শুরু হলো নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, গোসল, ও খাওয়ার ব্যবস্থা। পোশাক পরিবর্তনের ব্যবস্থা। যত্নের ফলে একটু সুস্থ হয়ে উঠলেন সুরুজ মিয়া।
একদিন সকালে হাঁটতে বেরিয়ে দেখতে গেলাম সুরুজ মিয়াকে। সুরুজ মিয়া আমার দিকে তাকালেন। সেই চোখ সেই চাহনি এখনো চোখে লেগে আছে। মুহূর্তে আমি তার চোখে যেন দেখতে পেলাম, সারা দেশের সন্তান ও পরিজন পরিত্যক্ত অসহায় প্রবীণদের বেদনার্ত চেহারা। ভেতরটা নতুন করে কেঁদে উঠল।
মনে হলো, এরা যখন যুবক ছিলেন, যখন শরীরে বল ছিল, এদের মেধা ও শ্রমে আমরা উপকৃত হয়েছি। সমাজ উপকৃত হয়েছে। আজ এরা অসহায়। সমাজকেই তো এদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
সুরুজ মিয়া মারা গেছেন। তার আর সেবার প্রয়োজন নেই। তার সেবা করার আর কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু কোনো অসহায় প্রবীণকেই যেন রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে না হয়, ডোবার পাশে পড়ে থাকতে না হয়। দোকানের ভাঙা বেড়ার পাশে পড়ে থাকতে না হয়।
সেজন্যেই কোয়ান্টামমে আমরা নির্মাণ শুরু করেছি প্রবীণ সেবাকেন্দ্র। সেবাকেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। সেবাকেন্দ্রকে আমরা বড় করতে চাই যাতে দেশের যে-কোনো প্রান্ত থেকে অসহায় প্রবীণদের এখানে রেখে আপনজনের মমতায় সেবা দিতে পারি।
আসলে একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ, তার জন্যে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হয় মমতার। যখন তিনি মমতা পান তখন মৃত্যুটা অবহেলার হয় না, করুণার হয় না। তখন মৃত্যুটা হয় তৃপ্তির। কারণ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রেখেই তিনি পরকালে পাড়ি জমাতে পারেন।
আমরা প্রবীণসেবা কেন্দ্রকে বড় করতে চাই যাতে দেশের যে-কোনো প্রান্ত থেকে অসহায় প্রবীণদের এখানে রেখে আমরা আপনজনের মমতা দিতে পারি, যত্ন দিতে পারি। যাতে জীবনসায়াহ্নে তিনি অনুভব করতে পারেন মানুষের মমতার স্পর্শ।
আপনিও আপনার মা-বাবার মাগফিরাত বা অনন্ত কল্যাণ, বৃদ্ধ মা-বাবার সুস্থ ও স্বাভাবিক সম্মানজনক মৃত্যু, আর নিজে যাতে বৃদ্ধ বয়সেও সুস্থ কর্মক্ষম থেকে কাজ করতে করতে মারা যেতে পারেন, আপনজন পরিবেষ্টিত অবস্থায় সেই নিয়তে এ কাজে ইচ্ছেমতো দান করতে পারেন।
আসলে রোগ-শোক-বিপদ ও বালা-মুসিবত থেকে মুক্তির জন্যে দোয়া করা বা দোয়া চাওয়ার আগে দান করা দোয়াকে ফলপ্রসূ ও কার্যকর করে।
বুজুর্গরা সাধকরা সবসময়ই এ কথা বলে গেছেন।
হযরত হাবীব আজমী-র ঘটনা। তিনি অনেক বড় বুজুর্গ ছিলেন।
ইমাম শাফী ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বুজুর্গ আমির আজমীকে অত্যন্ত সমীহ করতেন।
একবার এক মা কাঁদতে কাঁদতে হাবীব আজমী-র কাছে এলেন। ছেলের বিচ্ছেদ তাকে শোকে পাগল করে তুলেছে।
হুজুর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে কি কিছু আছে?
মহিলা বললেন, দুই দিরহাম আছে। তিনি ঐ দুই দিরহাম নিয়ে তা গরিবের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। এরপর দোয়ায় বসলেন।
দোয়া শেষ করে মহিলাকে বললেন, “তুমি বাসায় যাও। তোমার ছেলে ফিরে এসছে।”
মহিলা বাসায় পৌঁছে দেখলেন, হারানো ছেলে চলে এসছে।
স্রষ্টার কাছে যখন কিছু চাইবেন, তখন আপনার চেয়েও যে অভাবী সে অভাবীদের জন্যে কিছু দিয়ে তারপর স্রষ্টার কাছে চাইবেন। আপনি তখন স্রষ্টার দৃষ্টিতে দাতা হয়ে যাবেন।
কারণ নবীজী (স) বলেছেন, দাতার দান গ্রহীতার হাতে পৌঁছানোর আগে আল্লাহর হাতে পৌঁছে যায়। আর স্রষ্টা দাতাকে পছন্দ করেন। পছন্দ করেন দান সংগ্রহকারী আর দান বিতরণকারীকেও। স্রষ্টার কাছে এদের মর্যাদাও দাতার সমান।
ডিসেম্বর পার হলেই নতুন বছর আসবে। শুরু হবে কোয়ান্টাম বর্ষ ৩১।
ধ্যান, দান ও দোয়ায় আপনার জীবন ভরে উঠুক প্রশান্তি সুস্থতা ও প্রাচুর্যে। ফাউন্ডেশন উন্নীত হোক নতুন উচ্চতায়।
প্রিয় মাতৃভূমি দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাক বিশ্বের জাতি হওয়ার পথে। নতুন আশাবাদ সঞ্চারিত হোক সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের অন্তরে।
[০২ ডিসেম্বর ২০২২ সাদাকায়নের জন্যে ২৭ নভেম্বর ২০২২ তারিখে গুরুজীর প্রদত্ত বক্তব্য]