1. [email protected] : আরএমজি বিডি নিউজ ডেস্ক :
শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৩৭ অপরাহ্ন

আমার ব্যর্থতাগুলোই আমাকে দিয়েছে সাফল্য’— চলচ্চিত্রকার ও নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী

  • সময় সোমবার, ২২ মে, ২০২৩
  • ২৬৯ বার দেখা হয়েছে

শৈশবে অসুস্থতার কারণে আমাকে হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডের বিছানায় কাটাতে হয় অনেক দিন। অসুস্থ থাকায় যখন আমার কিছু করার ছিল না, তখন সময় কাটানোর সঙ্গী ছিল ঠাকুরমার ঝুলি আর শত মনীষীদের কথা। এ দুটো বই ছিল আমার শৈশবের সম্পদ, যা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। ছোটবেলার সেই অসুস্থতার পর থেকে আমি হাঁটতে পারি না, চলতে পারি না, খেলাধুলা করতে পারি না—এই ব্যর্থতা আমাকে প্রচুর বই পড়ার সুযোগ করে দেয় এবং আমার চিন্তার জগতে সমৃদ্ধি এনে দেয়। অন্য সবার মতো আমি অনেক কিছু করতে পারি না বলেই যা আমি করতে পারি সেগুলোতে দক্ষতা বাড়াতে লেগে পড়লাম। যেমন : বই পড়া, আবৃত্তি চর্চা, ফিল্ম দেখা ইত্যাদি। এসবের মধ্য দিয়েই বড় হতে হতে আমি আমার আগ্রহের বিষয় ও জীবনের লক্ষ্যটি একদিন খুঁজে পেলাম—চলচ্চিত্র নির্মাণ। তাছাড়া একদিন আমি ঋত্বিক কুমার ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখলাম। সেই সিনেমায় নায়িকা নীতার একটি সংলাপ—দাদা, আমি বাঁচব—এই একটি কথা আমার জীবনে দারুণ প্রভাব ফেলেছিল। সেদিন আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমি সিনেমা বানাতে চাই। এরপরও এই মুভিটা এখন পর্যন্ত আমি হাজার বার দেখেছি।

এদিকে আমার শারীরিক সমস্যা একসময় পা থেকে হাত এবং ঘাড়ে চলে আসে। ডান হাত এবং ঘাড়ে তীব্র ব্যথার জন্যে প্রচুর পেইনকিলার খেতে হতো। ফলে পড়ায় ভালো হলেও লিখতে অসুবিধার কারণে আমি পরীক্ষায় উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারি নি। বলার মতো কোনো ভালো রেজাল্ট আমার হয় নি। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতেও ব্যর্থ হলাম। আমি ভারতের পুনেতে ফার্গুসন কলেজে অর্থনীতিতে পড়ার সুযোগ পাই। ওখানে গিয়ে আমি পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সংস্পর্শে এসে আমার আগ্রহের বিষয়ে নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ লাভ করি। আসলে আমার ব্যর্থতাগুলোই আমাকে সাফল্য এনে দেয়।

২০ মে ২০২৩ শনিবার কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আয়োজিত মুক্ত আলোচনার ১১৫ তম পর্বে এ কথাগুলো বলেন চলচ্চিত্রকার ও নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী। এ পর্বে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট লেখক ও সমাজহিতৈষী জনাব বাদল সৈয়দ। আলোচনার বিষয় ছিল ‘ব্যর্থতা হোক সাফল্যের প্রেরণা’।

অমিতাভ রেজা আরো বলেন, কোনো ব্যর্থতায় আমি কখনো ঘাবড়ে যাই নি, বিচলিত হই নি। বরং কীভাবে একে সাফল্যের দিকে মোড় ঘুরিয়ে দেয়া যায় সেজন্যে কাজ করেছি। কোনো ব্যর্থতাই আমার কাছে চূড়ান্ত ব্যর্থতা নয়, আবার কোনো সাফল্যও চূড়ান্ত সাফল্য নয়। তাই সবসময় ব্যর্থতা ও সাফল্যকে আমি একইভাবে বরণ করে নিতে চেষ্টা করি। ভারতের পুনেতে যখন পড়াশোনা করছিলাম, তখন বন্ধুরা নানারকম আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকত। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে আমি এসব করতে পারতাম না। সে-সময়টাতে আমি নিজের জন্যে ফিল্ম স্কুলের মতো করে একটি সিলেবাস তৈরি করি। সিদ্ধান্ত নিই—বিশ্বসেরা চলচ্চিত্রকারদের সব ছবি দেখব এবং তাদের সব লেখা পড়ব। আর ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ হচ্ছে ভারতের পুনেতে সবচেয়ে সমৃদ্ধ আর্কাইভ, যেখানে ফিল্ম নিয়ে যারা কাজ করেন, গবেষণা করেন তারা পড়াশোনার সুযোগ পায়। আমি সেখানে প্রবেশের অনুমতি নিয়ে পরবর্তী একবছর পড়াশোনা করলাম। আমার কলেজের ক্লাস শেষে সকাল ১০.৩০ থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত একটানা লাইব্রেরিতে সময় কাটিয়েছি। সেরা সব ছবি দেখেছি, শিখেছি, সেরা চলচ্চিত্রকারদের লেখা পড়েছি। সেসময় আমি টানা একবছর দেশে আসি নি। বাবার পাঠানো অতি অল্প টাকায় ন্যূনতম খরচ করে কোনোমতে চলার চেষ্টা করেছি।

তিনি বলেন, যে-কোনো সাফল্যের জন্যে এভাবে কাজের গভীরে ডুব দিতে হয়। যা করতে চাই শুধু সেই একটি বিষয়ে ফোকাস করে ডুব দিতে পারলে সাফল্য আসবেই।

সভাপতির সমাপনী বক্তব্যে কোয়ান্টাম পরিবারের শুভানুধ্যায়ী বিশিষ্ট লেখক ও সমাজহিতৈষী জনাব বাদল সৈয়দ প্রধান অতিথিকে তার জীবনের গল্প এত সরলভাবে উপস্থাপন করার জন্যে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, আমি নিজেও খেলোয়াড় হতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি। আর এ ব্যর্থতা আমাকে প্রচুর বই পড়ার সুযোগ করে দেয়। আমি বিশ্বাস করি, প্রতিটি ব্যর্থতা জীবনে একটি সিলভার লাইন নিয়ে আসে। আসুন, আমরা ব্যর্থতা থেকে উদ্ভাসিত রূপালি রেখাটি আবিষ্কারের চেষ্টা করি।

প্রধান অতিথির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি :

অমিতাভ রেজা চৌধুরী :

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও টিভি বিজ্ঞাপন অঙ্গনে একটি নন্দিত নাম। ২০১৬ সালে তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র আয়নাবাজি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে একটি মাইলফলক। এ চলচ্চিত্রটির জন্যে শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন। তার এই সৃষ্টিকর্ম একইসাথে বোদ্ধাদের মাঝে এবং সর্বস্তরের দর্শকমহলে ব্যাপক আলোচিত ও প্রশংসিত হয়।

২০১৬ সালে চলচ্চিত্রের মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ব আসর ফ্রান্সের অ্যানুয়াল কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ৬৯ তম আয়োজনে মার্শে দ্যু ফিল্মে আয়নাবাজি প্রদর্শিত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ১১ তম সিয়াটল সাউথ এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এটি সেরা চলচ্চিত্রের স্বীকৃতি অর্জন করে।

২০০১ সালে স্বরচিত টিভি নাটক হাওয়া ঘর নির্মাণের মধ্য দিয়ে নির্মাতা হিসেবে অভিষেক ঘটে অমিতাভ রেজার। একই বছর সহ-নির্দেশক হিসেবে কাজ করেন জনপ্রিয় টিভি নাটক বন্ধন-এর প্রথম ২০ পর্বে। তার প্রতিষ্ঠিত ফিল্ম প্রোডাকশন কোম্পানি ‘হাফ স্টপ ডাউন’ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় হাজার খানেক টিভি কমার্শিয়াল ও ১২টির বেশি টেলিফিল্ম নির্মাণ করেন তিনি। বিজ্ঞাপন নির্মাণে আমাদের দেশে এক নতুন ধারার সূচনা করেন তিনি।

১৯৭৬ সালে ১ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাতুলালয়ে অমিতাভ রেজার জন্ম। বেড়ে ওঠা ঢাকায়। মা হামিদা রেজা চৌধুরী। বাবা প্রয়াত হারুন রেজা চৌধুরী। ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে তিনি পাড়ি জমান ভারতের পুনেতে। পুনের ফার্গুসন কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ওখানে বেশির ভাগ সময় তার কাটত পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে চলচ্চিত্র ও সৃজনশীল ক্ষেত্রে অধ্যয়নরত বন্ধুবান্ধবদের সাথে। মূলত ওদের কাছ থেকেই চলচ্চিত্রের প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করেন তিনি।

শৈশবে টিভি পর্দার আলো, ছায়া, দৃশ্য অমিতাভ রেজা চৌধুরীর মনে দারুণ প্রভাব ফেলে। ছাত্র অবস্থায় তিনি চেয়েছিলেন সমাজে প্রচলিত ধ্যানধারণায় পরিবর্তন আনবেন। তাই ভেবেছিলেন সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হবেন। পরবর্তীতে নিজের সূক্ষ্ম ও দূরদর্শী ভাবনাগুলো সমাজ ও সাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে বেছে নেন নাটক, টেলিফিল্ম, সিনেমা।

বর্তমানে চলচ্চিত্র পরিচালনা ও নির্মাণের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম, টেলিভিশন এন্ড ফটোগ্রাফি বিভাগে ফিল্ম ডিরেকশন বিষয়ে এবং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে এডভারটাইজিং ফিল্ম মেকিং বিষয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করছেন অমিতাভ রেজা চৌধুরী।

বাংলা টিভি নাটক ও চলচ্চিত্র জগতে বহুমুখী সৃজনশীল কাজের জন্যে নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী ভূষিত হন দেশ-বিদেশের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননায়। তার সাম্প্রতিক নির্মিত চলচ্চিত্র ‘রিকশা গার্ল’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসকট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, জার্মানির শ্লিঙ্গেল ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ২০২১-সহ বহির্বিশ্বে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছে।

শেয়ার করুন

এই শাখার আরো সংবাদ পড়ুন
All Rights Reserved © rmgbdnews24.com