এদিকে কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে আমার শৈশব ও কৈশোর দুটোই সুন্দরভাবে অতিবাহিত হতে থাকে। বিশেষ করে আমার মতো পাহাড়ি ছেলেদের কাছে মনে হতো যেন বাসায়ই আছি। কোয়ান্টামমের প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করত। এখনো আমার মন টানে সেখানে যাওয়ার জন্যে। আসলে আমি একটু ভিন্ন স্বভাবের, এই স্বভাবটি ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত আছে। যখন ছোট ছিলাম আমার সমবয়সী শিশুরা বাসায় যাওয়ার জন্যে কান্নাকাটি করত, কিন্তু আমার এমন কোনো অনুভূতি হয় নি সে-সময়।
স্কুলে, আবাসিক হলে, খেলার মাঠে, একই ছাদের নিচে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ও বিভিন্ন ধর্মের আমরা সবাই একসাথে থাকা-খাওয়া, পড়াশোনা, খেলাধুলা করতাম। সেই কিশোরবেলায় আমার অসাম্প্রদায়িক মনোভাব এখান থেকেই তৈরি হয়েছিল।
ছোট থেকেই আমাদের কষ্টসহিষ্ণু করে, কঠোর নিয়মকানুনের মধ্যে বড় করেছিলেন আমাদের শিক্ষকেরা। ছোট থেকেই নিজেদের ছোটখাটো কাজগুলো নিজেরাই করতাম। কখনোই মনে হয় নি যে এই কাজগুলো খুব কষ্টের বা বিরক্তির। নিজের অজান্তেই এভাবে লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে এই মানসিক বিকাশ ঘটেছিল। যদিও তখন আমাদের এখনকার মতো এত সুযোগ-সুবিধা ছিল না।
আর পড়াশোনা নিয়ে আমার নিজের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা ছিল সবসময়। তাই বরাবরই আমার ভালো রেজাল্ট হতো, আমাদের শিক্ষকেরাও আন্তরিক ছিলেন। আমি স্বপ্ন দেখতাম বড় কিছু হওয়ার। ভালো কিছু করার। আর বিশ্বাসটাও রাখতাম অনেক বেশি। এভাবে যত বড় হচ্ছিলাম নিজের মানবিকতার পরিপূর্ণ বিকাশের চেষ্টা করছিলাম।
সত্যি কথা বলতে—আমরা কী পড়ছি, কীভাবে পড়ছি এসব দেখতাম না পরীক্ষার সময়। শুধু বিশ্বাস রাখতাম যে, ভালো রেজাল্ট অবশ্যই করব। এজন্যেই কোনোকিছু চেষ্টা করলে খুব সহজেই তা আয়ত্তে আনতে পারতাম।
বাইরে এসে একটি বিষয় খেয়াল করেছি যে, স্মার্টফোনের কারণে আমাদের দিনের অর্ধেক সময় চলে যায় ফেসবুক, না হয় অন্যকিছুতে। ফলে পড়ার কোনো সময় থাকে না। সময় পেলেও পড়ায় সেভাবে মনোযোগ দিতে পারি না। কিন্তু আমার স্কুলের পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্মার্টফোনসহ ভাচুর্য়াল ভাইরাস থেকে দূরে থাকতাম আমরা। তাই যে-কোনো কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারতাম। ঐ পরিবেশটা এখন খুব মিস করি। জীবনের প্রতিটি ধাপে নিয়মকানুন মেনে শৃঙ্খলার মধ্যে নিজেকে রাখতে হয় এই উপলব্ধি এখন করতে পারছি।
শিশুশ্রেণি থেকে এইচএসসি পর্যন্ত কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজে পড়েছি। ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেই। আমি আর আমার বন্ধু সুইতং খুমী দুজনই চান্স পাই। সেই বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো অনেকেই চান্স পেয়েছিল। কিন্তু আমাদের দুজনের কথা বলার কারণ হলো আমরা খুমী সম্প্রদায়ভুক্ত। বাংলাদেশে খুমী নৃ-গোষ্ঠী থেকে এর আগে কারোর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয় নি। আমরাই প্রথম ভর্তি হলাম। সুইতং চান্স পেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। আমাদের মাধ্যমে খুমীরা পেল নতুন এক পরিচয়। এসবের জন্যে স্ররষ্টার নিকট আমি কৃতজ্ঞ।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]